শীতের পাখি দেখতে জাহাঙ্গীরনগরে

সাভারে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শীত মানেই উৎসব। সে উৎসব প্রকৃতির, সে উৎসব পাখির, সে উৎসব প্রকৃতিপ্রেমীর।
জাহাঙ্গীরনগর, সে এক অনাবিল সৌন্দর্যের নগর, নৈসর্গের অন্য নাম, যে নৈসর্গের তুলনা মেলা ভার। কোনো এক দক্ষ শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো সুন্দর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শীতের ছোঁয়া পেয়ে এর রূপ বেড়ে যায় হাজার গুণ। কুয়াশার চাদরে মুড়ে ক্যাম্পাস পরিণত হয় ভূস্বর্গে! এই সৌন্দর্যের মাঝে একটুখানি গা মেলাতে উদগ্রীব হয়ে শীতের অপেক্ষা করতে থাকে অগণিত প্রকৃতিপ্রেমী হৃদয়। প্রকৃতিপ্রেমীদের কখনই আশাহত করেনি মনোমুগ্ধকর জাহাঙ্গীরনগর। বারবারই শীত আসে, আসে মুখিয়ে থাকা প্রকৃতিপ্রেমীরা, দুই হাত ভরে নিয়ে যায় জীবনের স্বাদ। বছর ঘুরে আবারও শীত, আবারও প্রকৃতির উৎসব, প্রকৃতিপ্রেমীর উৎসব। সংস্কৃতির রাজধানী খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মল প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা অজানা নয় কারো, এমনকি অজানা নয় হাজার হাজার মাইল দূরের সাইবেরিয়ার পাখিদেরও!
তারাও জানে জাহাঙ্গীরনগরের প্রকৃতি, পদ্মফুলে ভরা লেক কতটা অতিথিপ্রিয়। তাই তো শীত এলেই প্রকৃতির এই উৎসবে যোগ দিতে ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিবারের মতো এবারো এত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে তাদের প্রিয়, নিরাপদ স্বজনবাড়ি জাহাঙ্গীরনগরের আতিথ্য গ্রহণ করে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি। দূরদেশ থেকে রংবেরঙের ডানা মেলে ছুটে আসা অতিথি পাখির আগমনে উৎসব এখন তুঙ্গে।
কুয়াশার নিঃসঙ্গ ওড়াউড়িতে সঙ্গ দিয়েছে সহস্র পরিযায়ী পাখি, এ যেন কুয়াশায় পাখি উৎসব। অতিথি পাখির ডুবসাঁতারে শান্ত জলাশয়ে উৎসব, লালপদ্মের প্রতিটা পাতায় উৎসব। পাখির কলকাকলিতে শুষ্ক বাতাসে উৎসব। উৎসবে উৎসবে সংস্কৃতির রাজধানী এখন পরিণত হয়েছে পাখির রাজধানীতে। লাল সূর্যের ভোরে কিংবা পড়ন্ত বিকেলে এক কাপ চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রকৃতির এই অপরূপ লীলা, অনাবিল আনন্দের উৎসব কে না উপভোগ করতে চায়? কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে শিশিরভেজা ঘাসে পা ফেলে কাঁপতে কাঁপতে লালপদ্মের পাতায় বসে কলকাকলিরত অসংখ্য পাখির গা ঝাপটানো দেখার চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর জীবনে কী হতে পারে? জীবনের এই অদ্বিতীয় আনন্দের উৎসবে যোগ দিতে চলে আসুন আপনিও, এখনই।
ক্যাম্পাসের পদ্মসজ্জিত অসংখ্য জলাশয়ে এখন অজস্র পাখি, অজস্র সুন্দর, অজস্র উদ্যাম প্রাণ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিবছর এখানে শতাধিক প্রজাতির অতিথি পাখি আসে এবং এদের বেশির ভাগই হাঁস প্রজাতির। কত সুন্দর নাম তাদের, যেমন- সরালি, বামুনিয়া হাঁস, লালমুড়ি, গয়ার, পাতিতারা, মুরহেন, নর্দান, নাকতা, কোম্ব ডাক, চিতাটুপি, পাতারিহাঁস, ফ্লাই ফেচার, নোনা জোৎসা, ধূপানি, সিধু ঈগল, হুড হুড প্রভৃতি। অতিথিরা এখানে অতিথির মতোই সমাদৃত। এত দূরের অতিথিকে তো আর অনাদরে রাখা যায় না, তাই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটি পাখিদের জন্য নিশ্চিত করেছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং কয়েকটি লেককে ঘোষণা করা হয়েছে তাদের একক অতিথিশালা! প্রতিবছর কত শত প্রকৃতিপ্রেমী, পাখিপ্রেমী ঘুরে যায় এই পাখির শহরে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তবে আপনি কেন বাদ যাবেন?
এবার শীতে সুযোগ পেলেই পাখিদের সঙ্গে কাটিয়ে যান কিছুটা সময়। বেশির ভাগ পাখি দেখতে পাবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে ও পেছনের দুটি জলাশয়ে, অর্থাৎ পরিবহন চত্বরের কাছের লেক দুটোতে এবং প্রীতিলতা হল, জাহানারা ইমাম হল ও আল বেরুনী হলের পার্শ্ববর্তী লেকে।
অন্যান্য দর্শনীয় স্থান
শুধু পাখিই নয়, ক্যাম্পাসে রয়েছে আরো অনেক দর্শনীয় স্থান ও ভাস্কর্য। ভাষা আন্দোলনের প্রতীকী ভাস্কর্য ‘অমর একুশের’ নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। এবার দেখতেও পাবেন নিজ চোখে। ক্যাম্পাসে প্রবেশের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে সোজা এগোলেই সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সামনেই পেয়ে যাবেন অমর একুশে। সেই পথ ধরে আরেকটু এগোলেই দেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনার। শহীদ মিনার পেরিয়ে একটু সামনে এগোলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে দেখতে পাবেন ‘সংশপ্তক’, যা নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হিসেবে।
সমাজবিজ্ঞান অনুষদ থেকে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে নেমে যাওয়া রাস্তায় একটু এগোলেই পেয়ে যাবেন দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত মুক্তমঞ্চ, যার নামকরণ করা হয়েছে প্রখ্যাত নাট্যকার নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের নামানুসারে। যদিও পুরো ক্যাম্পাসটিই দর্শনীয়, তারপরও ঘুরে আসতে পারেন মওলানা ভাসানী হল-সংলগ্ন ‘সুইজারল্যান্ড’ এবং ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান কারখানা থেকে একটু এগিয়েই ‘বোটানিক্যাল গার্ডেন’ এবং সুইমিংপুল এলাকাও।
সতর্কতা
পাখিগুলো বহু দূর থেকে আসা অতিথি, তাই অতিথি বিরক্ত হয় এমন কোনো কাজই আপনার করা যাবে না। যেসব এলাকা পাখির অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে কোনোমতেই গাড়ির হর্ন বাজানো যাবে না এবং নীরবতা বজায় রাখতে হবে। পাখির দিকে কোনো প্রকার ঢিল ছোড়া যাবে না। যেসব জায়গায় নিরাপত্তাবেষ্টনী দেওয়া আছে, সেসব জায়গায় বেষ্টনীর বাইরে থেকেই পাখি দেখবেন। পাখিদের ওড়াউড়ি, কিচিরমিচির, ডুবসাঁতার ভালোভাবে উপভোগ করতে চাইলে অবশ্যই সকালে কিংবা বিকেলে আসতে হবে।
খাবার ব্যবস্থা
খাবার-দাবারের বেলায় জাহাঙ্গীরনগরের বেশ সুখ্যাতি আছে। বটতলায় অবস্থিত যেকোনো খাবারের দোকানে যেকোনো সময় সুলভ মূল্যে মেলবে টাটকা খাবার, পাবেন হরেক রকমের ভর্তা। এই ভর্তা খাবার জন্য হলেও আপনি বারবার ছুটে আসবেন এখানে তা আমরা জানি, আরো অনেকেই আসে যে! তা ছাড়া প্রান্তিক এবং ডেইরি গেটের রেস্তোরাঁগুলোতেও পাওয়া যাবে যেকোনো খাবার। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো পিঠা। বিকেল বেলায় বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেলের সামনে গেলেই পেয়ে যাবেন ভাঁপা পিঠা, পাটিসাপটা, চিতই পিঠা, মাংসপিঠাসহ হরেক রকমের মুখরোচক পিঠা। কনকনে ঠান্ডায় গরম পিঠার স্বাদে আপনি হয়ে উঠবেন সতেজ, মনে হবে প্রতিটা বিকেল কেন এমন নয়। তা ছাড়া বটতলা, অমর একুশে পাদদেশে বসা দোকান থেকেও স্বাদ নিতে পারেন গরম গরম পিঠার। এসব পিঠার স্বাদ আপনি কখনোই ভুলতে পারবেন না।
যাতায়াত
ঢাকা থেকে অল্প সময়ে খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন পাখির শহর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকার বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু পরপরই নবীনগর কিংবা ধামরাইগামী বাস ছেড়ে আসে। তার কোনো একটাতে চড়ে এলেই আপনাকে নামিয়ে দেবে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে। আসতে পারেন নিজের গাড়িতেও। তারপর আপনার ইচ্ছামতো রিকশা কিংবা হেঁটে ঘুড়ে বেড়াতে পারবেন ক্যাম্পাসজুড়ে। আপনাকে স্বাগতম।