নর্দমার বিষজলে নীরবদের আর্তনাদ

যে শহরে রাজা-রানির বাস, উজির-নাজির-কাজিরা প্রবল দাপটে যাপন করেন স্বর্গসুখ। সেই শহরের খামখেয়ালি, অবহেলায় হারিয়ে যায় অভাবী ঘরের নাড়িছেঁড়া ধনেরা। এ কেমনতর রাজধানী! একদিকে প্রাচুর্যের হীরকদ্যুতিতে চোখ ঝলসে যাওয়া জৌলুস, অন্যদিকে আসমান ছোঁয়া তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য-উদাসীনতার রাজত্ব। এখানে বছরের পর বছর হাঁ করে থাকা স্যুয়ারেজ লাইন অথবা ম্যানহোল নামের শিশুখেকো অজগররা শিহাব কিংবা নীরব নামের সদ্য ফোটা গোলাপকুঁড়িকে পচা, পুঁতিগন্ধময় তরলে ডুবিয়ে চুবিয়ে চুবিয়ে গিলে ফেলে !
মঙ্গলবার দুপুর গড়িয়ে কালনাগ বিকেল নেমেছিল রাজধানীর কদমতলী থানার শ্যামপুরের জাগরণী মাঠের পশ্চিম প্রান্তের পালপাড়া রোডে। সেই রোডের পাশে মুখ ব্যাদান করে শুয়েছিল শিশুখেকো স্যুয়ারেজ লাইন। এ শহরে মাঠ নেই, অভাবী বাবার সংসারে খেলার মতো একচিলতে উঠোনও নেই। তাই নীরব নামের শিশুদের খেলার প্রিয় ঘাট হয়ে ওঠে পালপাড়ার ওই খোলা স্যুয়ারেজ লাইনের টইটম্বুর বিষকালো জলের স্রোত। গতকাল এখানেই খেলতে খেলতে টুপ করে পড়ে গিয়েছিল ছয় বছরের শিশু নীরব। ভাঙা খোলামুখ স্যুয়ারেজের স্রোতপূর্ণ জল নীরবের জন্য গভীর, বিষময় জল। সাঁতার না জানা অবোধ শিশু। জানলেই বা কী! স্যুয়ারেজের জলে এমনিতেই মিশে থাকে মৃত্যুর সব আয়োজন। ফটিকের মায়ের মতন বুকের মানিকের বিপন্নতার খবর পেয়ে পাগলের মতো ছুটে এসেছিলেন নীরবের মা নাজমা বেগমও। সন্তানকে খুঁজতে ওই স্যুয়ারেজে ঝাঁপ দিয়েছিলেন নিজেও, পারেননি। চারপাশের কালো অন্ধকার জল হাতরে হাতরে রিক্ত, শূন্য হয়ে ফিরে এসেছিলেন। মেলেনি ফুটফুটে কচিমুখ সন্তানের সপ্রাণ কিংবা নিথর দেহ। ফায়ার ব্রিগেডের ডুবুরি নেমেছিল, ভিড় করেছিল সহমর্মী হাজারো মানুষ। কত উদ্বেগ, কতজনের নীরব অশ্রুপাতে কেটে গেল তার দীর্ঘ চার ঘণ্টা। চার ঘণ্টা, চার যুগের চেয়েও দীর্ঘ। এই উদ্বেগাকুল সময় হারিয়ে যাওয়া নীরবের দেহটাকে নিয়ে মরণখেলা খেলেছিল জলবাহী অভিশপ্ত সুড়ঙ্গ। অবশেষে বুড়িগঙ্গালগ্ন শ্যামপুর লঞ্চঘাট স্লুইসগেট থেকে উদ্ধার করা হয় ছয়টি বসন্ত দেখা ইসমাইল হোসেন নীরবকে। ততক্ষণে ছোট্ট দেহের খাঁচা ছেড়ে না-ফেরার দেশে উড়ে গেছে তার প্রাণপাখি। আর কখনো ফিরবে না।
নীরব নামের একটি শিশুর মৃত্যুকাহিনী এখন সবার মুখে মুখে। টিভির খবরে, আলোচনায়, টক শোর টেবিলের টাটকা টপিক। হয়তো এরই মধ্যে মহাগর্জনে পয়দা হচ্ছে কোনো তদন্ত কমিটি। হোক হাজারটা অমন বন্ধ্যাতদন্ত, কার কী এসে যায়? এই সেই বরইতলা জাগরণী মাঠের পশ্চিম প্রান্তের পালপাড়া রোডে স্যুয়ারেজর লাইন, নীরব যেখানে ডুবে গেল। ঠিক এইখানে এই ভাঙা স্যুয়ারেজে বছর চারেক আগে একইভাবে প্রাণ হারিয়েছিল আরেক শিশু শিহাব, তার বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। নীরবের উদ্ধার অভিযান চলার সময় ছুটে এসেছিলেন শিহাবের মা শিরিনও। চিৎকার করে তিনি বলছিলেন চার বছর আগে এই স্যুয়ারেজ লাইনে পড়ে তাঁর ছেলে শিহাবের মৃত্যুর কথা। বলছিলেন শিহাবের মৃত্যুর পরও কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, মেরামত করেনি স্যুয়ারেজের ভাঙা অংশ।
শিহাব আর নীরবের মায়েরা তো অবুঝ, তাঁরা তো বোঝেন না তাঁদের মতো মায়েদের বুক খালি হলে এই শহরের, এই দেশের কারো কিচ্ছু এসে-যায় না। রথী-মহারথীদের মনে না থাকলেও আমাদের মনে আছে গত বছর, ২৪ ডিসেম্বর শাহজাহানপুরের রেলওয়ের পরিত্যক্ত পানির পাম্পের ৩০০ ফুট গভীর খোলা পাইপে পড়ে মরে গিয়েছিল আরেক শিশু জিহাদ। কত্ত হৈচৈ, লেখালেখি। কোথায়, কী হয়েছে! হবে না। নীরব-শিহাব-জিহাদরা এই দানব শহরে হারিয়ে গেলে কারো কিছু আসে-যায় না। মনে পড়ে, ওয়ান-ইলেভেনখ্যাত জান্তা শাসনের সময়ে র্যাংগস ভবন ভাঙতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন এক নির্মাণ শ্রমিক। ভাঙা ভবনে তার লাশ ঝুলেছিল প্রায় ১৫ দিন। কেউ তা নামাতে পর্যন্ত যায়নি। অথচ এও মনে আছে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাটুরিয়া মোড়ের কথা। ৯০ ডিগ্রি বাঁকের ওই সড়কমুখে প্রতিবছর শত শত সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, তবু সেই মরণবাঁক সোজা হয়নি হাজারও দাবিতে, মিছিলে, মানববন্ধনে। তবে হ্যাঁ, ওই বাঁক সোজা হয়েছিল, স্পিডব্রেকার বসেছিল ম্যাজিকের মতো দ্রুততায়, যখন ওই মরণবাঁক কেড়ে নিল দুই সচিবের জীবন, তখন, তার আগে না। মনে আছে, অসংখ্য বাঁক আর ডিভাইডারহীন মৃত্যুফাঁদ ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মিশুক মুনীর, তারেক মাসুদের মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা। তাঁদের মতো মানুষরা মরেছিলেন বলেই ওই মহাসড়কের সব ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকে রোড ডিভাইডার বসেছে, নয়তো বাঁকগুলো সোজা হয়েছে।
এই দেশ কেবল মূল্যবান হয়ে ওঠা মানুষের দেশ। অখ্যাত-অচ্ছুৎ কোনো মানুষের দেশ না। তারা কে কোথায় ঝুলে থাকল, কোন শিশু কবে কোন ম্যানহোল-স্যুয়ারেজের বিষজলে ডুবে মরল তাতে কার কী এসে যায়? কয় টাকা লাগে অমন ভাঙা স্যুয়ারেজ ঢাকতে? কত টাকা লাগে ম্যানহোলগুলোর ঢাকনা লাগাতে? আমাদের জানা নেই। শুধু এটুকু জানি, নীরবদের মতো শিশু, আমাদের মতো মানুষের জন্য অভিজাত এই শহর, এই রাজধানীর চোখে কোনো জল নেই। প্রেম নেই, মায়া নেই। নীরবরা এ দেশে কীটপতঙ্গ। তাই যদি না হবে, তাহলে কেন এমন সীমাহীন উদাসীনতা। শিহাবের মৃত্যুর পরও কেন চার বছর ধরে ভাঙা অবস্থায় পড়ে থাকে পালপাড়া রোডের ওই স্যুয়ারেজ লাইন? কেন আবারো ঠিক ওইখানে মৃত্যু নেমে আসে নীরবের? কে জবাব দেবে? জবাব দেওয়ার কেউ নেই, প্রয়োজন মনে করে না কেউই।
অদ্ভুত এক রাজধানী আমাদের ঢাকা। স্যুয়ারেজ লাইন দেখার দায়িত্ব এক নবাবের, ড্রেনের মালিকানা অন্য নবাবের। ফুটপাত এক জমিদারের তো ট্রাফিক সামলানোর মহাজনী অন্যজনের। দালান বানাবে এক প্রভু, তার ডিজাইন অনুমোদন করবেন আরেক শাহেনশাহ। অসভ্যতারও একটা সীমা থাকে। এখানে তাও নেই। আছে শুধু রশি টানাটানি। নিজের দিকে ঝোল টানা আর কোনো বিপদ টের পেলে তার দায় একজনের কাঁধ থেকে অন্যের কাঁধে ঠেলে দেওয়ার নোংরা খেলা। এটাই হয়তো আমাদের, এই দেশের অলঙ্ঘনীয় নিয়তি। এভাবেই চলবে সব।
নীরবরা এই শহরে হারিয়ে যাবে। মায়ের বুকে মুখ গুঁজে সুখ খুঁজবে না, বাবার আদরের ঘ্রাণ মাতাল করবে না তাদের। বন্ধুরা খেলবে, ঘুরবে, হাসবে, বড় হবে একদিন; কিন্তু নীরব, শিহাব, জিহাদরা সেখানে কোনোদিনই থাকবে না। বন্ধুরা ভুলে যাবে, উৎসুক জনতা ভুলে যাবে, মিডিয়াকর্মী, দর্শক-শ্রোতা সবাই ভুলে যাবে। এত ভুলে যাওয়া দেশ, ভুলে থাকার রাজধানী। কেবল ভুলবেন না নীরব, শিহাবের মায়েরা। বিষকালো জলের অজগর তাদের আমৃত্যু তাড়িয়ে ফিরবে। শ্মশানের হাহাকার চিৎকার করে ছুটবে যন্ত্রণার এক মাঠ থেকে অন্য মাঠে। নিঠুর দুঃখটা রয়ে যাবে এই ভেবে যে, মৃত্যুকালে রবিঠাকুরের ফটিক তো তবুও তার মাকে বলেছিল, ‘মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।’ নীরব কি সে রকম কিছু বলতে চেয়েছিল মাকে? মায়ের মুখটি মনে করে শেষ কথাটিই বা কী ছিল! কচিকণ্ঠের সে আকুতি ওই অন্ধকার স্যুয়ারেজের জলের তলে ডুবে থাকল অনন্তকাল, কেউ জানল না। জানল না তার অভাগী মা।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক