২২ মার্চ : বিশ্ব পানি দিবস

জাতিসংঘের পরিবেশ উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলন (ইউএনসিইডি)-এর ১৯৯২ সালের মিটিংয়ে বিশ্ব পরিবেশে পানির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৩ সাল থেকে সর্বপ্রথম বিশ্ব পানি দিবস পালন করা হয়ে আসছে। সেই হিসাবে এ বছর এর ২৪তম বর্ষের বিশ্ব পানি দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত একেক বছর একেক ধরনের লাগসইও যুতসই থিম এবং প্রতিপাদ্য নিয়েই পালন করা হয়ে থাকে দিবসটি।
এ দিবসের ২০১৬ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ওয়াটার অ্যান্ড জবস অর্থাৎ পানি এবং কাজ। পরিসংখ্যানে প্রকাশ, পৃথিবীতে মোট শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক জনশক্তিই পানি সংক্রান্ত এবং পানিকে ঘিরে জীবিকা নির্বাহের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। সারা বিশ্বে বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত সে সংখ্যা প্রায় দেড় বিলিয়ন। পৃথিবীপৃষ্ঠের তিন-চতুরাংশ পানি। শতকরা হিসাবে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৭১.৪ শতাংশ। এত পানি থাকার পরও চারদিকে শুধু পানির অভাব। আর সেই অভাবটি হলো বিশুদ্ধ পানির। কারণ ৭১.৪ শতাংশ পানির মধ্যে ৯৭% ভাগ পানিই লবণাক্ত পানি, ২% হলো বরফ এবং বাকি মাত্র ১% হলো বিশুদ্ধ পানি। হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের মিলিত রাসায়নিক পদার্থের নামই যে পানি তা অনেক আগেই রসায়নবিদরা আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু এটি যে একটি যৌগ তা ১৯৭৮ সালে বিজ্ঞানী ক্যাভেন্ডিস আবিষ্কার করেছিলেন। অর্থাৎ সেখানে রাসায়নিকভাবে দুই পরমাণু হাইড্রোজেন ও এক পরমাণু অক্সিজেন মিলিত হয়ে এক অণু পানি উৎপন্ন করে থাকে। পানির রাসায়নিক গুণাবলির মধ্যে রয়েছে, এর কোনো অম্লত্ব কিংবা ক্ষারকত্ব নেই। অর্থাৎ পানির পিএইচ মান হলো সাত (৭.০)। পানি নিয়ে চিরন্তন ও সর্বজনীন একটি স্লোগান হলো পানিই জীবন। তবে সেই জীবনের জন্য পানিই আবার কখনো কখনো মরণের কারণও হতে পারে। যেহেতু পানিই জীবন, সেজন্য সেই পানি খোঁজ করার জন্য, একফোঁটা পানির অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য মানুষ চাঁদ, মঙ্গলগ্রহ ইত্যাদি স্থানে অনুসন্ধান চালাচ্ছে প্রতিনিয়ত। মহাবিশ্বে এখন পর্যন্ত পৃথিবীই একমাত্র গ্রহ যেখানে পানি রয়েছে। আর পানি রয়েছে বলেই মানুষসহ অন্যান্য জীবের অস্তিত্ব রয়েছে।
আমরা যেমন গ্রামে-গঞ্জে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা কম থাকার কারণে শহরে পাড়ি জমাই। কিন্তু এখন আবার এর উল্টো চিত্রও দেখা যাবে। কারণ এখন নাগরিক দূষণের জন্য শহরের মানুষ গ্রামে-গঞ্জের দিকে ধাবিত হতে দেখা যাবে। এ বিষয়ে প্রসঙ্গত বলতে গেলে বলতে হয়, ইদানীং টেলিভিশনে বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভারের পিওর ইট নামক পানির ফিল্টারের একটি বিজ্ঞাপনের কথা। সেখানে বিজ্ঞাপনের থিমটি এ রকম যে, এক ব্যক্তি এক গ্লাস পানি নিয়েছেন পান করার জন্য। তখন সেই পানি পানের সময় পাশাপাশি একটি কারখানার বর্জ্যের পাইপ হতে অনবরত দূষিত পানি পড়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। তখন সেই গ্লাসের পানি পানের সময় তার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী বিরাট ক্ষতিকর কিছু দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে এমন ভঙ্গিতে দৌঁড়ে এসে সেই পানি পান থেকে তাকে বিরত করে। বিষয়টি বিজ্ঞাপনের জন্য হলেও আমার বিবেচনায় তা-ই আসলে সত্যি। কারণ দূষিত পানি পান করলে তা বিষসম হয়ে কোনো মানুষ হয়তো একদিনে কিংবা সাথে সাথে মৃত্যুবরণ করবে না, কিন্তু সময়ের ব্যবধানে অসুস্থ হয়ে আস্তে আস্তে সে যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। আবার দেখা গেছে দিনের পর দিন সাগরে ভাসমান জলযানের ভিতরেই পানির অভাবে অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে ভুরি ভুরি। মানুষের শরীরের প্রায় ৭০ ভাগই পানি। অন্যান্য জীবের ক্ষেতেও তাই। কাজেই বুঝাই যাচ্ছে, পানির গুরুত্ব কত অপরিসীম। আমি নিজেও গত তিন বছর আগে সমুদ্রপথে সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে স্টিমারের মধ্যে বাথরুম সেরে সেখানে লোনাপানি পানি ব্যবহার করে দীর্ঘক্ষণে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে পারছিলাম না। কারণ সাগরের পানির ওপর দিয়ে চলতে থাকলেও সেখানকার লনণাক্ত পানিতে সাবান কাজ করছিল না। বিশুদ্ধ পানির অনেক ব্যবহার রয়েছে যা আমরা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি।
তাদের মধ্যে অন্যতম হলো- নিত্য-নৈমিত্তিক পানীয় হিসেবে ব্যবহার, দৈনন্দিন রান্না করার কাজে, কাপড়-চোপড় ধোয়ার কাজে, অন্যান্য বস্তু ধোয়ার কাজে, কৃষিতে সেচের কাজে, শিল্প কল-কারখানায় ব্রয়লার ও মেশিন শীতলীকরণের কাজে, রাসায়নিক ও অন্যান্য পরীক্ষাগারে দ্রাবক হিসেবে, ফটোগ্রাফি ও ঔষধ প্রস্ততিতে, অগ্নিনির্বাপণে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে, মাছ চাষে, খনিজ পদার্থের পৃথকীকরণে, সাগর ও নদীতে পরিবহনসহ ইত্যাদি আরো নানা কাজে। সেই পানি প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে দূষিত হয়ে নষ্ট হচ্ছে। পানি জৈব ও অজৈব উভয়ভাবে দূষিত হয়ে থাকে। একদিকে যেমন মানুষ এবং প্রাণির বর্জ্য বস্তু, বর্জ্যবস্তুর রোগজীবাণু, অদক্ষ খামার ও কাঠের কাজে উৎপন্ন তলানি বা খাদ ইত্যাদির মাধ্যমে পানি দূষিত হচ্ছে, অপরদিকে গৃহস্থালি স্যুয়ারেজ, শিল্পবর্জ্য, পেপার ও পাল্প ফ্যাক্টরি, রাসায়নিক ফার্টিলাইজার, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, তেল, তাপ, ডিটারজেন্ট ইত্যাদির মাধ্যমেও পানি দুষিত হচ্ছে অনবরত। বিভিন্ন প্রকার জীবাণু যেমন- ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, প্লাস্টিক দূষণ, আর্সেনিক, তাপ, অম্লত্ব, ক্ষারকত্ব, মিঠা পানি, খরা পানি, বন্যার পানির পরিচলনের মাধ্যমেও পানির প্রবাহে সমস্যা সৃষ্টি হয়ে পানি বিনষ্ট হচ্ছে। দেখা যায়, পানির পরিচলনে তা শুধু এক অবস্থা হতে আরেক অবস্থাতে রূপান্তুরিত হয় মাত্র। পানির এ রূপান্তর ঘূর্ণায়মান একটি চক্রাকার বৃত্তের মতো সংঘটিত হয়ে থাকে। সেটাকে বিজ্ঞানের ভাষায় পানিচক্র বা ওয়াটার সাইকেল বলা হয়ে থাকে। সেভাবে পানিচক্রের মাধ্যমেই আমরা বৃষ্টি, ঝড় ঝঞ্ঝা, তুফান, টর্নোডো, জলোচ্ছ্বাস, সুনামি, তুষার ঝড় ইত্যাদির অস্তিত্ব টের পেয়ে থাকি। অর্থাৎ পরিবেশের সাথে প্রকৃতিতে যে সব সবুজ বৃক্ষরাজি রয়েছে সেগুলো থেকে এবং ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগের নদী-নালা, খাল-বিল, সাগর-মহাসাগর ইত্যাদি প্রত্যেকটি পানির উৎস থেকে প্রতিনিয়তই তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে পানির বাষ্পীভবন হচ্ছে। সেই পানি উপরে উঠে বায়ুমন্ডলে গিয়ে জমা হচ্ছে। সেই বায়ুমন্ড-লের পানি বাতাসের সাথে ঘুরতে ঘুরতে আরো উপরে উঠতে থাকে। সেখানে তা ঠান্ডা হয়ে আরো ঘন হয় যাকে বৈজ্ঞানিকভাবে ঘণীভবন বলা হয়ে থাকে।
সেই জমাকৃত পানি তখন বরফে পরিণত হতে থাকে। সেই বরফ যখন জমেজমে আকারে বড় হয়, তখন তার ভর আর বাতাস রাখতে পারে না বলেই তা আবার গলতে গলতে নিচের দিকে পড়তে থাকে। একেই আমরা বৃষ্টি বলে থাকি। সেই পানি বা বরফ যদি না গলে সরাসরি নিচের দিকে পড়ে তখন তাকেই আমরা বলি শিলাবৃষ্টি। যাহোক, সে বৃষ্টির মাধ্যমে প্রাপ্ত পানি তখন কৃষির সেচ হিসেবে, মাছ চাষের মাধ্যম হিসেবে গড়িয়ে গড়িয়ে ছোট-বড় জলশয়ে জমা হলে তা আবার নদী-নালা, খাল-বিল, সাগর-মহাসাগরে চলে গিয়ে মোট পানির পরিমাণ ঠিক রাখে। অনেকটা কোনোস্থানে বিনোদনের জন্য স্থাপিত দৃষ্টিনন্দন পানির ফোঁয়ারার মতো। মাঝপথে মানুষের জন্য অনেক উপকার করে যায়। তবে কোনো জায়গার পানি যদি অতিরিক্ত পরিমাণে রাসায়নিকভাবে দূষিত থাকে, তাহলে সেই অত্যাধিক দূষিত পানি ওয়াটার সাইকেলের মাধ্যমে তখন অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয় যাকে এসিড বৃষ্টিও বলা হয়। প্রবন্ধের শুরুতে যা দিয়ে শুরু করেছিলাম এখন সেখানে ফিরে যাওয়া দরকার। অর্থাৎ প্রতিবছর মার্চ মাসের ২২ তারিখে জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব পানি দিবস পালন করা হয়ে থাকে। এবারেও তা পালিত হচ্ছে।
এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়টি ‘ওয়াটার অ্যান্ড জবস খুবই যক্তিযুক্ত হয়েছে এ কারণে যে, পানি ছাড়া যেমন জীবন কল্পনা করা যায় না, ঠিক তেমনি পানি দ্বারা অনেক কাজেরও (এমপ্লয়মেন্ট) সৃষ্টি হয়। শুধু একটি ব্যবসার কথাই যদি ধরি তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়ায়? যেমন এখন পানি দূষণের হাত থেকে বাঁচার জন্য বোতলজাত মিনারেল ওয়াটারের ব্যবসা একটি রমরমা বাণিজ্য। এক লিটার পানির দাম এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক লিটার দুধের সমান দাম। পানির মাধ্যমে জলযান দিয়ে পণ্য পরিবহন করলে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে বিশগুণ কম খরচ হয়ে থাকে, পাশাপাশি সেখানে অনেক মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা হয়ে থাকে। পৃথিবীতে এখন অনেক মানুষ মাছের ব্যবসায় তাদের জীবন-যাপন করছে। সেচের মাধ্যমে আধুনিক কৃষিতে উন্নতি লাভ হয়েছে সেখানেও সৃষ্টি হয়েছে মানুষের জন্য অনেক কাজ। দুষিত পানিকে পরিশোধন করে তা পুনরায় ব্যবহারের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে কাজের। এখন সময় এসেছে পানি দূষণ রোধ করার। কারণ কোনো কিছুকে আগে নষ্ট করে পরে সমাধান করার চেয়ে নষ্ট হতেই না দেওয়ার জন্য সবাইকে সচেতনভাবে কাজ করতে হবে।
কথায় প্রচলিত আছে, প্রিভেনশন ইজ বেটার দেন কিউর। একটু সচেতন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে পারলে আমরা মারাত্মক পানি দূষণের হাত থেকে রেহাই পেয়ে আমাদের কাজের পরিধিকে সম্প্রসারিত করে ভালো জীবন-যাপন করতে পারি। এখন নদ-নদীর পানি দূষণ হতে হতে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যেমন ঢাকা শহরের পাশের বুড়িগঙ্গার কথাই যদি ধরি তাহলে দেখা যাবে, সেটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নদীগুলোর মধ্যে একটি, যাকে একটি রাসায়নিক ময়লা পানির ভাগার বলা হয়। বুড়িগঙ্গার কালো ও বিষাক্ত জলে এখন শুধু কেমিক্যাল আর কেমিক্যাল। অপরদিকে সম্প্রতি আইনিভাবে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সাগরের জলসীমা বৃদ্ধি পাওয়ায় সমুদ্র সম্পদ তথা ব্লু ইকোনমির অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বার বারই বলে চলেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিষয়ভিত্তিক সভা-সেমিনারের মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় এবারও দিবসটি পালনের অংশ হিসেবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নবপ্রতিষ্ঠিত পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। কাজেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও পানিকে সংশোধন করে তার ব্যবহার বৃদ্ধি করে এবং নদ-নদীকে দখল না করে তাদের নাব্য ধরে রেখে মানুষের জীবিকা বৃদ্ধি করে বাংলাদেশের উন্নয়নকে আরো সুসংহত করতে হবে। সেইসাথে সুরক্ষিত হবে পরিবেশ, আমাদের সুন্দর পৃথিবী রক্ষা পাবে জলবায়ু পরিবর্তনের করাল থাবা থেকে। এবারের ২০১৬ সালের বিশ্ব পানি দিবসে এটিই হোক বাংলাদেশের জন্য সচেতনতা সৃষ্টির একটি ক্যাম্পেইন।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়