প্রতিক্রিয়া
ফেসবুক স্ট্যাটাসে স্বাধীনতা পদক ও এর ভবিষ্যৎ

কবি নির্মলেন্দু গুণ ফেসবুকে স্বাধীনতা পদক না পাওয়ার হতাশায় স্ট্যাটাস দেওয়ার পর এ মাসেরই ১৬ তারিখে পেলেন আবিষ্কার সাহিত্য পুরস্কার। পুরস্কার পাওয়া তিনজনের আরো দুজন হলেন সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হক ও কথাশিল্পী সমরেশ মজুমদার। জাতীয় প্রেসক্লাবে সেদিনের সেই অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেছিলেন, ‘পুরস্কার সব সময়েই আমাদের জীবনে বার্তা নিয়ে আসে। কৃষক ফসলের চারা রোপণ করে শস্য ঘরে তোলার স্বপ্ন ও আশা নিয়ে। আমরাও যাঁরা সত্তরোর্ধ্ব বয়স তাঁদের ঠিক সেই কৃষকের মতো অবস্থা। আমরা যা করেছি, তারই ফল হয়তো এই পুরস্কার।’
অবশেষে এবার তাঁরই হাতে উঠতে চলেছে স্বাধীনতা পদক। স্বাধীনতা নিয়ে লিখেছেন কবিতা। এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও তাঁর ভূমিকা গর্ব করার মতো। তাই বলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্তি! এ নিয়ে অনেকেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। এটা স্বাভাবিকও বটে। প্রশ্ন থেকে যায়, এভাবে স্বাধীনতা পদক পেলে এ পদকের ভবিষ্যৎ কোন দিকে? রাষ্ট্রের অন্যতম এ সম্মাননার মানহানি হচ্ছে না তো? যুক্তি আছে উনি স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্তির যোগ্য। কিন্তু পদক নিয়ে ওনার অভিলাসের কথাও তো আমরা শুনেছি। স্বাধীনতা পদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক রাষ্ট্র যাকে মনে করবে তাকে সম্মান জানাবে, এটা স্বাভাবিক। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতা পুরস্কার পেলে সেটা বলার আর কিছু থাকত না। এভাবে পদক পাওয়ার ঘটনায় গুরুত্ব বেড়েছে ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমের।
স্বাধীনতা পদক নিয়ে ফেসবুকে কবি গুণ লিখেছিলেন, ‘আমার একদা সহপাঠিনী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার ব্যর্থতাদৃষ্টে আমি প্রথম কিছুকাল অবাক হয়েছিলাম, এখন খুবই বিরক্ত বোধ করছি। অসম্মানিত বোধ করছি। আমাকে উপেক্ষা করার বা সামান্য ভাবার বা তুচ্ছ জ্ঞান করার সাহস যার হয়, তাকে উপেক্ষা করার শক্তি আমার ভেতরে অনেক আগে থেকেই ছিল এবং আশা করি এখনো রয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রীকে ভুল সংশোধন করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘পারলে আপনার ভুল এখনই সংশোধন করেন। বাংলাদেশের প্রথম সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালে একুশে পদক প্রবর্তন করেন। বঙ্গভবনে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে প্রথমবারের মতো একুশে পদক প্রদান করা হয়। পরে কবি জসীমউদ্দীন ও বেগম সুফিয়া কামাল একুশে পদকে ভূষিত হন। অজানা কারণে আমি ওই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত অতিথি ছিলাম। কিন্তু তৎকালীন কেবিনেট সচিব শফিউল আজম একুশে পদকের মানপত্রটি ইংরেজিতে পাঠ করার প্রতিবাদ জানালে আমাকে বঙ্গভবনের দরবার হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। তাই পুরো অনুষ্ঠানটি আমার দেখার সুযোগ হয়নি, যদিও আমার নিমন্ত্রণ পুরো অনুষ্ঠানের জন্যই বৈধ ছিল। সম্ভবত পরের বছর (১৯৭৭) স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে জেনারেল জিয়া একুশে পদকের পাশাপাশি স্বাধীনতা পদক চালু করেন। জিয়ার সবই খারাপ বিবেচনায় জেনারেল জিয়ার বাকি সবকিছু পরিত্যাগ করলেও তাঁর প্রবর্তিত একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক প্রদান প্রথাটি শেখ হাসিনা ত্যাগ করেননি। ফলে একপর্যায়ে ২০০০ সালে শেখ হাসিনার সরকার আমাকে একুশে পদকের জন্য মনোনীত করেন। কিন্তু সেই পদক তিনি নিজ হস্তে আমাকে প্রদান করে যেতে পারননি। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে খালেদা জিয়া হাসিমুখে আমাকে ওই পদক প্রদান করেন। তারপর ১৫ বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে আট বছর কেটেছে শেখ হাসিনার সরকারের। শেখ হাসিনা স্বাধীনতা পদকের মুলোটি আমার নাকের ডগায় ঝুলিয়ে রেখেছেন। কিন্তু দিচ্ছেন না। ওনার যোগ্য ব্যক্তির তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হতে হতে আকাশে পৌঁছেছে। কিন্তু সেইখানেও আমার স্থান হচ্ছে না।’
রাগ, অভিমান আর ক্ষোভের এ স্ট্যাটাসটিতে অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন কবি গুণের লোভ নিয়ে। একজন কবি যিনি কবিতা শুনাবেন। যিনি সৃষ্টির কথা বলবেন। প্রেমের কথা বলবেন। বলবেন মানবতার কথা। তিনি যদি এমন অভিমানের সুরে পদকের কথা বলেন, তখন কবিতার মানুষগুলো হতাশ হয়। হতাশ হয় কবিতা নিজেও। ভাবাতে শুরু করে স্বাধীনতা পদকের মতো পদকগুলো কি তাহলে ফেসবুক স্ট্যাটাসের ওপর নির্ভর করে?
বিষয়টি এ পর্যন্ত গড়ালেও ভালো হতো। আরেকটি স্ট্যাটাসে যেখানে কি না তিনি স্বাধীনতা পদকের মূল্য নিয়ে কথা বলেছেন। স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘আমার একটা ভুল ধারণা ছিল। আমি জানতাম স্বাধীনতা পদকের অর্থমূল্য হচ্ছে নগদ দুই লাখ টাকা এবং তিন ভরি স্বর্ণের একটি পদক, যে পদকগাত্রে প্রাপকের নাম স্বর্ণাক্ষরে উৎকীর্ণ থাকবে। আজ জানলাম- স্বাধীনতা পদকের অর্থমূল্য দুই লাখ টাকা নয়, তিন লাখ টাকা। এবং পদক-প্রাপকের নাম-খোদিত স্বর্ণের লকেটের ওজন একই থাকছে। অর্থাৎ তিন ভরি স্বর্ণ। এমন মন্তব্যের পর কবির পাঠকরা মর্মাহত হয়েছে।’ এরই মধ্যে স্বাধীনতা পদক পাওয়ার পর কবি নির্মলেন্দু গুণ গণমাধ্যমকে বললেন, ‘আমি এই পুরস্কার পাওয়াতে আনন্দিত। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ, কারণ তিনি আমার ক্ষোভের বিষয় বুঝতে পেরে আমাকে পুরস্কৃত করেছেন। অনেকেই আমার স্ট্যাটাসের পর কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন। অনেক পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছে। সত্যিই বলতে স্বাধীনতা পদক যে আমাকে দেওয়া হয়নি, এ জন্য ক্ষোভ করে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। ফেসবুক যে অনেক শক্তিশালী সেটা আবার প্রমাণিত হয়েছে। আমার এই স্ট্যাটাসটি প্রধানমন্ত্রীর চোখে পড়েছে। তিনি মনে করেছেন আমার এই দাবি ন্যায্য। তাঁকে ধন্যবাদ। তবে আমার কোনো লোভ ছিল না।’
আগামী ২৪ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা পুরস্কার তুলে দেবেন কবি গুণের হাতে। পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি হয়তো বলতে চাইবেন স্বাধীনতা পদক হাতে তার কেমন লাগছে। কিন্তু কবিভক্তরা প্রশ্ন করবে। কবির হাতে স্বাধীনতার কবিতা লেখার পুরস্কার না ফেসবুক স্ট্যাটাসের পুরস্কার?
লেখক : সাংবাদিক, দ্য ডেইলি সানের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি।