সাদা চোখে
‘দেশের রাজা পুলিশ’ এবং জবাবদিহিতার সংকট

বাংলাদেশে পুলিশের ভালো কাজের ভুরি ভুরি উদাহরণ যেমন আছে তেমনি ইমেজ সংকটও কমবেশি সব সময়ই ছিল। তবে সম্প্রতি বিতর্কিত বেশ কিছু কর্মকাণ্ড এ বাহিনীকে আরো প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলল। প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক। যাদের কাছে নিরাপত্তা-নির্ভরতার জন্য ছুটে যাওয়ার কথা; তাদের দ্বারা হয়রানির আশঙ্কায় বিপদগ্রস্ত মানুষ বরং এ বাহিনীর দ্বারস্থ হওয়াকে এখন এড়িয়ে চলে- সম্প্রতি এমন প্রবণতা বাড়ছে। পুলিশের প্রতি আস্থাহীনতা এবং এ বাহিনীর কিছু সদস্যের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের দায়ভার কি শুধু তাদের। এ অবস্থার জন্য সব দোষ পুলিশ বাহিনীর ওপর ন্যস্ত করা আদৌ সমীচীন কি না? যদি তাই হয়, তবে পুলিশ বাহিনীর প্রতি অবিচারই করা হবে না; বাস্তবতাকে অস্বীকার এবং এ বাহিনীকে মানুষের জন্য সত্যিকার কল্যাণধর্মী প্রতিষ্ঠানরূপে দাঁড় করানোকে বাধাগ্রস্ত করবে।
পুলিশকে জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং সাংবিধানিক কাঠামোর নিরীখে আইন প্রয়োগ, রাষ্ট্রীয় বিধানের বাইরে দলীয় এবং রাজনীতির হীনস্বার্থে কমবেশি সব সরকারই ব্যবহার করেছে। তবে তাতে কিছুটা হলেও রাগঢাক ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুলিশ বাহিনী যে রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান তা চিহ্নিত করা কেন যেন দুরূহ হয়ে পড়েছে? পুলিশের মৌলিক পেশাদারত্ব অগ্রাধিকার না হয়ে এখন তারা অতিমাত্রায় রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি বিরোধী পক্ষের সাংসদ, বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিকে হেনস্থা-গালমন্দ এমনকি দিগম্বর করে কোনো পুলিশ সদস্য যদি পুরস্কৃত হয়-প্রমোশন পায়; সুতরাং গোলাম রাব্বি, বাবুল মাতুব্বরদের মতো যে কেউ তাদের ইচ্ছের শিকার হতেই পারে। এজন্য শুধু পুলিশ বাহিনীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কতটা যুক্তিসঙ্গত।
গণমানুষের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা বা তাদের কাছে জবাবদিহিতার নৈতিক ভিত্তি ক্ষমতাসীনরা কতটুকু ধারণ করে তার ওপরই নির্ভর করে সরকারের মধ্যকার প্রতিষ্ঠানগুলোর আচরণও। পুলিশ বাহিনী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। সুতরাং জনগণের প্রতি সরকারের জবাবদিহিতার পরিমাপ নিরুপণে পুলিশের ভূমিকাকে একটি উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা যায়। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, জনগণের প্রতি যত বেশি দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার কমিটমেন্ট থাকবে শুধু পুলিশ বাহিনী কেন তা সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও প্রভাবিত করবে। কিন্তু এর ব্যত্যয় যখন খোদ ক্ষমতাসীনদের বেলায় ঘটে তখন সরকারের সব প্রতিষ্ঠানই আর জবাবদিহিতার ভয়কে তোয়াক্কা না করে বরং ক্ষমতাসীনদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়। সৃষ্টি হয় মোসাহেব ও সুবিধাবাদী শ্রেণির। যারা পেশাগত দক্ষতা, যোগ্যতার চেয়ে স্তাবক হিসেবে ক্ষমতাসীনদের আস্থাভাজন হতে চেষ্টা করে। কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি যে উপর থেকেই। জনগণের কাছে জবাবদিহিতার ভয় এবং গণতান্ত্রিক ধারার সংকট শুধু পুলিশ বাহিনী কেন সরকারের অন্য সব প্রশাসনযন্ত্রেও অনুরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এতে বরং সরকারের ভেতরই বিশৃঙ্খল হয়ে উঠে। আর এর খেসারত নানাভাবে জনগণকেই দিতে হয়।
দুই/চারজন সন্ত্রাসী, দস্যু বা যেকোনো পর্যায়ের অপরাধী এমন কি রাজনৈতিক পরিচয়ে কথিত ‘অস্ত্রধারীর’ সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এখন নিত্যনৈমিত্তিক সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এড়িয়ে অপরাধীদের ধরে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কী সত্যিই অসম্ভব। ‘বন্দুকযুদ্ধের’ এমন প্রবণতায় সমাজে অপরাধ সংঘটনের মাত্রা কমেছে- এমন দাবি তো কেউ করতে পারবে না। অপরাধীদের আইনের হাতে সোপর্দের মধ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কৃতিত্ব-পেশাগত দক্ষতা, যোগ্যতার মাপকাঠি হবার কথা। একই সঙ্গে নাগরিক অধিকার তথা মানবাধিকার রক্ষা এবং বিচার লাভের সাংবিধানিক অধিকার সমুন্নত রাখার কথা। কিন্তু অপরাধীদের বিনাবিচারে নানা নামে হত্যা করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতাকেই বরং প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা হয়। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জবাদিহিতা না থাকার করণেই বিনাবিচারে এসব রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড ঘটছে এমন প্রশ্ন উত্থাপন কি অমূলক। এ অবস্থায় আমরা কেবল বলতে পারি, ‘রাষ্ট্র তুমি মানবিক হও।’ এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম, খুন, অপহরণ, নির্যাতন, চাঁদাবাজির অভিযোগ হরহামেশাই উঠছে। র্যাবের গুলিতে ঝালকাঠির নিরপরাধ লিমনের পা হারানো এবং নারায়ণগঞ্জের সাত খুন; পুলিশের নির্যাতনের শিকার মিরপুরের ঝুট ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান ও শাহআলী থানার চা দোকানি বাবুল মাতুব্বরের মৃত্যু, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বির নির্যাতিত হওয়া এবং মোহাম্মদপুর এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী পুলিশের হেনস্থার শিকার হওয়ার ঘটনা এসব অভিযোগের ভিতকে মজবুত করেছে।
পুলিশের ছুড়ে মারা স্ট্রোবের আগুনে বাবুল মাতুব্বরের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের ভাষায় ‘পুলিশ সত্যিই বাড়াবাড়ি করছে। তাদের ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পুলিশের স্পর্ধা সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে; যাদের হাতে এভাবে মানুষ নিগৃহিত হয় এমন পুলিশ আমাদের দরকার নেই।’ তার এই উষ্মা প্রকাশের মধ্য দিয়ে পুলিশের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের একটি খণ্ডচিত্রই কেবল উপস্থাপন করা হলো মাত্র।
কিন্তু পুলিশ বাহিনীকে একটি মর্যাদার জায়গায় প্রতিষ্ঠা করার কার্যকর কর্মপন্থা ও কৌশল সরকারকেই নিতে হবে। নিপীড়ক নয় সেবক হিসেবেই পুলিশ জনগণের আস্থাভাজন হয়ে উঠবে, তা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ বাহিনীর প্রতি আস্থাহীনতা সমাজে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে- তা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। এখন প্রায়ই দেখা যাচ্ছে মানুষ নিজেদের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছাবে। তাই প্রথমে পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন এবং সেই সঙ্গে কায়েমী স্বার্থবাদিতা ত্যাগ করতে হবে। রাষ্ট্র ও জনশৃঙ্খলাসহ মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখার জন্য একটি আধুনিক, চৌকশ ও নিরপেক্ষ বাহিনী গড়তে পুলিশের নিচ থেকে উচ্চ পর্যায়ে সংস্কার আনা জরুরি। এ বাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গিসহ তাদের সনাতন ধ্যানধারণায় পরিবর্তন এনে পুলিশকে জনগণের বন্ধুবৎসলরূপে গড়ে তোলতে উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি ও প্রাপ্তির বিষয়গুলোও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা গেলে পুলিশের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির যেমন পরিবর্তন হবে ঠিক তেমনি এ বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থাও ফিরবে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও পর্যবেক্ষক