গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের চিকিৎসা কী

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে মাকে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হয়। গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে এর চিকিৎসা কী হবে -এ নিয়ে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৩৪৩ তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. শারমিন আব্বাসি শাতাসনীম আরা। বর্তমানে তিনি আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজের প্রসূতি ও ধাত্রী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন।
প্রশ্ন: একজন মা গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হয়েছে জানতে পারলে তার করণীয় কী হবে?
উত্তর: আগে আমাকে খুঁজে বের করতে হবে, সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কি, আক্রান্ত না। এখন হয়তো একটি প্রশ্ন আসতে পারে, আমরা একে কখন খুঁজবো বা খুঁজে বের করবো। সেক্ষেত্রে রোগীর ইতিহাস নিয়ে ভাগ করে ফেলতে হবে যে ডায়াবেটিসের জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ, না কি ঝুঁকিপূর্ণ না।
যদি ডায়াবেটিসের জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হয়, তাহলে রোগী যখনই দেখাতে আসবে, এটি হতে পারে তার এক মাস, দুই মাস, বা তিন মাস গর্ভাবস্থার সময়, অথবা মাঝখানের সময়, অথবা শেষের সময়, যখনই আসুক, তখনই আপনাকে ওজিটিটি করতে হবে। ওজিটিটি মানে ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট। এক্ষেত্রে ১২ ঘণ্টা না খেয়ে থাকবে, প্রথমে একটা রক্তের নমুনা নেব, প্রস্রাব নেব। তাকে আমরা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়াবো, ৩০০ এমএল স্বাভাবিক পানিতে। খাওয়ানোর দুই ঘণ্টা পর আমরা আবার তার রক্তের নমুনা নেব ও প্রস্রাবের নমুনা নেব।
এক্ষেত্রে যদি আমরা কখনো দেখি খালি পেটে থাকার সময়ের পরীক্ষাটা ৬.১ এর উপরে এবং গ্লুকোজ খাওয়ার পর মাত্রাটা ৭.৮ এর ওপরে তাহলে আমরা প্রথমে নির্ণয় করতে পারি সে জিডিএম এ আক্রান্ত। তার এখন ডায়াবেটিস হয়েছে। উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হলে এই বিষয়টি।
তাহলে কম ঝুঁকিপূর্ণ যারা, তাদের ক্ষেত্রেও আমর নিয়মিতভাবে ওজিটিটি করতে পারি। ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহ যখন গর্ভাবস্থার সময় তখন পারি। সেক্ষেত্রে আমরা রুটিনমাফিক একটি ওজিটিটি করতে পারি। সেটা করে আমরা বুঝতে পারি তার ডায়াবেটিস আছে কি না। আর ডায়াবেটিস যদি হয়ে যায়, তাহলে আমাকে চলতে হবে শৃঙ্খলার পথে।
শৃঙ্খলা মানে তিনটি ‘ডি’। ডায়েট (খাদ্যাতালিকা), ডিসিপ্লিন (নিয়মানুবর্তিতা) ও ড্রাগ (ওষুধ)। এক্ষেত্রে আমরা তার ওজন, তার উচ্চতার দেখে বলে দিই সে কতো ক্যালোরি খাবে। সেখানে আমরা ভাগ করে দিই।
সাধারণত আমরা বলি, তিনটি প্রধান খাবার এবং তিনটি স্ন্যাকস। তিনটি বড় খাবার খাবেন, তার সাথে তিনটি স্ন্যাকস খাবেন। এর মানে ছয়টি খাবার দিয়ে আমরা মোটামুটিভাবে চেষ্টা করি তাকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ডায়েট দেওয়ার জন্য। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি, শাকসবজি এবং ফল খেতে হবে। এটি তার জন্য থাকবে। এরপর আমরা আসি শৃঙ্খলার বিষয়ে। সাধারণত সে তো ব্যায়াম করতে পারবে না। আমরা বলি, আপনি ১০ মিনিট, ১৫ মিনিট করে করে একটু হাঁটেন এবং পাশাপাশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা খুব জরুরি। কী করতে হবে? বলতে হবে, মা আপনার যেন কোনো সংক্রমণ না হয়। দাঁতের যত্ন নিতে হবে। পায়ের যত্ন নিতে হবে। সার্বিক একটি পরিচ্ছন্নতা আপনাকে মেনে চলতে হবে।
শেষে রয়েছে ওষুধ। যখন এগুলো করেও আমরা দেখি যে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। তখন আমরা ওষুধ দিতে পারি। আগে অনেক সময় বলা হতো, গর্ভাবস্থায় মুখে ওষুধ দিতে পারবো না, তাতে বাচ্চার ক্ষতি হবে। কিন্তু এখন সারাবিশ্বেই বলা হয়, মেটফরমিন জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। গর্ভাবস্থায় এগুলো দেওয়া যাবে। এগুলো নিরাপদ। আমাদের রোগীদের দিয়ে দেখেছি যে কোনো সমস্যা হয় না। তবে ওষুধ খাওয়ার পরও যদি ভালোমতো নিয়ন্ত্রিত না হয়, তখন আমরা ইনসুলিনের দিকে যাই।
প্রশ্ন: ওজিটিটি ছাড়া আর কী কোনো পরীক্ষা আছে?
উত্তর: রোগ নির্ণয়ের জন্য তো আমরা ওজিটিটি করবো। তবে যার সময় নেই, জানি না রোগীটা পরে আসবে কি আসবে না, সেই রোগীটার জন্য আমাদের ডাব্লিউএইচও একটি নিয়ম করে দিয়েছে।
আমরা গ্লুকোজ চ্যালেঞ্জ পরীক্ষা তাকে করতে পারি। অর্থাৎ যেই মুর্হূতে সে এল, আগে খেয়েছি কী খায় নি আমি জানি না। ৫০ গ্রাম গ্লুকোজ আমি খাইয়ে দিব। খাইয়ে দেওয়ার দুই ঘণ্টা পর আমি দেখবো রক্তের শর্করার মাত্রা কত। এটা যতি ৮.১ এর ওপর হয়, আমরা বলি, যে তার ডায়াবেটিস আছে। এছাড়া রোগী ধরেন আপনার কাছে গর্ভাবস্থার তিন মাস কী চার মাস পরে এল, এখন আপনি কীভাবে বুঝবেন তার কী একেবারে প্রথম মাস থেকে ডায়াবেটিস আছে কি, নেই। এটাতো আমাকে জানতে হবে।
সেটা জানার জন্য আমরা হিমোগ্লোবিন এওয়ান সি পরীক্ষা করতে পারি। এই মাত্রা যদি ৬.১ এর বেশি হয়, আমরা ধরেই নেই আগের এক অথবা দেড় মাস সময় তার ডায়াবেটিসটা নিয়ন্ত্রণে ছিল না।
এছাড়া আমরা অবশ্যই একটি আল্ট্রাসোনোগ্রাফি অব প্রেগনেন্সি প্রোফাইল করবো এবং বিশেষ করে আমরা এটা করবো গর্ভাবস্থার ২১ থেকে ২২ সপ্তাহের মধ্যে। কেন করবো? কারণ, ডায়াবেটিস যাদের হয় তাদের বাচ্চাগুলোর এক ধরনের বিকলাঙ্গতা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কনজেনিটাল এনোমালি স্ক্যান বলে একটি পরীক্ষা রয়েছে এটি করে আমরা দেখে নেবো বাচ্চার পা থেকে মাথা পর্যন্ত কোনো ত্রুটি আছে কি না।
প্রশ্ন: আপনি বলছিলেন ওজনের বিষয়টি বেশি পাওয়া যাবে। এই বিষয়টি কী?
উত্তর: স্বাভাবিক যে অবস্থায় বাচ্চাটির বড় হওয়া উচিত, এর থেকে যদি বেশি সে বড় হয়, তাকে আমরা বলি ম্যাক্রোসোমিক শিশু বা বড় শিশু। এর মানে বাচ্চাটা যেমনভাবে থাকা উচিত, এর থেকে অনেক বড়। যেমন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা চিন্তা করি, গর্ভাবস্থার শেষে বাচ্চার ওজন হয়তো আড়াই বা তিন কেজি হবে। এই বাচ্চাগুলো দেখা যায় তিন কেজির বেশি হয়। সেই ক্ষেত্রে বিষয়টিকে আমাদের ভালোভাবে দেখতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো, পলিহাইড্রেমিয়ান্স। মানে মায়ের পেটে যতটুকু পানি থাকা উচিত, তার থেকে অনেক বেশি হয়ে যায়। তো এই সবগুলো বিষয় আমরা পর্যালোচনা করে দেখতে পারি বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে।