স্তন ক্যানসার কী, পরীক্ষা যেভাবে করবেন

স্তন ক্যানসারে অনেক নারীই ভুগে থাকেন। তবে কিছু বিষয় খেয়াল রাখলে এই ক্যানসার প্রতিরোধ করা যায়। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৫২১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। বর্তমানে তিনি জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের ক্যানসার ইপিডেমিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরামের প্রধান সমন্বয়কারী।
প্রশ্ন : স্তন ক্যানসার বিষয়টি কী, বাংলাদেশে এর ব্যাপ্তিটা কতটুকু?
উত্তর : স্তন ক্যানসার আসলে শরীরের অন্যান্য অঙ্গের ক্যানসারের মতো। মূল বিষয়টি একই। আমাদের শরীরে অস্বাভাবিকভাবে যদি কোনো কোষ বিভাজন সৃষ্টি হয়ে যায় কোনো কারণে এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোষ যদি শরীরের এক জায়গায় চাকা বা পিণ্ডের মতো হয়ে যায়, তাকে আমরা টিউমার বলি। এই টিউমার দুই রকম। একটি হলো বিনাইন টিউমার, যাকে আমরা কম ক্ষতিকর বলতে পারি। যে অঙ্গে বা যে টিস্যুতে এই বিনাইন টিউমারটা শুরু হয়, যত বড়ই হোক না কেন ওই অঙ্গের ভেতরই থাকবে। এর বাইরে সে যাবে না। অন্য কোনো অঙ্গে ছড়াবে না। রক্তের মাধ্যমে কোনো জায়গায় যাবে না। একে আমরা বলি কম ক্ষতিকর। আর আরেকটি যে টিউমারের ধরন রয়েছে, একে আমরা বলি ম্যালিগনেন্ট টিউমার। মানে উৎপত্তি যেখানে হোক, আকারে ছোট না বড় সেটা বড় কথা নয়, তবে তার প্রকৃতিটা হবে তার আশপাশের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, লসিকানালি বা গ্ল্যান্ডগুলো আক্রান্ত করতে হবে। এটি রক্তের প্রবাহের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে গিয়ে দূরের অঙ্গে চলে যাবে। একে মেটাস্টিটিস বলি। এই হলো টিউমার আর ক্যানসার।
স্তন ক্যানসারের বেলায়ও বিষয়টি তাই। স্তনেও এ রকম চাকা বা পিণ্ড হতে পারে। এর মধ্যে বেশ কয়েক রকম টিস্যু আছে। এখানে হতে পারে। সেগুলো বিনাইন হতে পারে, যে এগুলো কখনো ছড়াবে না। সেগুলোকে আমরা বলি বিনাইন টিউমার। আর ম্যালিগনেন্ট টিউমার যেটা স্তন ক্যানসারে আমরা বলি, এর বৈশিষ্ট্য হলো ছড়িয়ে পড়তে পারে শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। এ জন্য এটি মারাত্মক।
এই স্তন ক্যানসারের যে ব্যপ্তি, সারা পৃথিবীতে যদি আমরা বলি নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়, স্তন ক্যানসার। বাংলাদেশ সম্বন্ধে যে আন্তর্জাতিক সংস্থা, যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত, আইআরসি বলি আমরা, তারা যে হিসাবটা আমাদের দেয়, এক লাখ ২২ হাজার মানুষ প্রতিবছর নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়, প্রায় ৯১ থেকে ৯২ হাজার মারা যায়, এর মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয় নতুন করে, সাত হাজারের একটু বেশি মারা যায়। এই যে হিসাবটা এটি অবশ্যই খুব গুরুত্ব দিয়ে আমাদের দেখা দরকার।
প্রশ্নটা হলো সচেতনতার কথা আমরা কেন বলি? আমরা একটি গবেষণা করে দেখেছি, সারা বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি যত হাসপাতাল আছে, মাত্র ৩০ হাজার রোগী এখানে চিকিৎসা নেয়। সম্পূর্ণ পদ্ধতির মধ্যে। এক লাখ ২২ হাজারের মধ্যে বাকি রোগী তাহলে কোথায় যায়? তার মানে বিরাট একটি সংখ্যা হারিয়ে যায়। কোথায় হারায় তারা? অনেকেই জানেই না, সচেতনতা নেই, তারা এই রোগ নির্ণয়ে পদ্ধতির মধ্যে আসে না, এভাবেই হয়তো গোপন রাখে। এর মধ্যে কিছু কিছু আবার হয়তো অর্থাভাবে বা আমাদের ক্যানসার চিকিৎসার কিছু কিছু পদ্ধতির অভাবে যার জন্য অনেকে হয়তো আর চিকিৎসার জন্য যায় না।
সেই জন্যই আমরা বলি আমাদের সচেতনতা দরকার। অনেকেই মনে করেন সচেতনতা মানে হলো কী খাবেন না, আর কী করবেন ইত্যাদি। তবে আসলে বিষয়টি এত ছোট নয়। আমাদের সাধারণ মানুষকে বলতে হবে, স্তন ক্যানসার একটি নীরব ঘাতক। আবার এটা প্রতিরোধযোগ্য। আবার একটু যদি সচেতন হই, খুব সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। আর কিছু পদ্ধতি হলো যেগুলো আমরা জীবনযাপনের মধ্যে পরির্বতন আনতে পারি। অন্তত কিছু ক্ষেত্রে প্রাথমিক প্রতিরোধ সম্ভব। এগুলো আমাদের বলা দরকার- এক নম্বর।
দুই নম্বর হলো, রোগ নির্ণয়। স্তন ক্যানসারের কিছু লক্ষণ আছে, খুব সাধারণ কিছু লক্ষণ। স্তনে যদি কোনো চাকা বা পিণ্ডের মতো অনুভব হয়, পাশে যে বগলতলা যাকে আমরা গ্ল্যান্ড বলি, এগুলো যদি আক্রান্ত হয়, চামড়ার মধ্যে যদি কুঁচকানো বা কমলা লেবুর খোসার মতো গায়ে যদি ছোট ছোট গর্ত থাকে, এ রকম যদি কিছু হয়, যদি বোঁটা দিয়ে কোনো রক্ত বা কষ বের হয়, এই ধরনের কিছু পরিবর্তন, যেগুলো আমরা সাধারণভাবে ব্যাপক মানুষকে বলতে পারি, তার লজ্জার সংকোচের বিষয়টি দূর করতে পারি, তারা এগুলো যদি জানতে পারেন, তাহলে তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের কাছে গেলে ফলাফল ভালো হবে।
আর তারও আগে আমরা স্ক্রিনিং করতে পারি। কোনো লক্ষণ এখনো পর্যন্ত দেখা দেয়নি। তবুও ঝুঁকি থাকে। যদি এ রকম ঝুঁকি থাকে কারো, তাহলে তাঁরা আগে থেকেই সচেতন হবেন। লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগে থেকেই একটি নির্দিষ্ট বয়স থেকে তাঁরা চেষ্টা করবেন, স্ক্রিনিং-এর আওতায় আসতে। স্ক্রিনিং বলতে মানুষের মনে একটি ভুল ধারণা আছে, না জানি বিষয়টি কত কঠিন?
স্তন ক্যানসারের স্ক্রিনিং-এর তিনটি পদ্ধতি। উন্নত দেশে ম্যামোগ্রাম নামে একটি বিশেষ এক্সরে আছে। খুব সূক্ষ্ম পরিবর্তন হলেও সেখানে ধরা পড়ে। আরেকটি জিনিস হলো ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন। ডাক্তার বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীকে দিয়ে আমি অন্তত আমার স্তনটি পরীক্ষা করাব। আর তিন নম্বরটি হলো নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা। একজন নারী যদি প্রতি মাসে, একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মে তার স্তন যদি পরীক্ষা করে তাহলে যদি প্রথমবার নাও বোঝেন, পরে কোনো পরিবর্তন হলে উনি টের পাবেন। তখন চিকিৎসকের কাছে গিয়ে দেখবেন আসলে তেমন কিছু নয়। পরামর্শ দেবেন। আর না হলে পরে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। এতে তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে। এই দুটো জিনিস কিন্তু সচেতনতার মধ্যে আনতে হবে।
এরপর আসি চিকিৎসার বিষয়ে। সচেতনতা ওখানেও দরকার। অনেকে অনেক কষ্ট করে রোগ নির্ণয় করার পরেও বলে যে ‘আমার আম্মার তো স্যার চিকিৎসা করাতে পারলাম না। গ্রামের সবাই বলে চুল পড়ে যাবে। আমার মা রাজি হচ্ছে না। কোনটা আগে দরকার। জীবন বাঁচানো না চুল? জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে যখন একটি সুতার মতো, যার ওপর দিয়ে মানুষ চলে, তখন কি আমি চুলের চিন্তা করব, এই পরামর্শটাও একটি সচেতনতার বিষয়।
চুল যে পড়ে, সব ওষুধের জন্য পড়ে না। কিছু কিছু ওষুধের জন্য পড়ে। যখনই ওষুধটা বন্ধ হয়, মানে কেমোথেরাপি বন্ধ হয়, আবার চুল গজায় এবং ঘন হয়ে গজায়। এই বিষয়গুলো নিয়েই আমাদের ক্যানসার চিকিৎসা। শুধু এই খাবেন না, এই করবেন না, এগুলো আসলে সব নয়।