প্রতিক্রিয়া
এই অস্থির সময় থেকে মুক্তির আর্তি

খুব দ্রুত মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। আমার ছেলেবেলায়—পাকিস্তান শাসনপর্বের শেষ লগ্নের কথা বলছি। খুন বিষয়টি এত সহজ ঘটনা ছিল না তখন। শীতলক্ষ্যার পূর্বপাড়ে নারায়ণগঞ্জ পৌর এলাকা বন্দরে আমাদের বাস। মনে পড়ে, একবার আমাদের বাড়ি থেকে মাইল দুই দূরে কেউ একজন খুন হয়েছেন। বুকে ছুরি মেরে মৃতদেহ রেললাইনের ওপর ফেলে রেখে গেছে আততায়ী। এই সংবাদে সারা এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করতে থাকে। এমন খুনের কথা সহসা শোনা যায় না। মনে পড়ে, দুই-তিন দিন সন্ধ্যার পর রাস্তায় মানুষ চলাচল কমে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর পর মুক্তিযুদ্ধের সূত্রে অনেকের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র রয়ে গিয়েছিল। সে সময় গ্রামগুলোতে আতঙ্ক বিরাজ করত। নিরাপত্তার অভাবে অনেকে গ্রামের ঘরবাড়ি ছেড়ে শহরে চলে আসত। অনেকের সঙ্গে অনেকের শত্রুতার জের ধরে তখন গুপ্তহত্যা বেড়ে গিয়েছিল। একই সূত্রে বেড়ে গিয়েছিল ডাকাতির ঘটনা। এভাবে খুন-রাহাজানি কিছুটা গা সওয়া হয়ে যেতে থাকে।
১৯৭৩-৭৪ সালে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতায় সমাজজীবনে এক ধরনের ভাঙন লক্ষ করা যায়। ১৯৭৫-এর পর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘাত বাড়তে থাকে। আর এভাবেই নষ্ট রাজনীতির হাত ধরে সমাজের নানা ক্ষেত্রে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ একটি দমবন্ধকর অবস্থায় এসে পৌঁছেছি আমরা। রাজনৈতিক সন্ত্রাস অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে। রাজনীতির মঞ্চে পোড়খাওয়া রাজনীতিকদের অবস্থান কেমন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। সে স্থান দখল করে নিচ্ছে অসাধু আমলা আর ব্যবসায়ীরা। কোনো পর্বের সরকারই প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি সুশাসন। ফলে দুর্নীতির থাবায় বন্দি হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। মানবিকতা দ্রুত হারিয়ে ফেলছি আমরা। না হলে একুশ শতকের এই আধুনিক সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে কীভাবে?
বিরোধী পক্ষের আন্দোলন দমনের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে প্রাণ যায় কীভাবে? দিন দিন গুম-খুন যেন একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় মনে হতে পারে, র্যাব সদস্যদের কেউ কেউ এখন টাকার বিনিময়ে ভাড়াটে খুনির ভূমিকায় নামতে দ্বিধা করছে না। ময়মনসিংহে জাকাত প্রদান আয়োজনে ভিড়ের চাপে পদদলিত হয়ে ২৭ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। কিন্তু এ ঘটনার পর দেশব্যাপী কি আমরা তেমন প্রতিক্রিয়া দেখতে পেয়েছি। যেন অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। সিলেটে একটি দশ-বারো বছরের শিশুকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলতে পারে কয়েকজন পাষণ্ড। ভিডিওতে দেখা যায়, যন্ত্রণায় চিৎকার করছে শিশুটি আর হত্যাকারীদের হাসিতে ছড়াচ্ছে কৌতুক। এমনি করে ভয়ংকরভাবে বিপন্ন হচ্ছে মানবতা।
দেশজুড়ে ক্রমাগত ঘটে যাওয়া খুন-সন্ত্রাস নিয়ে পত্রিকার সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় এবং নানা নিবন্ধ-রিপোর্ট কম লেখা হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের কঠোর হুঁশিয়ারি আর পুলিশ কর্মকর্তাদের সাজসাজ রব ও নানা পরিকল্পনার আয়োজন বরাবরের মতোই ফুটো বেলুন হয়ে চুপসে যাচ্ছে। তাবৎ রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রকদের চোখের সামনে বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে খুনি আর সন্ত্রাসীরা। বাস্তব অবস্থা এখন এমন যে, খোদ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশের পেটি অফিসারও যদি সন্ত্রাস দমনের পরিকল্পনা ও কঠোর অবস্থানের ঘোষণা দেন তো, মানুষের চোখে অবিশ্বাসের ছায়া পড়ে।
বিপর্যস্ত সন্ত্রস্ত মানুষ এখন বড় বিপাকে পড়েছে। তারা ঠিক নিশ্চিত হতে পারছে না, এই খুনে দেশের প্রকৃত জিম্মাদার কে? আদিম শিকারি মানুষ একসময় সফল শিকারের নিশ্চয়তা পাওয়ার জন্য নেতৃত্বের প্রয়োজন অনুভব করেছিল। তারা গড়ে তুলেছিল ক্ল্যান সংগঠন, এভাবেই গড়ে উঠেছিল ট্রাইব, পরিবার, রাষ্ট্র সংগঠন ইত্যাদি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে সুশৃঙ্খল করার জন্য এভাবে মানুষ নিজেদের নিয়ম ও পদ্ধতির ভেতর আবদ্ধ করেছে। এই যৌক্তিক চিন্তার পথ ধরে মানুষ হাজার হাজার বছর অতিক্রম করেছে। নতুন নতুন রাষ্ট্রচিন্তা ও পদ্ধতি নিয়ে মানুষ অনেক নিরীক্ষা করেছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের মতো আধুনিক রাষ্ট্র দর্শনের আদর্শ নিয়ে আমরাও পথচলা অব্যাহত রেখেছি। অথচ দুর্ভাগ্য এই যে, আজ বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় একটি ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে দেশে।
রাজধানীসহ সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি এবং তা নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্তদের ব্যর্থতা এখন একটি কঠিন সত্যে পরিণত হয়েছে। অস্থিরতা চলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ছাত্রসংঘাতে বন্ধ হয়ে গেছে বুয়েট, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। অস্থিরতা চলছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আর সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে ভর্তি নিয়ে সরকারি তুঘলকি কাণ্ডে এখনো চলছে অস্থিরতা। সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে নির্বাচিত সরকারের সরব অবস্থানের পরও কেন এই ব্যর্থতা? এর কারণ খোঁজা ও অপনোদনের চেষ্টা না করলে সরকারি সাফল্য অর্জিত হবে না।
মনে রাখতে হবে, যুক্তি যতই থাক, ভালো-মন্দের দায়ভার সরকারকেই নিতে হয়। এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা গণতন্ত্রের চর্চা যত না করেন, ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির উচ্চারণ তার চেয়ে বহুগুণ বেশি করেন। বিরোধী দলগুলোর অবস্থানই থাকে সরকারের বিরোধিতায় অষ্টপ্রহর ব্যস্ত থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার নানা চতুর পথ আবিষ্কারে ঘর্মাক্ত হওয়া। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতিশীল হতে দেখলে তাদের চোখ আনন্দে চকচক করে। সরকারের ব্যর্থতার কথা সরবে প্রচার করার মওকাটি জিইয়ে রাখতে পারলে তাদের স্বস্তি বাড়ে। সরকারপক্ষ মাঝেমাঝে অভিযোগ করে, তাদের নাজেহাল করার জন্য বিরোধী দল সন্ত্রাস আর খুন-খারাবিকে উসকে দিচ্ছে। সময়ের বাস্তবতায় সাধারণ মানুষ এসব অভিযোগ একেবারে উড়িয়েও দিতে পারে না। অন্তত মানুষের কল্যাণচিন্তায় বিরোধী শিবির যে সন্ত্রাস প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছে, তেমন নজির নেই; বরং কোনো না কোনো নামাবরণে রাজনীতির ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসীদের অভয় বিচরণক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
তাই দেখা যাচ্ছে, এ দেশের মানুষকে স্বস্তি দিতে জিম্মাদার হিসেবে ব্যর্থ হচ্ছেন মন্ত্রী, পুলিশ প্রশাসন এবং নানা পক্ষের রাজনীতির ধ্বজাধারীরা। এখন সন্দেহ হচ্ছে, এই তিন পক্ষের কেউ আসলে দেশবাসীকে সন্ত্রাস থেকে মুক্তি দিতে চাইছে কি না। যদি চাইতেন, তবে অপরাধের সংখ্যা হু-হু করে বেড়ে যেত না। আমরা বহুবার বলার চেষ্টা করেছি এবং দেশবাসীরও অজানা নয় যে, খুনি আর সন্ত্রাসীরা এখন অনেকটাই চিহ্নিত এবং এদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা রাজনীতির পরিচয়ে ‘অভিজাত’ ব্যক্তিবর্গ। বর্তমান পরিস্থিতিতেও এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। সুতরাং এ বাস্তবতা সরকারপক্ষ নির্মূল করবে কোন ফর্মুলায়? পুলিশ বাহিনীর অর্থবিত্তে ফুলে-ফেঁপে ওঠার বাস্তবতা যত উজ্জ্বল, অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বাস্তবতা ততটাই নিষ্প্রভ। এ নিয়েও কম লেখা হয়নি। নানা নামধারী সন্ত্রাসী গ্রুপ প্রতিদিন সন্ত্রাস করছে, সদম্ভে মার্চ করছে দেশের বুক চিরে, রক্ত ঝরিয়ে যাচ্ছে ভয়ার্ত মানুষের চোখের সামনে। তবু ওদের টিকি ছুঁতে পারছে না পুলিশ!
কেন পারছে না—আমাদের রাজনীতির বণিকরা যদি ভাবেন যে, সাধারণ মানুষ তো বুঝতে পারছে না, তবে নিশ্চয়ই তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। বাস্তবতা থেকে আমাদের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি হচ্ছে যে নষ্ট রাজনীতির আবর্ত মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমাদের যেন অমানবিক করে ফেলছে। আমরা ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছি অন্ধকারে। বিপন্ন মানুষ এখন কোথায় দাঁড়াবে? সরকারি ও বিরোধী কোনো শিবিরের প্রতিই তো আস্থা রাখার ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কি মুক্তির জন্য কোনো পরম শক্তির আরাধনা করতে হবে আমাদের?
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।