প্রতিক্রিয়া
‘পিটানোর উপর ওষুধ নাই!’

আমার পিতা ক্রিকেটভক্ত নন। তাঁর ধ্যানজ্ঞান ফুটবল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্রিকেট খেলা দেখা ওনার ধাতে সয় না। তাও কালেভদ্রে ক্রিকেট খেলা দেখতে বসলেই একটু পর পরই ওনার এক কথা, ‘পিটায় না কেন’? তাকে এটা বোঝানো বেশ কঠিন যে সব বলেই ‘পিটানো’ যায় না, সব বলে ‘পিটালে’ সবাই আউট হয়ে যাবে। উনি কিছুক্ষণ ‘পিটানোর’ জন্য অপেক্ষা করেন, এর মধ্যে ‘পিটানো’ না চললে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগা বা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সন্ধান করতে হয়।
পিটানোর প্রতি আমাদের জন্মগত টান, আজন্মের সম্পর্ক। আমরা ছোটবেলায় স্কুলে পড়ালেখা করেছি ‘পিটানোর’ ভয়ে। সেখানে পিটানোর কত প্রকার ও কী কী ভ্যারিয়েশন আছে, তা বন্ধুবান্ধবের আড্ডার নস্টালজিয়ায় বারবার ফেরত আসে। কোন শিক্ষক ‘কেমন’ পিটাতেন, ‘কী দিয়ে’ পিটাতেন, কী ‘পরিমাণে’ পিটাতেন, ‘কাদের’ নিয়মিত পিটাতেন ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, এরপর সাইড স্টোরি হিসেবে যোগ হয় পিটানোর সময় তাঁরা কী কী বলতেন বা তাঁদের পিটানি খেয়ে কার কী অবস্থা হতো বা কে কে হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়েছে ইত্যাদি। যে শিক্ষক যত পিটাতেন, তাঁর কাছে ছেলেপুলেও ততই পড়ার জন্য দৌড় দিত- অভিভাবকদেরও লাইন পড়ে যেত সেই শিক্ষকের কাছে সন্তানদের পড়ানোর জন্য।
আমরা বেড়ে উঠি পিটানির সাথে সাথে, পিটানি খেতে খেতে। আমাদের মনেও বদ্ধমূল ধারণা গড়ে ওঠে, ‘ইয়েস, পিটাইতে হবে। এর জন্য আমরা ঘরে পিটাই, রাস্তায় পিটাই, মাঠে ঘাটে পিটাই, কর্মক্ষেত্রে পিটাই, শখে পিটাই, কারণে পিটাই, অকারণে পিটাই। যেকোনো বিষয়ের সমাধানে হোক বা না হোক, আমাদের কাছে ‘ওষুধ’ একটাই। তা হলো, পিটাইতে হবে। তাহলেই সব ঠিকঠাক।
তবে এখানেই একটা বিষয়। আমরা সবাই কিন্তু পিটাইতে পারি না। আবার চাইলেই সবাইকে পেটানো যায় না। ধরুন একটা কাজের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে গেলেন। দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বিকশিত দন্ত প্রকাশ করে বললেন, ‘স্পিড মানি’ না দিলে ‘কাজ’টা হবে না। আপনার কিছু করার নেই, ইচ্ছে করছে লোকটাকে পিটিয়ে কাজটার সমাধা করতে। কিন্তু সেটা যেহেতু আপনি পারলেন না, ‘পিটানি’র খায়েশ বুকে চেপে বেরিয়ে পড়লেন। বৃহত্তম অবদমন বটে! সুতরাং সেটা ঝেড়ে দিলেন রাস্তায় রিকশাওয়ালার ওপর।
মনোবিজ্ঞানে কিংবা মানবিক যোগাযোগে ক্যাথার্সিস বলে একটা শব্দ আছে। সব রাগ, অপ্রাপ্তি, আকাঙ্ক্ষা বা কামনা একটি নির্দিষ্ট মাধ্যম বা চ্যানেলের মাধ্যমে ‘বের’ করে দিলে অবদমিত আকাঙ্ক্ষার ‘ক্যাথার্সিস’ ঘটে! এককালের জনপ্রিয় এ তত্ত্ব রীতিমতো ডাক্তাররাও মানতেন। মানসিক অস্থিরতায় ভোগা মানুষজনদের পরামর্শ দিতেন হেভিওয়েট বক্সিং লড়াই দেখার। এতে নাকি মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভায়োলেন্স অন্য প্রবাহে বের হয়ে যায়। পরবর্তীকালে অবশ্য এ তত্ত্ব টেকেনি, বরং প্রমাণিত হয়েছে যে ভায়োলেন্স কমানোর জন্য সহিংস কিছু দেখা বা কৃত্রিম সহিংসতার আশ্রয় নেওয়া ( যেমন নৃশংস ভিডিও গেম খেলা) কার্যকরী নয়- বরং এটি সহিংস মনোভাব আরো বাড়িয়ে তোলে।
সহিংসতার সাথে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির বিশাল প্রভাব রয়েছে। থার্ড সিনেমা আন্দোলনের প্রথম সারির নির্মাতা ব্রাজিলিয়ান চলচ্চিত্রকার গ্লবার রোচা ‘ক্ষুধার নন্দনতত্ত্ব’ বা ‘অ্যাসথেটিক অব হাঙ্গার’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ক্ষুধার্ত মানুষের পক্ষে সহিংসতাই স্বাভাবিক আচরণ। এই তত্ত্বের প্রয়োগ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন নির্মাতাদের কাজে দেখা যায়। আন্ডারগ্রাউন্ড ফিল্ম মেকারদের প্রিয় একটি মাধ্যম বলা চলে সহিংসতাকে। পিয়ের পাওলো পাসোলিনির ‘সালো অর দ্য হান্ড্রেড টোয়েন্টি ডেইজ অব সডম’ (১৯৭৬) কিংবা মোটামুটি সাম্প্রতিক সময়ে সার্ডিয়ান স্পাসোজেভিকের ‘এ সার্বিয়ান ফিল্ম’ (২০১০) ছবিটির উদাহরণ এখানে দেওয়া যায়। বঞ্চিত, ক্ষুধার্ত বা নিপীড়িত মানুষের আচরণগত বহিঃপ্রকাশ কতটা ভয়াবহ হতে পারে; অথবা একইসাথে ক্ষমতাপুষ্ট মানুষের অত্যাচার, নৃশংসতা বা পারভার্সনের মাত্রা কোন পর্যায়ে যেতে পারে- তার শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ এই দুটি ছবি। সবকিছুর মূলে, অবদমন। আকাঙ্ক্ষা মেটাতে না পারার যন্ত্রণা এবং তীব্র হতাশা।
আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণে জন্ম থেকে আমৃত্যু আকাশ-পাতাল ব্যবধান বজায় থাকে। এ অবস্থায় এ দেশের মানুষের কাছে বহুযুগ ধরে এক পরম আকাঙ্ক্ষা বা নিয়ামক হলো ‘পিটানি’। ‘পিটানি’র মাধ্যমে যাবতীয় বিষয়ের সমস্যা সমাধান করা যায় এ দেশে। মানুষের একটাই চাওয়া, তা হলো পিটানি। কিন্তু এই চাওয়াও তো সবসময় মেটানো সম্ভব হয় না। কারণ চাইলেই যাকে-তাঁকে পিটানো সম্ভব নয়। আবার না পিটাইলেও চলে না। তখন বেছে নিতে হয় দুর্বল কাউকে, যাকে পিটালে সমস্যা নেই। কেউ কিছু বলবে না, বরং সবাই তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখবে, বলবে ‘আরো কইষা দুইটা লাগায় না ক্যান? আর পিটায় না ক্যান’?
১৩ বছরের শিশু রাজন কোনোভাবেই খবরে আসত না, বা এলেও কোনো এক কোণে অবহেলায় পড়ে থাকত। কিন্তু মৃত রাজন আপাতত টক অব দ্য টাউন, কারণ তাকে পিটানোর দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিল মোবাইল ফোনে। অনেকে দেখেছে সেই ছবি, আবার অনেকে বীভৎসতার কারণে পুরো দেখতেও পারেননি। ব্যতিক্রম এখানেই, তা ছাড়া বাকি গল্পটায় কোনো বিশেষত্ব নেই। পিটিয়ে মারার সময় সব সময়ই এমন নির্মম আচরণ, বিকৃত মন্তব্য, ভিক্টিমের বুক ফাটানো কান্না, প্রাণ ভিক্ষা চাওয়া, উৎসুক দর্শকের ভিড়- এসব ঘটে। ‘পিটিয়ে হত্যা’ লিখে গুগলে একটা সার্চ দিন। এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে গুগল আপনাকে প্রায় চার লাখের মতো সার্চ রেজাল্ট এনে দেবে। বলা বাহুল্য, এই কৃতিত্ব সবজান্তা গুগলের সামান্যই, পুরো ক্রেডিটের সিংহভাগ বর্তায় আমাদের ‘পিটানি’পিয়াসী মানুষের। সুতরাং, ব্যস্ত হবেন না, অস্থির হবেন না, এমন তো আমাদের দেশে প্রতিদিনই হয়, আর যা হয় তা তো ভালোর জন্যই হয়, তাই না? পিটানির ওপর ওষুধ নাই, আমরা তো এমনটাই জানি, বিশ্বাস করে সেটা করিও। আপনি, আমি, আমরা সবাই এই হিসেবের বাইরে নই! ভুলে যাওয়া চলবে না, আমরা এমন একটি দেশে বাস করি যার হিসাব-কিতাব এমনই।
দুর্ভাগা এই দেশটির নাম বাংলাদেশ। এখানে একটি অবুঝ শিশুকে কয়েকদিন আগে নিছক বিনোদনের জন্য পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে এবং এরপর পিটিয়ে মারার সেই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে নিপীড়করাই।
লেখক : সাংবাদিক