নারীর মেনোপজ জটিলতায় করণীয়

মেনোপজ বা ঋতুস্রাব একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়া নারী শরীরের একটি স্বাভাবিক সমস্যা। বয়স হলে সব নারী দেহেই এই প্রাকৃতিক বিষয়টি ঘটে। তবে এতে ঘাবড়ে না গিয়ে কিছু বিষয় মেনে চললে এই সময়টিকে অতিক্রম করে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব।
আজ ৭ অক্টোবর, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৬৭তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন শিকদার মহিলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান ডা. জিনাত আরা নাসরিন।
প্রশ্ন : মেনোপজ বিষয়টি বলতে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : মেনোপজ হচ্ছে একটি সন্ধিক্ষণ, একটি ক্রান্তিলগ্ন। এ সময় একজন নারীর মাসিক বন্ধ হয়ে যাবে এবং সে নতুন জীবনে পদক্ষেপ রাখবে। তার চলার পথে শৈশব, কৈশোর, যৌবন অতিক্রম করে আরেকটি অধ্যায় শুরু হবে। মেনোপজ একটি খুব স্পর্শকাতর বিষয়। যখন আর মাসিক হবে না, সে একটি পরিপক্ব মানুষে পরিণত হবে।
প্রশ্ন : মেনোপজের সময় কী ধরনের জটিলতা হতে পারে?
উত্তর : আমি আগেই বলেছি, এটি একটি ক্রান্তিলগ্ন। এ সময় শরীরে অনেক পরিবর্তন হয়। এটা প্রাকৃতিকভাবেই হয়। এ সময় কিছু কিছু উপসর্গ বা সমস্যা হয়। সবাই যে এই উপসর্গগুলোতে ভোগেন, সেটি নয়। তবে কিছু নারী আছেন, যাঁরা এর উপসর্গে অতিরিক্তভাবে ভুগে থাকেন। সেগুলো মধ্যে রয়েছে, যেমন : হট ফ্লাস, এখানে খুব গরম লেগে যায়, ঘেমে যায়, কাজ করতে পারে না, অনেকে রান্নাঘরে ঢুকতে পারছেন না, হঠাৎ করে ভিজে একদম ঘেমে যাচ্ছেন—এ রকম সমস্যা হয়। এটি খুব বিব্রতকর অবস্থা।
তার পর আরেকটি হলো ভুলে যাওয়ার সমস্যা। কোথায় চাবি রেখেছেন, কোথায় চশমা রেখেছেন—এগুলো ভুলে যাচ্ছেন অহরহ।
এরপর মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, একটু বিষণ্ণতা এটি আরেকটি সমস্যা। হয়তো তাঁর বয়স হয়ে গেছে, চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন, অথবা জীবনের একটা অংশ এসেছে যার মুখোমুখি কখনো হননি, মেনে নিতে পারছেন না বিষয়টিকে সহজভাবে, বাচ্চারা বড় হয়েছে, ঘরটা খালি হয়ে গেছে, অনেক সময় স্বামী হয়তো অসুস্থ রয়েছেন—এসব নানাবিধ কারণে বিষণ্ণতা হয়।
এ ছাড়া একটু বদহজম হয়, একটু ওজন বেড়ে যায়, ঘুম আসে না—এগুলোও ছোটখাটো সামান্য উপসর্গ এ সময়।
প্রশ্ন : এই সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের উপায় কী?
উত্তর : আমাদের দেশের নারীরা অত্যন্ত সহিষ্ণু। তাঁরা ভেবেই নেন যে আমার মেনোপজ হয়েছে, এগুলো আমার হবেই। আমার এর জন্য কোনো প্রতিকার নেই। আপন মনে, নিভৃত মনে তাঁরা কষ্ট করেন। এবং তাঁরা জানেনও না, এর প্রতিকার রয়েছে। সুতরাং মেনোপজ নিয়ে সমস্যায় রোগী আমরা খুব একটা পাই না। যখন অন্য অসুখ নিয়ে আসে, প্রশ্ন করি, তখন বুঝতে পারি মেনোপজ তাকে কী চরমভাবে আক্রান্ত করেছে। তাই সব নারীর জানা উচিত, এসব সমস্যার প্রতিকার রয়েছে। তবে হ্যাঁ, যদি সুন্দরভাবে বিষয়টির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন, সেটা ভিন্ন জিনিস।
প্রশ্ন : এই যে শারীরিকভাবে একটি প্রাকৃতিক পরিবর্তন আসছে, সেটা যেন পুরোপুরি মানসিকভাবে মেনে নিতে পারে সে জন্য আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
উত্তর : মেনোপজ হলো প্রাকৃতিক একটি উপহার। এটাকে আমাদের স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে হবে। তবে এ সময় এসব উপসর্গ বেশিও হতে পারে, আবার কমও হতে পারে। তার জন্য সচেতন হয়ে আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে।
কীভাবে? যখন মেনোপজ হবে, প্রথমে তাকে মানতে হবে এটা প্রাকৃতিক একটি বিষয়। এতে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এই জীবন চর্চায় আমি যেন ফিট থাকতে পারি, সে জন্য কাজ করতে হবে। কেননা, যত বয়স বাড়বে, অন্য অসুখগুলো তো আসবে, মেনোপজ তো একা নয়। আশপাশে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস সকলেই এসে উঁকি দিতে পারে।
এটা মনে রাখতে হবে, বিষয়টি প্রাকৃতিক। এতে কোনো অপকার নেই; বয়সকালে হবেই। এটাকে মেনে নিতে হবে, এক। দ্বিতীয়ত, আমাদের খাদ্যাভ্যাস একটু পরিবর্তন করতে হবে। আগে যেমন বেশি খেতাম, এখন খাওয়াটা কমিয়ে দিতে হবে। একটু ওজন কমিয়ে চলতে পারলে মেনোপজটা খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করা যাবে। পাশাপাশি একটু ক্যালসিয়াম, একটু সয়া প্রোটিন—এগুলো বেশি খেতে হবে। আর ব্যায়াম খুবই প্রয়োজন এ সময়ে। এবং যদি সমস্যা হয়, আমরা চিকিৎসকের কাছে যাবো। গেলে চমৎকার ক্যালসিয়াম, ভিটামিন, হরমোনের ওষুধ রয়েছে, সেগুলো দেবে। এতে ভেঙে পড়ার কিছু নেই; বরং এটা সুন্দর সময়, নারীরা একটি পরিণত বয়সে এসেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা দিয়ে এই সময়টুকু সমাজের কাছে, দেশের কাজে লাগাতে পারেন।
তাঁদের কোনো ভয় নেই। বাচ্চারা বড় হয়ে যায়, তাঁদের কোনো পিছুটান নেই, বাচ্চা হওয়ার ঝুঁকি নেই। এখন তাঁরা সম্পূর্ণ মুক্ত। নিজেদের জন্য সময় দিতে পারেন। তেমনি তাঁর সময়টুকু সমাজের কাজে লাগিয়ে দিতে পারেন। খুব সহজেই চাইলে এ সময়ে তাঁরা ফিট থাকতে পারেন।
প্রশ্ন : যাঁদের ক্ষেত্রে এই উপসর্গগুলো হয়, কত দিন পর্যন্ত তাঁদের এই চিকিৎসা আপনারা দেন বা পরামর্শ দেন?
উত্তর : দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সামান্য পরিবর্তন নিয়ে এলেই মেনোপজের উপসর্গগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। তবে তারপরও যদি তার কষ্ট হয়, হাড়ে ব্যথা থাকে, হাড় ক্ষয় হয়ে গিয়ে অস্টিয়পোরোসিস হয়, তখন আমরা তাঁকে ক্যালসিয়াম দিয়ে থাকি এবং হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি দিই।
মেনোপজের জন্য যে হরমোনটি আমাদের শরীরে কমে যায়, সেটি আমরা কৃত্রিমভাবে দিতে পারি। সেটি দেওয়ার সময় আমরা দেখে নেই, তিনি ফিট কি না সেটার জন্য। যদি হরমোন দেওয়া যায় দেখা যায়, তার সব মেনোপজাল উপসর্গ চলে যায়। এবং এটি সে অন্য সমস্যা না থাকলে পাঁচ বছর খেতে পারেন।
প্রশ্ন : এ জাতীয় সমস্যা বা উপসর্গগুলোর সঙ্গে কি কোনো জটিলতা আছে? সমস্যা বাড়তে থাকলে কতখানি ঝুঁকি হতে পারে?
উত্তর : উপসর্গগুলো আমরা অনেক সময় অতিক্রম করতে পারি দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটিয়ে। তবে যাতে বাকি সময়টুকু সমাজের বোঝা না হয়ে যাই, সে জন্য এ সময় কিছু স্ক্রিনিং করতে হয়। হাড় ক্ষয়ে যাচ্ছে কি না, ডায়াবেটিস আসছে কি না, উচ্চ রক্তচাপ হচ্ছে কি না বা অন্য কোনো ক্যানসারের জন্য এ সময়ে আমাদের স্ক্রিনিং করে এগুলো প্রতিরোধ করতে হবে। এবং এগুলো দেখে নিতে পারলে আমরা সুন্দর থাকতে পারব।
হয়তো দিনের পর দিন তাঁর হাড্ডি ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং অকাল ফ্র্যাকচার, হাড় ভেঙে যাচ্ছে—এটি প্রতিরোধ করা যেত যদি সময়মতো আমাদের কাছে আসত। তাই সব নারীকে মনে রাখতে হবে, মেনোপজকে আমরা শক্তভাবে মেনে নেব। পাশাপাশি চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরামর্শ নেব যে, অন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে কি না।