জাগো বাহে
রংপুরের সাধারণ মানুষের ঘুরে দাঁড়ানো

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে অবহেলিত বিভাগ ছিল রাজশাহী। কারণ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বাজেটে সবচেয়ে কম বরাদ্দ থাকত রাজশাহী বিভাগের জন্য। রংপুর বিভাগ হওয়ার পর থেকে এখন সেই কলঙ্কতিলক শুধুই রংপুর বিভাগের। রাষ্ট্রীয় অবহেলা সত্ত্বেও রংপুর বিভাগের মানুষের জীবনে এসেছে এক ইতিবাচক পরিবর্তন। রাষ্ট্রীয় অবহেলা বলছি এ কারণে যে, প্রত্যেক সরকারই রংপুরের প্রতি বিমাতা সুলভ আচরণ করেছে। এ আচরণ যে শুধু একক কোনো সরকারের তা নয়। একটি সময় গেছে যখন সারা দেশের অনেক মানুষ তিনবেলা করে খাওয়ার নিশ্চয়তা পায়নি। আবার যখন দেশের অনেক এলাকার দৈন্য অবস্থা কেটেছে তখনো রংপুরের দৈন্যদশা অপরিবর্তিত থেকেছে। সেই করুণ দৈন্যদশা এখন আর রংপুর বিভাগের মানুষের নেই। রংপুরের সাধারণ মানুষের আর তিনবেলা খেতে না পারার মতো অনটন নেই। এখন রংপুর বিভাগের সাধারণ মানুষ তিনবেলা খেতে পারে।
১৫-২০ বছর আগেও রংপুর অঞ্চলের একজন দিন-মজুর সারাদিন পরিশ্রম করে দুই কেজি চাল আর চার-পাঁচ টাকা পেত। তারও আগে এক কেজি চাল এক টাকা পেত। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল কয়েকজন, কিন্তু উপার্জক্ষম ব্যক্তি হয়তো একজনই। আর এখন পরিবারের সদস্য সংখ্যাও কমে এসেছে। অন্যদিকে বেড়েছে শ্রমের মূল্য। যারা নিম্নবিত্ত তাদের প্রথমত প্রয়োজন তিনবেলা খাওয়ার।
বর্তমানে রংপুর বিভাগে একজন দিনমজুর সর্বনিম্ন আড়াইশ- তিনশ থেকে পাঁচশ টাকা আয় করে। ২৫ টাকাতে এক কেজি চাল কেনা যায়। সেই হিসাব করলে একজন দিনমজুর ন্যূনতম ১০-১২ কেজি চাল উপার্জন করে। ১০-১২ কেজি চাল একদিনে আয় হলে একজন দিনমজুরের খুব সহজেই চলে যায়।
সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে কয়কেটি ঘটনা। বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর থেকে রংপুর বিভাগের প্রচুর সংখ্যক মানুষ ঢাকা-সিলেট-নারায়ণগঞ্জমুখী হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ার আগে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকা যেতে সময় প্রয়োজন হতো প্রায় ২৪ ঘণ্টা। যাতায়াতও ছিল খুবই কঠিন। তখন বছরে চার মাস রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলার সাধারণ মানুষের কোনো কাজ না থাকলেও দূরে কোথাও কোনো কাজের সন্ধানে যেত না। এখন আগের সেই বাস্তবতা বদলে গেছে। এখন কৃষি কাজ যখন থাকে না তখন এ অঞ্চলের সাধারণ কৃষিশ্রমিকরা খেটে খাওয়া কাজের সন্ধানে দূরবর্তী বিভিন্ন স্থানে যায়। সে কারণে অলস সময়ে কর্মহীন থাকা শ্রমিকরা প্রতিবছর যে পরিমাণ পিছিয়ে যাচ্ছিল তা বন্ধ হয়ে যায়। বলা যায় বঙ্গবন্ধু সেতু রংপুর অঞ্চলের অর্থনীতির ধরনটাই বদলে দিয়েছে।
তিস্তা সেচপ্রকল্প তিস্তা তীরবর্তী বিপুল জনগোষ্ঠীকে সচ্ছল করে তুলেছে। অল্প টাকা ব্যয়ে বোরো মৌসুমে প্রচুর ফলন ফলাতে সক্ষম হতো তিস্তা সেচপ্রকল্পের আওতাধীন কৃষকরা। তিস্তা সেচপ্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ ঠিক মতো করতে পারলে বিশাল এক জনগোষ্ঠীতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগত। বর্তমানে সেচপ্রকল্প কার্যত অচল হওয়ার কারণে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বৃহৎভাবে রংপুর বিভাগের সাধারণ মানুষ ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে ভালো আছে। সেই বিবেচনা করলে মহাজোট সরকারের সময় থেকেই এই ইতিবাচক পরিবর্তন বেশি পরিমাণে দেখা যায়।
২০০৮ সালে চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়েছিল। তখন রিকশাচালক-দিনমুজর সবাই তাদের শ্রমের মূল্যও বাড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর যখন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসে তখন দ্রব্যমূল্য কমে আসে। কিন্তু শ্রমের মূল্য আর কমেনি। এটাই হয়েছে শ্রমিক শ্রেণীর জন্য কল্যাণের। ২০০৯ সাল থেকেই মূলত রংপুর অঞ্চলের শ্রমজীবীরা অনেক ভালো আছে। রংপুর অঞ্চলের প্রচুর নারী-পুরুষ পোশাক কারখানায় কাজ করে। পোশাক কারখানার এসব শ্রমিকও রংপুরের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে অনেক বড় সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
রংপুরের মানুষের জীবনে এক সময়ে মঙ্গা নামক যে কলঙ্ক ছিল তা এখন অনেকটাই দূরীভূত হয়েছে। তবে সারা দেশের উন্নয়ন সমতা ভিত্তিক না হওয়ার রংপুর অঞ্চলের পশ্চাৎপদতা এখনো রয়ে গেছে।
রংপুরের বৃহৎ সংখ্যক কর্মক্ষম মানুষই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। সেই কৃষি ততটা লাভজনক নয়। ফলে প্রতিবছর যত চাষাবাদই হোক না কেন উন্নয়ন তাদের ততটা হয় না। সেজন্য তাদের কৃষিতে শ্রম বিনিয়োগের পাশাপাশি শিল্পকারখানাভিত্তিক শ্রম গড়ে তোলার উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। রংপুরের সাধারণ কৃষিশ্রমিকরা দেশকে খাদ্যে স্বনির্ভরতা আনার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখছে। কিন্তু সেই অর্থে রংপুরের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে বড় কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না। তারপরও রংপুরের মানুষ নিজেদের চেষ্টাতে এবং সরকারের সামান্য সহযোগিতা নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।