রাজনীতির ২০১৫
যে বছরটা চলে গেল

দিন, মাস, বছরের হিসাব অনেক কাজে লাগে। এটা অপরিহার্য। তবে ঐতিহাসিক ঘটনাবলির উদ্ভব, বিকাশ ও পরিণতি দিন-তারিখ ধরে ঘটে না। তার অন্য প্রক্রিয়া আছে, যদিও সেটাকেও চিহ্নিত করা হয় সন-তারিখ দিয়েই। কার্য-কারণ সূত্র ধরে অনেক কিছু বোঝা যায়। মানুষের ইতিহাসকে বুঝতে হলে যে সূত্র অবলম্বন করা সমীচীন, তাকে বলা যায় কারণ-করণীয়-কারণ ও ফলাফলের সূত্র।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত দেখা যায়। একটি পর্যায়ের আরম্ভ ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের শুরু থেকে এবং তার প্রসার ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যু পর্যন্ত। আগে রাজনীতির যে প্রকৃতি ছিল, ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় থেকে তা বদলে যায়। এই বদলে যাওয়া রাজনীতি আজো চলছে। যে রাজনীতি এখন চলছে তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো : ১. রাজনীতিতে নাগরিক কমিটি, সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শব্দটির নিয়ামকের ভূমিকা পালন; ২. রাজনীতিতে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, সিএনএন প্রভৃতি পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমের প্রত্যক্ষ পরিচালনা; ৩. রাজনীতির গতি-নির্ধারণে মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন, নারীবাদী আন্দোলন, জঙ্গিবাদবিরোধী আন্দোলন ইত্যাদির গুরুতর ভূমিকা; ৪. গণতন্ত্রের ধারণাকে নির্বাচনতন্ত্রে পর্যবসিত করা; ৫. রাজনীতিতে ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ও মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ-প্রতিযোগিতাবাদ, বহুত্ববাদ, জাতীয়করণ-বিলোপ ইত্যাদির মাধ্যমে পুঁজিবাদকে নবরূপদান; ৬. ক্রমে রাজনীতিতে ভারতের প্রাধান্য বিস্তার এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে কর্তৃত্ব বিস্তার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা; ৭. গণতন্ত্রের নামে অপব্যবস্থা ও দুর্নীতি; ৮. রাজনীতিকে ব্যবসায়ে পরিণত করা; ৯. রাজনীতিতে ও সমাজের স্তরে স্তরে পুরাতন পরাজিত বিশ্বাস ও ধর্মের পুনরুজ্জীবন; ১০. আওয়ামী লীগের শক্তি বৃদ্ধি ও বিএনপির শক্তি হ্রাস। এসব বিষয় ও ইতিহাসের ধারাক্রম যত তলিয়ে দেখা যাবে, ততই বোঝা যাবে দুই পর্যায়ের রাজনীতির পার্থক্য। যে বছরটা আমরা পার করে এলাম, ২০১৫ সাল, তার রাজনীতি দ্বিতীয় পর্যায়ের অন্তর্গত। গুণগত মান বিচার করলে অবশ্যই বলতে হবে, রাজনীতির গতি নিম্নগামী—খারাপ থেকে খারাপের দিকে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির কথিত নির্বাচনের প্রতিক্রিয়ায় ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে কয়েক মাস রাজনীতির নামে, গণতন্ত্রের নামে, হরতালের নামে যে জ্বালাও-পোড়াও কার্যক্রম হয়, তাতে শতাধিক লোকের প্রাণ যায়, বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ধ্বংস হয়। সরকার কঠোর পন্থা অবলম্বন করে চললেও এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ দমনে ব্যর্থ হয়। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে কার্যক্রম গ্রহণ করে, তাতে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত শক্তিশালী হয় এবং বিএনপি নিতান্তই দুর্বল হয়ে পড়ে।
রাষ্ট্রব্যবস্থার ও সমাজের স্তরে স্তরে সরকারের ও শাসক দলের লোকদের জুলুম-জবরদস্তি বেড়ে চলছে। আওয়ামী লীগের ভেতরে উপদলীয় বিরোধ থাকলেও উপদলগুলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে চলে। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্ব নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। কার্যত দেশে এখন আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দল নেই। একদলীয় ব্যবস্থায়ও দেশের ভালো চলার উপায় হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ সরকার ধীরগতিতে অত্যন্ত দৃঢ়তর সঙ্গে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করে চলছে। জামায়াত এর বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার পরিচয় দিত, কিন্তু জামায়াতের সে শক্তি ক্রমে শেষ হয়ে গেছে। এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বিএনপির বক্তব্য স্বচ্ছ নয়।
ধর্মের প্রশ্নে ভেতরে ভেতরে গোটা জাতি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আছে। আস্তিক-নাস্তিকের বিরোধ ফল্গুধারার মতো বয়ে চলছে। এর মধ্যে দেখা দিয়েছে নাস্তিকতা প্রচারের অভিযোগে কয়েকজন ব্লগারের প্রাণসংহার। জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন ব্লগার না হয়েও, নাস্তিকতা প্রচারে না গিয়েও, ব্লগার অভিজিত রায়ের বই প্রকাশের কারণে কথিত ইসলাম-রক্ষাকারী গুপ্তঘাতকদের হাতে প্রাণ হারান। ২০১৫ সাল গত হলেও এই হত্যাযজ্ঞের ধারা শেষ হয়েছে বলে মনে হয় না। সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে তৎপর করে সমস্যার সমাধান করতে চাইছে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বারাক ওবামা, নরেন্দ্র মোদি, আর শেখ হাসিনা এক সুরে একই কথা বলে চলছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র জঙ্গিবাদবিরোধী যুদ্ধে ভারত সরকার ও বাংলাদেশ সরকার অংশীদার থাকার চুক্তিতে আবদ্ধ আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার আবার সৌদি আরবের নেতৃত্বে গঠিত ৩৪টি মুসলিম রাষ্ট্রের জঙ্গিবাদবিরোধী জোটে যুক্ত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার ফলে জঙ্গিবাদী শক্তিগুলো বাংলাদেশ সরকারকে শত্রু গণ্য করছে। ফলে বাংলাদেশে স্থিতিহীনতা বাড়ানোর জন্য তারা কাজ করে চলছে। বাংলাদেশ কি সরে আসতে পারে না এসব জোট থেকে ? দাবি তুলতে পারে না, মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো থেকে সব বিদেশি পণ্য সরিয়ে নেওয়ার?
মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ন্যাটোর সৈন্যবাহিনী থাকলে এবং তাদের হত্যাযজ্ঞ ও লুটতরাজ চলতে থাকলে জঙ্গিবাদী শক্তির উত্থান বন্ধ হবে না। সরকার সব রাষ্ট্রের জনগণের দিক থেকে জঙ্গিবাদবিরোধী তৎপরতা অবলম্বনের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো থেকে সব বিদেশি সৈন্য ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। সে আন্দোলন জোরদার করা হলে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের জনগণও তাদের সরকারের বিরুদ্ধে সে আন্দোলনে যুক্ত হবে। এমন অবস্থা বদলে যাবে। যুদ্ধবাদী ও জঙ্গিবাদী তৎপরতা বন্ধ হবে।
কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি, শ্রমিকদের আয়, আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনীতে সৈন্য পাঠিয়ে আয়—এসবের ফলে বাংলাদেশের উৎপাদন ও সম্পদ বাড়ছে। সে সঙ্গে বাড়ছে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-জবরদস্তি, সামাজিক জঙ্গিদের ও মানবতাবিরোধী কার্যক্রম। এই তো ২০১৫ সালের বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে মানবিক দিকের ও রাজনীতির উন্নতি হবে কি?
লেখক : সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।