দৃষ্টিপাত
পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশের সংস্কৃতি

অধুনা বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে চারদিকে পান্তা-ইলিশ, পান্তা-ইলিশ রব পড়ে যায়। পান্তা-ইলিশ ছাড়া যেন বৈশাখে আর কিছু করার নেই। গগনচুম্বী দামের ইলিশ যেন বৈশাখের আগমুহূর্তে সোনার হরিণ। কখনো-সখনো জোড়া ইলিশ ৪০ হাজার টাকায়ও ওঠে বলে শোনা যায়। এ তো গেল ইলিশের গরম, অন্যদিকে বাজার জমাতে গরম ভাতে পানি ঢেলে বানানো হয় পান্তা। মাটির সানকিতে করে ভাজা ইলিশসহ রাস্তাঘাটে, নগরের বটতলায়, অভিজাত রেস্তোরাঁয় চড়া দামে এসব খেয়ে উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষ। যার সঙ্গে বাংলা সংস্কৃতির আদৌ কোনো যোগসূত্র আছে বলে জানা নেই। পান্তাভাতের সঙ্গে ইলিশ মিশিয়ে খেয়ে বিলাসিতা করার মতো অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এ অঞ্চলের আপামর জনসাধারণের কোনোকালেই ছিল না।
পান্তা এখানে আরাম-আয়েশ করে খাওয়া হয় না, বিলাসিতা করে খাওয়া হয়। গরমের দিনে রাতের বেঁচে যাওয়া ভাত এমনি রেখে দিলে নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই গ্রামের বউ-ঝিরা সেই ভাতে পানি ঢেলে রাখেন। সকালে বাড়ির লোকজন সেই পানি দিয়ে রাখা পান্তাভাত কেবল পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ দিয়ে গামলাভর্তি পানিসহ খেয়েদেয়ে কাজে নেমে পড়েন। এর সঙ্গে বিলাসিতা জড়িত নেই কোনোভাবেই। কেবল প্রয়োজনের তাগিদে গ্রামীণ মানুষের পান্তা খাওয়ার এই প্রচলন বহু পুরোনো।
তা ছাড়া পান্তাভাতের সুবিধাও অনেক। এ ভাত খেতে তরকারি লাগে না। মরিচ-পেঁয়াজ হলেই দিব্যি চলে যায়। কখনো-সখনো শুঁটকি ভর্তা, যেকোনো একটা ভাজি বা রাতের বেশি হওয়া বাসি তরকারি দিয়েই পান্তাভাত খাওয়া হয় মূলত। তাঁরা পান্তা খান একবেলার তরকারির খরচ বাঁচানোর জন্য। অল্প ভাতের সঙ্গে গামলাভর্তি পানিসহ খেয়ে বড় ক্ষুধা নিবারণের জন্যও পান্তা উপযোগী। এসব বিনে ইলিশ মাছ চড়া দামে কিনে পান্তাভাতের সঙ্গে খাওয়া হবে, এমনটা গ্রামীণ জনগণের স্বপ্নের পর্যায়েও পড়ে না।
অথচ আজকাল পান্তা-ইলিশকে আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বলে বাজারজাতকরণের একটা জোড় প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যার সঙ্গে বাংলা সংস্কৃতির যোগসূত্র কোনোকালেই ছিল না। এমন একটি বিষয়কে সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে ঐতিহ্য নয়, বরং গ্রামীণ মানুষের সঙ্গে, যাঁরা সারা বছর উদরপূর্তির নিমিত্তে পান্তা খায় বাধ্য হয়ে, তাঁদের সঙ্গে মশকরাই বলা চলে।
নব্বই দশকের আগে এ দেশে কোথাও পান্তা-ইলিশ সংস্কৃতির উপস্থিতি ছিল বলে জানা যায় না। মূলত নব্বইয়ের দশকেই কিছু পুঁজির কারিগর বাঙালির আবেগকে ব্যবসার পুঁজি করে পান্তা-ইলিশের বাজারজাতকরণে নামে। বৈশাখের অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হিসেবে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এটা। কিছু নাগরিক হর্তাকর্তাকে দলে টেনে নেয়, যাঁরা পান্তা-ইলিশের মোড়কীকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অথচ বাঙালির নববর্ষের ঐতিহ্যের সঙ্গে এর দূরতম সম্পর্কও নেই; বরং আছে ঐতিহ্য ধ্বংস করার প্রয়াস। বাঙালির ইলিশ ঐতিহ্য ধ্বংসের পথে এই উন্মাদনা বিশেষ প্রণোদনার কাজ করে।
ইলিশের প্রজনন মৌসুমে প্রচুর ইলিশ ধরা হয়। জাটকা নিধন চলে সমানে। ফলে ইলিশ মৌসুমে জেলেরা খালি হাতে ফেরে। আপামর বাঙালির রান্নাঘরে ইলিশ প্রবেশাধিকার হারায়।
বৈশাখের বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্য বলতে গেলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বৈশাখী মেলা, রাজধানীর রমনা বটমূলের ছায়ানট শিল্পীদের বৈশাখী আয়োজন, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা—এগুলো যুগ যুগ ধরে। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা। সে সঙ্গে বৈশাখের এ আনন্দ আয়োজনের অনুষঙ্গ হিসেবে নানা ধরনের গ্রামীণ খাদ্য—মিষ্টান্ন-মণ্ডা-মিঠাই, চিড়া, মুড়ি, বিন্নিধানের খই, গুড়ের জিলাপি, নুকুল দানা, বাতাসা, কদমা, খিচুড়ি, ঝুড়ি, খেজুরের গুড়, দই, লুচি, রসগোল্লা, শৈল মাছ, কৈ মাছ, রুই মাছ এসব ছিল মুখ্য। তাও এগুলো নির্ভর করত আর্থিক সংগতির ওপর। সবাইকেই যে একই দ্রব্য খেয়ে বর্ষবরণ করতে হবে, এমন কোনো রেওয়াজও এ অঞ্চলে ছিল না। যে যেমন পারত, যার যার সাধ্যমতো নববর্ষের আনন্দে শামিল হওয়ার চেষ্টা করত। ছেলে-ছোকড়ারা বৈশাখী মেলা থেকে রঙিন হাঁড়ি, মাটির সরাই, ডুগডুগি, রঙিন বেলুন—এসব কিনে বেতের বাঁশিতে পুঁ-পাঁ আওয়াজ করতে করতে মেলা থেকে ফিরত। পান্তা-ইলিশের উপস্থিতি গ্রামীণ বৈশাখের কোনো স্তরেই পাওয়া যায় না। যেটুকু দেখা যায়, তা চাপিয়ে দেওয়া, বানোয়াট সংস্কৃতি। নগরকেন্দ্রিক কিছু অর্থশালী লোকজন ছাড়া সাধারণ নাগরিকের নাগালের বাইরে এই পান্তা-ইলিশ!
বৈশাখ তো দূরের কথা, বছরের অন্যান্য সময়ই সাধারণ জনগণের কাছে ইলিশ দুর্লভ। একদিকে ইলিশের উৎপাদন কমেছে, অন্যদিকে বেড়েছে জনসংখ্যা। বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদার তুলনায় ইলিশের জোগান বরবারই অপ্রতুল। তার ওপর নাগরিক জীবনের এই ইলিশ বিলাসিতা ইলিশকে ক্রমে সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে ঠেলে দিয়েছে। বর্তমানেও এ প্রক্রিয়া চলমান।
এখানে আরেকটি ব্যাপার গভীরভাবে লক্ষণীয়, একে তো ইলিশের উৎপাদন কম, তার ওপর যদি এভাবে ইলিশের প্রজনন মৌসুমে বর্ষবরণের নামে ইলিশ উন্মাদনা শুরু হয়, তবে ইলিশ ভবিষ্যতে কেতাবে পাওয়া যাবে হয়তো, বাস্তবে আর পাওয়া যাবে না। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্চ-এপ্রিলে বৈশাখের নামে জাটকা নিধন হলে আগস্ট-সেপ্টেম্বর বা আষাঢ়-শ্রাবণে ইলিশের ভরা মৌসুমেও ইলিশের দেখা মিলবে না। অথচ আষাঢ়-শ্রাবণ মাসই হলো ইলিশের ভরা মৌসুম। এ সময় ইলিশের স্বাদ থাকে বেশি। কাজেই ইলিশ বাঁচাতে নির্বিচারে নববর্ষ পালনের নামে ইলিশ নিধন বন্ধ করা সময়ের দাবি।
বিষয়টি আরেকটু অন্যভাবে দেখলে দেখা যাবে, যাঁরা বৈশাখের প্রথম দিন পান্তা-ইলিশ নিয়ে মাতামাতি বেশি করেন, তাঁদের কারোরই বাড়িতে হয়তো বাসি-পচা খাওয়ার চল নেই। তিনবেলা গরম গরম রান্না হয়, কড়কড়ে টাকায় মচমচে বাজার হয়, দেদার চলে খানাপিনা। তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে পান্তা নিতান্তই অপাঙক্তেয়। অথচ তাঁরাই পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ না খেলে ‘জাত গেল জাত গেল’ বলে পাড়া সরব করেন। যাঁরা সারা বছর পেটের তাগিদে, স্বল্প খরচে পেট ভরানোর কায়দা হিসেবে পান্তা-কাঁচামরিচ গলাধঃকরণ করেন, তাদের প্রতি বিষয়টিকে সরাসরি বিদ্রূপ হিসেবেই দেখি। এ বিদ্রূপ বন্ধ হোক।
বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে যায় না এমন কোনো হালচালকে সংস্কৃতি বানানোর এ উলম্ফন বন্ধ হোক। ইলিশ নিস্তার পাক। বৈশাখে দরকার নেই, বরং বছরের অন্তত যেকোনো একদিন হলেও প্রতিটি বাঙালির হেঁশেলে ইলিশ প্রবেশাধিকার পাক।
তা ছাড়া পয়লা বৈশাখে ওই একদিন ঘটা করে পান্তা-ইলিশ না খেলে কী হয়? বাঙালির খাতা থেকে নাম কাটা যায়? জোর করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে বাঙালিয়ানা দেখানোর এ মশকরা বন্ধ হোক!
লেখক : শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।