প্রতিক্রিয়া
আমার হুমায়ূন

কোনো একটা বিশেষ কারণেই ১৯ জুলাই তারিখটা আমাকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। কারণ এই দিনেই আমরা হারিয়েছি বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি কালপুরুষ আমার, সবার হুমায়ূন আহমেদকে। যখন থেকে বোঝার এবং সাহিত্য পড়ার বয়স হয়েছে, তখন থেকেই দেখছি বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের বীরদর্পে পথচলা। একটা সময় বই বলতে যা বুঝতাম, তা হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ। সেই হুমায়ূন আহমেদ তাঁর দীর্ঘ ৪০ বছরের সাহিত্যচর্চার সমাপ্তি ঘটিয়ে কবে যেন হঠাৎ করেই চিরতরে নির্বাসন নিলেন নুহাশপল্লীর শ্যামল ছায়ার নিচে। তিনি যে চলে গেছেন, মাঝে মাঝে এটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়।
আমার বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হয় মূলত হুমায়ূন আহমেদের লেখা থেকেই। তাঁর লেখা থেকে আমার মতো কত যে পাঠক তৈরি হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এর কারণটা হচ্ছে তাঁর সাবলীল লেখা। একটা কঠিন কথাকে যে কত সহজে প্রকাশ করা যায়, তা মনে হয় হুমায়ূন আহমেদ খুব ভালোই জানতেন। আমি একজন সাধারণ পাঠক, তাঁর লেখা পড়ে আনন্দ খুঁজে পেয়েছি, খুঁজে পেয়েছি গভীর দর্শন। খুব কম সাহিত্যিকই আছেন যাঁরা সহজ কথায় গভীর দর্শন ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ আমার কাছে একটি মিরাকেল। তাঁর লেখা একজন পাঠককে যে কী পরিমাণ সম্মোহিত করতে পারে, তা বুঝতে পারবে তাঁর লেখা একটি মাত্র বই পড়েছেন এমন পাঠকও। তাঁর ‘নন্দিত নরকে’, ‘এই সব দিনরাত্রি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘অয়োময়’ এসব পড়ে তাঁর রেশ এখনো আমার কাটেনি। আজও কানে বাজে হিমুর হিমুর খালি পায়ের আওয়াজ। আজও কাটেনি মিসির আলীর রহস্যের কৌতূহল।
তাঁর বই পড়ে চোখে একটা ঘোর অথবা স্বপ্ন নিয়ে ঘুমুতে যেতাম। হিমুর কর্মকাণ্ড নিয়ে কত যে একা একা হেসেছি। হিমু পড়তে পড়তে হিমুর মতো হতে ইচ্ছে করত। মিসির আলীর একটা উপন্যাস নিয়ে বসলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত উঠে যাওয়া আমার পক্ষে ছিল খুব কঠিন। আমি ছিলাম হুমায়ূন আহমেদের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত-পাঠক। পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে কোনো লেখা প্রকাশ হলেই পড়ে নিতাম সব বাদ রেখে।
ছোটবেলার সেই মেধাবী শামসুর রহমানই যে হয়ে উঠবেন আমাদের আজকের এই হুমায়ূন আহমেদ, তা কে বা জানত। তাঁর লেখালেখির শুরু হয় ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের মাধ্যমে, সমাপ্তি ঘটে ‘দেয়াল’- এর মাধ্যমে। তিনি যে সাহিত্য দেয়াল পেরুতে পারবেন না তা হয়তো তিনি জানতেন না। কিন্তু জীবনের দেয়াল পেরিয়ে ঠিকই চলে গেলেন মৃতুর পারে। তিনি ৪০ বছরে আমাদের উপহার দিয়েছেন ৩৫০টির ওপরে বই। যার প্রতিটি কেড়েছে পাঠকের মন।
ওপার বাংলার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাই বলেছিলেন, ‘শুধুমাত্র লিখেই যে জীবিকা নির্বাহ করা যায়, তা হুমায়ূন আহমেদকে না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব হতো না।’ আমার চোখে তিনি বাংলা গল্প, উপন্যাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কারিগর। তাঁর হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব ঘটেছে সংলাপ প্রধান নতুন শৈলীর। তিনি অনায়াসে ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে পরাবাস্তব ঘটনাবলির অবতারণা করেন, যাকে একরকম জাদু হিসেবে গণ্য করা যায়। তাঁর লেখায় নেতিবাচক চরিত্রও দেখা যায় খুব কম। তাঁর হিমু, শুভ্র, মিসির আলী আজও আমাকে উদ্বেলিত করে। তিনি মানুষ এবং প্রকৃতিকে প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসতেন। তাঁর প্রকৃতি প্রেমের আকট্ট প্রমাণ হচ্ছে তাঁর অসামান্য কীর্তি নুহাশপল্লী, যেখানে তিনি কাটিয়েছেন তাঁর জীবনের শেষের দিকের অনেকগুলো দিন। শেষ আশ্রয়ও হলো এই জায়গাটাই, যা নুহাশপল্লীতে তাঁর ভক্তদের টানবে যুগ যুগ ধরে।
এমন একজন মিশুক, সহজ মানুষের শেষ আশ্রয়ের জন্য অবশ্য এমন একটা মনোরম জায়গাই শ্রেয়, যেখানে তাঁর ভক্তদের দেখা হবে বারবার। তিনি নেই, আছে তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস, তাঁর গায়ের গন্ধমাখা ৯০ বিঘার সেই নুহাশপল্লী।
একটা অবধারিত সত্য যে, হুমায়ূন আহমেদ মানুষের জন্য, বাংলা সাহিত্যের জন্য যা করে গেছেন এর জন্য বাঙালি তাকে যুগ যুগ ধরে মনে রাখবে। নিরদচন্দ্র চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ভালো বাঙালি বলতে যাদের বোঝায়, তারা আসলে আত্মভোলা।’ হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন তেমনি একজন আত্মভোলা মানুষ, একজন ভালো বাঙালি। এমন একজন ভালো বাঙালির প্রস্থানের তিন বছর হয়ে গেল দেখতে দেখতেই। তাঁর প্রস্থান আমার কাছে মৃত্যু নয়, তিনি বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ আমার হুমায়ূন হয়ে।