গর্ভপাত ও পরবর্তী জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা

গর্ভপাত বা প্রসব-পরবর্তী সময়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। নয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভাবস্থা হতে পারে। এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৩২০তম পর্বে গর্ভপাত এবং এর পরবর্তী জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন ডা. লুৎফা বেগম লিপি। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রসূতি ও ধাত্রী বিভাগের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : গর্ভপাতজনিত সমস্যায় কী ধরনের রোগী আপনারা বেশি পেয়ে থাকেন?
উত্তর : গর্ভপাতের বিভিন্ন ধরনের রোগী আমরা পাই। অনেকের কোনো কারণ ছাড়াই গর্ভপাতের সমস্যা হতে পারে। যেটা গর্ভাবস্থার যে কোনো সময়ই হতে পারে। আর কিছু কিছু রোগী আমরা পাই, অনেকে আনওয়ানটেড প্রেগনেন্সি (অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ) রাখতে চান না। তখন দেখা যায় তাঁরা গর্ভপাত করিয়ে থাকেন। হয়তো অনেকে অসচেতন বা অদক্ষ হাতে করেন। অনেক সময় তাঁরা সেপটিক অ্যাবোরশন নিয়ে আসেন। এ সমস্ত রোগীকে আমাদের বেশি ব্যবস্থাপনা করতে খুব হিমশিম খেতে হয়।
প্রশ্ন : গর্ভপাতের ঝুঁকিগুলো নিয়ে একটু বলুন।
উত্তর : এটি নির্ভর করবে কত মাস সে গর্ভাবস্থায় ছিল এর ওপরে। যদি প্রাথমিক অবস্থায় গর্ভপাত হয়, তখন রক্তপাতের ঝুঁকি বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। তবে যতই তার গর্ভাবস্থার সময়টি বাড়তে থাকে, তত তার রক্তপাতের সময় অতিরিক্ত ক্ষরণ, সংক্রমণ এগুলো বাড়ার ঝুঁকি থাকে।
আগে দেখা যেত গর্ভপাতের কারণে অনেক বেশি মৃত্যু হতো। তবে দিনে দিনে জিনিসটি কমে আসছে।urgentPhoto
প্রশ্ন : গর্ভপাত করাতে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে?
উত্তর : গর্ভপাত করানোর অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন, হয়তো একজন ছাত্রী, সে বৈবাহিক জীবন শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো সন্তান ধারণ করল, সে গর্ভপাত করাতে চাইতে পারে। যেহেতু সে জন্ম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা সম্বন্ধে ভালো করে জানত না তাই অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভাবস্থা হয়তো হয়েছে। আবার দেখা যায় কিছু মেডিকেল ডিজঅর্ডার আছে, এগুলোর ক্ষেত্রে গর্ভধারণ করলে তার জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে, তখন গর্ভপাত করানো হতে পারে।
আবার অনেক সময় দেখা যায় কিছু ত্রুটিযুক্ত শিশু হলে, যেহেতু এই বাচ্চাগুলো বাঁচবে না তখন মায়েদের গর্ভপাত করাতে হয়।
এ বিষয়ে মায়েদের ক্ষেত্রে একটি কথা বলার থাকবে তারা যেন এমন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গর্ভধারণ না করে। সেই জন্য তাকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আবার কিছু সামাজিক সমস্যার জন্য কিন্তু এমন অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত হতে পারে।
গর্ভপাতের জন্য যদি দক্ষ চিকিৎসকের কাছে যাওয়া হয়, তাহলে গর্ভপাতের রেশ ধরে যে সমস্যা হয়, যেমন : সেপটিক অ্যাবরশন শক, সংক্রমণ এগুলো হয়তো বা হবে না। মায়ের মৃত্যু হবে না।
প্রশ্ন : গর্ভপাত বা প্রসবের পরে যদি কেউ জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চায়, সে ক্ষেত্রে ব্যবস্থা কী হবে?
উত্তর : প্রত্যেকটি মা যখন অ্যাবোরশন করায় বা প্রসব হয়, আমরা এখন জোর দিই তার জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর। যেন শিশু অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত আবার না হয়। অনেক সময় দেখা যায় ছোট একটি বাচ্চাকে নিয়ে সে আরেকটি গর্ভাবস্থা নিতে চায় না। আবার দেখা যায়, কোন জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তার জন্য উপযুক্ত সেটা সে বুঝতে পারে না। আমরা বলি, যেদিন তার অ্যাবোরশন হবে সেদিন থেকে সে যেকোনো পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে। যদি সে স্বল্পমেয়াদি বিরতি চায় সে ক্ষেত্রে খাওয়ার ওষুধ ব্যবহার করতে পারে, কনডম ব্যবহার করতে পারে। আবার তিন মাস মেয়াদি যে ইনজেকশন রয়েছে সেটি দিতে পারে।
যদি কেউ চায় এখনই বাচ্চা নেব না, দীর্ঘমেয়াদি একটি ব্যবস্থা নেবে, এ ক্ষেত্রে ইমপ্লেনন আছে। এটি কাঠির মতো, হাতে আটকে দেওয়া হয়। সেটি তিন বছর মেয়াদেরও আছে। পাঁচ বছর মেয়াদেরও আছে। আরেকটি আছে জরায়ুতে আমরা প্রতিস্থাপন করে দিই একে কপার-টি বলা হয়। এটি ১০ বছর সুরক্ষা দেবে। এটি নন হরমোনাল পদ্ধতি। এতে হরমোন নেই। মায়েদের মুটিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। রক্তচাপ বাড়ার আশঙ্কা নেই। অনেক সময় এই জটিলতাগুলো দেখা দেয়। সবারই উচিত একটি জন্মনিয়ন্ত্রক পদ্ধতি ব্যবহার করা। কারণ গর্ভপাতের পর অষ্টম দিনের মাথায় ওভুলেশনের আরেকটি চক্র হতে পারে। মানে ডিম ফুটে যেতে পারে। তাই সে যদি ব্যবস্থা না নেয়, দেখা যায় পরবর্তী ঋতুস্রাব হওয়ার আগেই একটি গর্ভধারণ হচ্ছে।
প্রশ্ন : জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কোনটি কার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে সেটি নিরূপণ করেন কীভাবে?
উত্তর : বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা যেমন অনেক সময়ন মাইগ্রেন থাকে, জটিল ধরনের মাথাব্যথা থাকে, কার্ডিয়াক কিছু সমস্যা থাকে, তাদের মুখের খাওয়ার পিল আমরা এড়িয়ে যেতে বলি। সে ক্ষেত্রে নন-হরমোনাল আইওসিডি উপযুক্ত। আবার অনেকে দেখা যায় একটি বাচ্চার পর তিন চার বছর নেবে না। তাদের ক্ষেত্রে ইমপ্লেনন যেটি আমরা বলছি, সেটা তার জন্য উপযুক্ত।
আরেকটি বিষয় রয়েছে, যারা তরুণ, একদমই নতুন বিয়ে করেছে, ক্যারিয়ার গড়তে চায়, লেখাপড়া শেষ করতে চায়, একটি লম্বা বিরতি নিতে চায়, তাদের ক্ষেত্রে পিল খাওয়া সমস্যার হয়ে যায়। পড়ালেখার মাঝখানে দেখা যায় পিল খেতে সে হয়তো ভুলে যায়। সেই সমস্ত ক্ষেত্রে ইমপ্লেনন নিরাপদ। ইমপ্লেনন তিন বছরের সুরক্ষা দেবে। পরবর্তী সময়ে বাচ্চা নেওয়ার সময়ও তার সমস্যা হবে না। কাজেই সে সহজে তিন বছরের জন্য একটি নিশ্চিন্ত জীবন পাচ্ছে।
প্রশ্ন : জন্মনিয়ন্ত্রক পদ্ধতির কি কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে?
উত্তর : আসলে যে কোনো ওষুধের মধ্যেই তো কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। সেটা আসলে আমাদের বুঝতে হবে। যেমন ওষুধ খাওয়াতে আমাদের অনেক অনীহা। প্রতিদিন খেতে হবে। মাথা ব্যথা করে, মাথা ঘোরে, বমি বমি ভাব হয়, মোটা হয়ে যায়। এই সমস্ত সমস্যার কারণে অনেকে ওষুধ খেতে চায় না। আবার কপার-টি দেওয়া হবে, এতে জরায়ু অনেক সময় ফুটো হয়ে যায়, স্বামী পছন্দ করছে না-এ ধরনের কিছু সমস্যা থাকে। এ থেকে ভালোভাবে যদি রোগীকে পরামর্শ দিই তখন কিন্তু অনেক সময় পরিত্রাণ পেয়ে যায়। একটি ওষুধ নতুন এসেছে যেটি খেলে মোটা হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। এটি ব্যবহার করতে পারে। হার্টের সমস্যা থাকলেও সে সুরক্ষা দেয়। আর যে হরমোনাল পদ্ধতি চাচ্ছে না, তাদের ক্ষেত্রে আমরা কপার-টি করতে পারি। দক্ষ হাতে যদি কেউ কপারটি পরে, এটি ১০ বছরের জন্য সুরক্ষা দেবে এবং হরমোনের জন্য তার কোনো জটিলতা হবে না। এতে সে ভালো থাকবে।
প্রশ্ন : এই দক্ষ হাত কোথায় পাবে?
উত্তর : এখন সরকারিভাবে বিভিন্ন মডেল ক্লিনিক থাকে, এই ক্লিনিকগুলোতে সবাই দক্ষ। এখানে সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
আগে যেমন পরিবার পরিকল্পনায় জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাগুলো দিত। এখন স্বাস্থ্য সেক্টরে যারা কাজ করি, তারাও কিন্তু এই ইমপ্লেনন, কপার-টি করার জন্য আমরাও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
স্বাস্থ্য সেক্টরের যখন কোনো অ্যাবোরশন পাই তখন কিন্তু দক্ষ হাতেই বিষয়টিকে ব্যবস্থা করে থাকি। আবার প্রসবের পরপর এখন কপার-টি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সিজারের সময়ই আমরা অনেক সময় কপার-টি করে দিচ্ছি। এতে আর পরবর্তী সময়ে আসতে হচ্ছে না। আমরা সব বের করে পরিষ্কার করে কপার-টি লাগিয়ে দিয়ে সেলাই দিয়ে দিই। আবার স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রেও কিন্তু এটি করা হয়। একই সঙ্গে সে কিন্তু দুটো সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে।