মতান্তর
বিশ্ববাটপারের জুয়ায় বাংলাদেশের অর্থ ও আমাদের লজ্জা!

বিশ্ববাটপারদের জুয়ার আসরে যখন বাংলাদেশের গণমানুষের শ্রমে ঘামে অর্জিত টাকায় ফূর্তি হয়, তখন আমাদের লজ্জার নাসারন্ধ্ররা মাটির ধুলায় লুটায়ে গড়াগড়ি খায়। নিজেকে স্থির রাখবার অবিরাম প্রচেষ্টারা মাঠে মারা যায়। আমাদের রিজার্ভ এ সময় সত্যিকার অর্থেই যাদের রক্ষা করবার কথা তাদের প্রতি এক ধরনের ঘৃণার বিবমিষা উগ্রে আসে। আমরা দেশটা আসলে কাদের কাছে গচ্ছিত রাখছি, এমন প্রশ্নরা উত্তরের খুঁজে গুমরে মরে!
তাও ভালো আপনি এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের সব সুবিধা ভোগ করছেন এবং আপনার কাছে সব তথ্য থাকে বলে অনেক ঘুমের পরে, অনেক রাজকীয় রজনীর হিসাব-নিকাশ শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফেসবুক পেইজ থেকে জানতে পারছেন, সাইবার আক্রমণে ৩৫টি ভুয়া পরিশোধ নির্দেশের ৯৫ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারের মধ্যে ৩০টি নির্দেশের ৮৫ কোটি ডলার বেহাত হওয়া শুরুতেই প্রতিহত করা গেছে। অবশিষ্ট ১০ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে দুই কোটি ডলার এরই মধ্যে ফেরত আনা গেছে। বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার (প্রায় ৬৩৫ কোটি টাকা) ফেরত আনার প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি, তারা তাদের ডিজিটাল কলকাঠি নাড়ায়ে আমাদের আমজনতার শ্রমে ঘামে অর্জিত রিজার্ভের ৮৫ কোটি ডলার চুরি ঠেকাতে পেরেছে।
এই খবর শোনার পর অর্থ লুটের দুর্যোগের কালে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ গভর্নর ড. আতিউর রহমান জিন্দাবাদ বলে যারা স্লোগান দেবে না তারা আমাদের চির নিস্তব্ধ সুশীল সমাজের কাছে অতিশয় হীনমন্য বলেই চিহ্নিত হতে থাকবে।
যেই চীন দেশ থেকে আমরা বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র এনে নিজেদের সার্বভৌমত্ব পাহারা দেই, নিজেদের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে দেই, সেই চীন দেশের হ্যাকাররাই বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম হ্যাক করে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের অ্যাকাউন্ট থেকে আট কোটি ডলার অর্থ সরিয়ে নিয়ে এর অর্ধেকই ফিলিপাইনের জুয়ার আড্ডায় উড়িয়ে দিয়েছে। এই ঘটনা ফিলিপাইনের মিডিয়ায় বহুল প্রচার পেয়ে মাসখানেক ধরে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় চললেও আমরা জানছি বা অনুধাবন করছি কেবল।
এরই মধ্যে খুব সঙ্গত কারণেই হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরকে দায়ী করে তাঁদের পদত্যাগ চেয়েছে বিএনপি। অর্থ লোপাটের ঘটনায় গভর্নরের ব্যাখ্যাও দাবি করেছে তারা। বিশ্বে এযাবৎকালের সব অর্থ কেলেঙ্কারির মধ্যে আমাদের রিজার্ভের টাকা জালিয়াতির ঘটনা যেখানে অন্যতম বিরাট চাঞ্চল্যকর ঘটনা হিসেবেই অর্থ বিশ্লেষকরা মানছেন, সেখানে আমাদের অর্থমন্ত্রী বা অর্থ সংশ্লিষ্টদের চরম নীরবতায় হতাশ না হয়ে পারা যায় না। নীতিনির্ধারকদের সব পক্ষই যেন এই ঘটনা নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। কাজেই নিজেদের সিকিউরিটির দরজা হাট করে খোলা রাখার সুযোগে অর্থ লোপাটের মতো ঘটনায় বিএনপির দাবির সাথে দেশবাসীও নিঃসন্দেহে একাত্ম।
এখন কী জবাব দেবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত? কী জবাব দেবেন গভর্নর ড. আতিউর রহমান?
অবশ্য আপনাদের কাছে কোনোকালেই দেশের বড় বড় অর্থ লোপাটের বিষয়েও মোক্ষম জবাব থাকে না! হলমার্কের চেনা ভূতেরা যখন সোনালী ব্যাংকের তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা খেয়ে ফেলে, এটা বড় কোনো বিষয় না বলে গলাবাজি করেন। শেয়ার বাজারের ২০ লাখ ক্ষুদ্র আমানতকারীর হাজার হাজার কোটি টাকা চিহ্নিত কিছু মানুষের পকেটে গেলেও তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করবার ইচ্ছেটাও আপনাদের মনে জাগ্রত হয় না! বেসিক ব্যাংকের শত কোটি টাকা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলে আপনারা দাবি করেন, এমন ছোটখাটো ঘটনা ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। আপনাদের এমন উদাসীনতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ফসল আজকের রিজার্ভ চুরি। তো আপনারা যদি রাষ্ট্রীয় কোষাগারই পাহারা দিতে না পারেন, তবে আপনাদেরকে কেন পদপদবি দিয়ে আমাদের পয়সায় রাষ্ট্রীয় পাহারা দেওয়া হবে?
আমরা নাকি মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছে গিয়ে বিরাট কিছু অর্জন করে ফেলেছি। অথচ সেই মধ্যম আয়ের দেশ নিয়ে এখন বিশ্ব মিডিয়া সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে রোজ, বাংলাদেশের টাকা চুরির তদন্তে আমেরিকান ফায়ারআই, বানান ভুলে রক্ষা পেল বাংলাদেশের দুই কোটি ডলার, হ্যাকিংয়ে হারানো অর্থের একাংশের হদিস নেই বিশ্বের কোনো ব্যাংকেই।
প্রখ্যাত আমেরিকান সাংবাদিক সিডনি জে. হ্যারিস বলতেন, Men make counterfeit money; in many cases, money makes counterfeit men.আমরা দেশের মানুষের পুকুর চুরি দেখতে দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি! কাজেই এমন অতিঅভ্যস্ত মধ্যম আয়ের দেশ থেকে এই ছিটেফোঁটা টাকা পয়সা চুরি গেলে হয়তো কিছুই আসবে যাবে না! কিন্তু একদিন আমাদের ভুলে পুরো রিজার্ভই যদি দুর্ধর্ষ চোরেরা গলধঃকরণ করে ফেলে, সেদিন আমাদের পোশাককর্মী, আমাদের রেমিট্যান্সের জোগানদাতা, আমাদের একজন রিকশাওয়ালা এমনকি আমাদের একজন ভিক্ষুকেরও কী গতি হবে তা কি ভেবে দেখবেন, তথ্যের ভাণ্ডার ও প্রযুক্তির কারিগর উপদেষ্টারা? আমাদের রিজার্ভের লকটা শক্তপোক্ত করতে কথায় চিড়ে না ভিজিয়ে এবার অন্তত কাজের কাজটা করে দেখান।
আমাদের বুঝতে দিন যে, দেশের চাবিকাঠি আপনাদের মতো জেগে জেগে ঘুমিয়ে থাকা মানুষের কাছে গচ্ছিত রেখে আমরা নিশ্চিন্ত, নির্ভার থাকতে পারি! দেশটাকে দয়া করে ফিলিপাইন্স বা লাসভেগাসের ক্যাসিনোর জুয়ার আসরে আর তুলবেন না। আমাদের মাথাটা হেট করে দিবেন না প্লিজ। আমরা পরাভব না মানা বাংলাদেশি এই গর্ব নিয়ে বাঁচার অধিকারটুকু আমাদের নিশ্চয় আছে, তাই না!
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন