বাহুবলি দেখতেই হবে : শোভা দে

শোভা দে ভারতের প্রতিষ্ঠিত একজন লেখক ও কলাম লেখক। জনসংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়। বহুল আলোচিত বিগ বাজেট ছবি ‘বাহুবলি’ নিয়ে যাচাইয়ের পাশাপাশি বর্ণনা করেছেন এ ছবির দর্শক হিসেবে তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা। এনডিটিভির অনলাইন সংস্করণে গত ২৩ জুলাই, বৃহস্পতিবার লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে।
আমি (একই সঙ্গে পৃথিবীজুড়ে চার হাজার স্ক্রিনে যে অগণিত দর্শক এই ছবিটি দেখেছেন) এসএস রাজামৌলির আড়াইশ কোটি রুপির ম্যাগনাম ওপাস ‘বাহুবলি’র একটা বিষয়ই ‘দেখতে’ পেয়েছি। তা হলো, পয়সাটা কোথায় খরচা হয়েছে সেটা। আগাগোড়া দুর্দান্ত ভিজ্যুয়াল এফেক্টের ঝলকানিতে মোড়ানো এই ছবি। তবে এতকিছুর পর যদি এ ছবিতে ‘গল্প’ খুঁজতে চান, তাহলে আপনার জন্য কেবল ‘সারপ্রাইজ, সারপ্রাইজ’!
ভারতের এখন নিজস্ব আভিজাত্য, রাজকীয়তা আর প্রাচুর্যে ভরপুর রূপকথা রয়েছে। আর যেকোনো স্মরণীয় রূপকথার মতো এতে রাজা-রানি, ক্রীতদাস, দুর্গ, রাজপ্রাসাদ, ঘোড়া, যোদ্ধা, যুদ্ধ, বিশ্বাসঘাতকতা, বীরত্ব, মহত্ব, রাজকুমারী-সবই আছে! কেবল জ্বলন্ত আগুনের মুখখোলা ড্রাগন নেই। তাতে কি, দুশ্চিন্তার কিছু নেই! ছবির এ রকম একটি মুহূর্তও আছে (বলতে পারে ‘অ্যান্ড্রোকলস অ্যান্ড লায়ন’-এর মতো), তবে সেখানে সিংহ নয়, ছিল এক খ্যাপা ষাঁড়! রাজামৌলি নিঃসন্দেহে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেসিল বি ডিমিল-এর ‘স্যামসন অ্যান্ড ডেলাইলা’, ‘দ্য টেন কমান্ডমেন্টস’, ‘ক্লিওপেট্রা’র বিভিন্ন বিষয় পর্যবেক্ষণ করেছেন- আর সেসব থেকে দরকারি উপকরণগুলো নিজের ব্লকব্লাস্টারে আমদানি করেছেন।
আমি হাতের কাছের এক মাল্টিপ্লেক্সে ছবিটা দেখেছি। একেবারেই সাধারণ গোছের, যেখানে মোটামুটি অনেকেই পরিচিত থাকে, বলতে পারেন নাচোসের বদলে বিরতির সময়ে সেখানে ছোলা-মটরের অর্ডারই বেশি হয়। এমনই জায়গায়, সপ্তাহের মাঝামাঝি একটা দিনে, পুরো হল একেবারে ভরপুর। কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হলো, সবারই আমাকে দেখে ভাবখানা এমন হলো যে, আমি ‘এই’ ছবি কেন দেখতে এসেছি! একজন তো এগিয়ে এসে বলেই বসল, ‘তো...এমন ছবি দেখতে তুমি কেন’? আজব কথা! আমি বলতে পারতাম, ‘তো তুমি কেন এসেছ বাপু’! কিন্তু আমি এমন বলিনি, সিনেমা তো সিনেমাই। আমি যদি একেবারে কিছু না জেনেও ছবিটা দেখতে যেতাম, তো খোলা মন নিয়েই যেতাম। ছবি দেখার ভালো উপায় এটাই। আমি ভেবেছিলাম ছবিটা যদি একেবারেই অখাদ্য হয়, তাহলে মনমতো ভেলপুরি খাব, তারপর বাড়ি ফিরে ওল্ড মঙ্কের একটু লার্জ শট মেরে দেব! সে যাই হোক, ছবি শুরুর মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বুঝে গেলাম, জায়গামতোই এসেছি। দারুণ একটা ছবি দেখছি বটে!
বলছিলাম ওই ঝরনার কথা।
ঝরনা গড়ানো খরস্রোতা পানি হলো ‘বাহুবলি’র বিশেষ মোটিফ (ফ্রয়েডের মতো ভাবছেন নাকি? আপনি তো ভীষণ অশ্লীল দেখছি!)। প্রধান চরিত্র, এমনকি প্রধান চরিত্রগুলোর কাছাকাছি চরিত্রগুলোরও ‘ঝরনা দৃশ্য’ রয়েছে। প্রথমার্ধে ‘বাহুবলি’ স্বয়ং, অর্থাৎ প্রভাস ভালোই ভিজেছেন ঝরনায়। আর যখন প্রভাসের বেশ ভালো...উমম্...কী বলব... পেশিবহুল শরীর এখন, কেউ অভিযোগও করছে না। একই রকম দেখা গেল তামান্নার ক্ষেত্রেও। ছবির ন্যারেটিভ জমকালো, রক্তক্ষয়ী, সহিংস যুদ্ধের দিকে এগোনোর আগ পর্যন্ত এমনটাই চলছিল। ঝরনার এমনই মাহাত্ম্য। আমার মনে হয়, রাজ কাপুর যেমন ‘রাম তেরি গঙ্গা মৈলি’তে ঝরনার দৃশ্যে মন্দাকিনীর দেহের বাঁক দেখিয়েছিলেন, তারপরে এ রকম ঝরনার সেক্স-চার্জড দৃশ্য আমার মনে হয় না আর হয়েছে। ঝরনার ভেজাভিজি থামার কোনো লক্ষণই ছিল না, এমনকি মধ্যবয়স্কা মায়েরও (বাহুবলির মা) কোনো ছাড়াছাড়ি নেই!
যা হোক, দর্শকদের কিন্তু একেবারে গেঁথে ফেলল ছবিটা! ভায়োলেন্স আর সেক্স, আর কি চাই! বাহুবলি’র আইটেম গানটাও কিন্তু বেশ চতুরভাবে বানানো, অনেকটা নতুন কৌশল বলা যেতে পারে। দুটো ষন্ডা যুবক (প্রভাস এবং রানা) একজন আরেকজনের সঙ্গে লড়ছে, ব্যাপারটা ভালোই। প্রভাসকে দেখতে রজনীকান্তের তরুণ এবং সুদর্শন একটি সংস্করণের মতো মনে হয়েছে, অন্যদিকে খল চরিত্রে নিজস্ব একটা রূপ ধরতে পেরেছেন রানা দগ্গুবাতি। ছবির একটা বিশেষ দৃশ্য তো মনে করিয়ে দিতেই হয়, কাঁধে এক ‘বিশেষ’ এবং ‘বিশাল’ প্রস্তরখণ্ড কাঁধে নিয়ে চলছেন বাহুবলি। এমন দৃশ্যের অন্তর্নিহিত অর্থ কী হতে পারে? দয়া করে আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না! কী শক্তিশালী দৃশ্য রে বাবা!
‘বাহুবলি’র গল্প এখানেই নয়, ‘দ্য কনক্লুশন’-এ (আমি দেখেছি ‘দ্য বিগিনিং’) শেষ হবে। যে বিষয়টা আমাকে চমকে দিয়েছে তা হলো নারীর বদলে পুরুষালি গ্ল্যামার ব্যবহার করে মেইনস্ট্রিম বলিউডে ছবি বানানো, বিশেষ করে ‘বাহুবলি’র মতো একটা উত্তেজক ছবিতে। প্রভাস আর রানাকে দারুণ লেগেছে। বলিউডের যেকোনো ‘ওভারপেইড’ দুর্বল অভিনেতাদের যেমন আমরা কিছু মাঝারি গোছের ছবিতে দেখি, তাদের মোটেও তেমন দেখায়নি, বরং রীতিমতো নিজেদের চরিত্রে আর কাজকর্মে একদম যুতসই মনে হয়েছে।
প্রেম-ভালোবাসাবাসির গানগুলো হয়তো চাইলে এড়ানো যেত, তবে রোম্যান্সের চিত্রায়ন মন্দ হয়নি, বেশ ক্রিয়েটিভই লেগেছে। ফ্যান্টাসিও বেশ ভালোলাগার মতো। আমি বিশেষ করে বলব রাজমাতার পরনের সেই নয় গজ মাপের শাড়ির কথা, শাড়িটা আমার দারুণ মনে ধরেছে, তবে ওটা পরার মতো সে রকম শরীরের গাঁথুনি হওয়া চাই আপনার!
অন্য কথায় আসা যাক এবার। ছবিটা নির্লজ্জভাবে বর্ণবাদী। নোংরা, ময়লা, বন্য সব যোদ্ধারা বাহুবলির সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে, যাদের সাজগোজ কিনা রীতিমতো রোমান গ্ল্যাডিয়েটরদের মতো। এমনটাই দেখানো হয়েছে, এমনই নগ্নভাবে!
ছবিটা সেক্সিস্টও বটে, তবে আর সব ছবির থেকে বেশি কিছু নয়। এ ছবির নারীরা সাহসী, ক্ষমতাধর, কামনাময়ী! সেই সঙ্গে কঠিন লড়াইয়ে তারা নির্দ্বিধায় নেমে পড়ে, তবে তাদের মেকআপ আর চুলের বাঁধন কিন্তু পরিপাটি থেকে যায় একদম!
হ্যাঁ রে ভাই, বাহুবলিতে রেসিজম আছে, সেক্সিজম আছে, সবই আছে। তবু ছবি ভালো লেগেছে। তো কী করার আছে?
যে মানুষটা আমার মন জিতে নিয়েছে সে বাহুবলি নয়, বাহুবলির অনুগত দাস কাট্টাপ্পা। এ চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেছেন সত্যরাজ। আমি নিশ্চিন্তে বলতে পারি যে বাহুবলি দ্বিতীয় পর্বের জন্য আমি আগাম টিকেট কিনে রাখতে প্রস্তুত, শুধু এরপর কাট্টাপ্পা কী করে তা দেখার জন্য।