কৃষি ব্যাংকের স্বল্প সুদের ঋণে কৃষকের মুখে হাসি

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করে সরকারি নীতি বাস্তবায়ন করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৩৮৬ জন নতুন কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। গত অর্থবছরে এসব নতুন কৃষকদের ৩ হাজার ১১৬ কোটি টাকার ঋণসুবিধা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, বিকেবির আরেকটি বড় সাফল্য হলো রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আহরণ। চলতি বছরের আট মাসে কৃষি ব্যাংক ১৯৭৬.২১ মিলিয়ন ডলার অর্থ্যাৎ ২৪,৩২৪ কোটি টাকা রমিট্যান্স আহরণ করেছে। সে হিসাবে কৃষি ব্যাংক প্রবাসী আয় সংগ্রহে তৃতীয় স্থানে উঠে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স আহরণে রেকর্ড ২ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। যে কারণে কৃষি ব্যাংকের বর্তমান অবস্থান আটটি সরকারি ব্যাংকের মধ্যে প্রথম এবং সব ব্যাংক অর্থাৎ ৬২টি ব্যাংকের মধ্যে দ্বিতীয়।
বিকেবি সূত্রে জানা যায়, দেশের খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সাম্প্রতিক অর্থ বছরে কৃষি ঋণ বিতরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে কৃষি ব্যাংক। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে কৃষি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা; যা ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকায়। চলতি অর্থ বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। পাশাপাশি কৃষি ব্যাংক অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতে ঋণ বিতরণে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সিএমএসএমই খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪৩৩ দশমিক ৬৮কোটি টাকা; যা ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫৩৫ দশমিক ১৯ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। চলতি অর্থ বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৮৯৫ দশমিক ৪২ কোটি টাকা।
ইতোমধ্যে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য কৃষি ও পল্লী খাতে ৩৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটি আগের বছরের তুলনায় ২.৬৩ শতাংশ বেশি, যেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে লক্ষ্য ছিল ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এ বছর রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ১৩,৮৮০ কোটি টাকা। এরমধ্যে শুধু কৃষি ব্যাংকেই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। চলতি বছর কৃষি ঋণ নীতিমালায় নতুন বেশ কিছু দিকনির্দেশনা যোগ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নিজস্ব নেটওয়ার্কে বিতরণকৃত যেকোনো ঋণের জন্য সিআইবি রিপোর্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে ২.৫০ লাখ টাকার নিচে কৃষি ঋণ আবেদন বা নবায়নের ক্ষেত্রে সিআইবি রিপোর্টের সার্ভিস চার্জ মওকুফ করা হয়েছে। কোনো ধরনের ঝামেলা এবং কঠোর নিয়ম নীতি ছাড়াই প্রথমবারের মতো কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন অসংখ্য নতুন নতুন কৃষক। সুদের হারও অন্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কম। এভাবে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকের নিকট ঋণ পৌঁছে দিতে কাজ করছে কৃষি ব্যাংক। এতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) একটি লক্ষ্য পূরণ হবে।
করোনাভাইরাসের আর্থিক ক্ষতি মোকাবিলায় ২০২০ সালের এপ্রিলে কম সুদের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিতকরণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ঋণদান কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে ধাপে ধাপে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের জন্য কম সুদের আরও বেশ কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এ পর্যন্ত ১০টি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এসব প্যাকেজের মধ্যে আটটি প্রণোদনা স্কিমের আওতায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে (বিকেবি) কম সুদে গ্রাহকদের ঋণ দিচ্ছে, যেখানে প্রায় অর্ধেক সুদ ভর্তুকি হিসেবে দিচ্ছে সরকার।
কৃষি ব্যাংকের তথ্যমতে, করোনা মহামারির কারণে কৃষিতে চলতি মূলধন সরবরাহের জন্য এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব অর্থায়নে ৫০০০ কোটি টাকার ‘কৃষি খাতে বিশেষ প্রণোদনামূলক পুনঃঅর্থায়ন স্কিম’ গঠন করা হয়। এই স্কিমের আওতায় কৃষি ব্যাংক প্রকৃত চাষি ও খামারিদের মধ্যে গ্রাহক পর্যায়ে শস্য ও ফসল খাতে ৪ শতাংশ সুদে কৃষি ঋণ প্রদান করে। সর্বমোট ছয়টি প্রণোদনা স্কিমের আওতায় ৪ থেকে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ সুদে কৃষি ব্যাংক থেকে গত অর্থবছরে এক লাখ ৭৫ হাজার ১১২ জন কৃষককে ৩ হাজার ৫৪ দশমিক ৯০ কোটি টাকার ঋণসুবিধা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বাংলাদেশ বাংক কর্তৃক গঠিত ‘স্মল এন্টারপ্রাইজ খাতে পুনঃঅর্থায়ন স্কিম’ তহবিলের মাধ্যমে গত অর্থ বছরে ৪ হাজার ৯৭৮জন নারী উদ্যোক্তাকে ৫ শতাংশ সুদ হারে ২৩৫ দশমিক ৬২ কোটি অর্থায়ন করা করেছে বিকেবি। তাদের সবাই এখন স্বাবলম্বী।
এছাড়াও কৃষি ব্যাংক পরিবেশ বান্ধব উৎপাদন ও সাশ্রয়ী সবুজ গৃহায়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব উৎস থেকে গঠিত ৪০০ কোটি টাকা পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের আওতায় গ্রাহক পর্যায়ে মাত্র ৫ শতাংশ সুদে গত অর্থ বছরে ২৫৪ জন নতুন উদ্যোক্তাকে ৯ দশমিক ৭৭ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দিয়েছে। তবে সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক খাত কৃষি খাতে সোলার ইরিগেশনের ক্ষেত্রে সুদ হার হচ্ছে মাত্র ৩ শতাংশ। যেখানে কম সুদে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি অন্য ব্যাংকগুলো। সেখানে ব্যতিক্রম ছিল কৃষি ব্যাংক। যে কারণে ইতিমধ্যে কম সুদের প্রণোদনা স্কিমগুলো বাস্তায়নে সফল হওস্বীকৃতিস্বরূপ ব্যাংকটিকে প্রশংসাপত্র প্রদান করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক হিসেবে ইতিমধ্যে বিকেবিকে পুরস্কৃত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আমদানি বিকল্প শস্য তথা ডাল, তৈলবীজ, মসলা ও ভুট্টা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করতে সরকার কর্তৃক ৪ শতাংশ রেয়াতি সুদে কৃষি ঋণ প্রদান করা হয়, যা দেশের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে এবং কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে দেয়। কৃষি ব্যাংক এই খাতে গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪ হাজার ৩১১ জন কৃষককে মাত্র ৪ শতাংশ সুদ হারে ৪৫ দশমিক ৭১ কোটি টাকার ঋণসুবিধা দিয়েছে।
খেলাপি ঋণ আদায়
বিভিন্ন কারণে অতীতে ব্যাংকটি যে নাজুক অবস্থা ছিল, সেখান থেকে খানিকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত অর্থ বছরে শ্রেণিকৃত ঋণ আদায় হয়েছে ১ হাজার ৯১ দশমিক ৯৭ কোটি টাকা। যা মোট শ্রেণিকৃত ঋণের ৪৭ শতাংশ। এছাড়া চলতি অর্থ বছরে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র আড়াই মাসে শ্রেণিকৃত ঋণ আদায় হয়েছে ১ হাজার ১৯০ দশমিক ২৮ কোটি টাকা। যা মোট শ্রেণিকৃত ঋণের ১৫ শতাংশ। ব্যাংকটির শীর্ষ ২০ ঋণ খেলাপিদের নিকট হতে ৫ দশমিক ৬১ কোটি এবং শীর্ষ ১০০ জন ঋণ খেলাপি গ্রাহকদের নিকট হতে ৭ দশমিক ৪২ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে পয়লা বৈশাখে হালখাতা আয়োজন ব্যাংকটির একটি নিয়মিত উদ্যোগ। খেলাপি ঋণ আদায়ে বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখে হালখাতা, নবান্ন, মধুমেলা ও বিশেষ মহাক্যাম্পের আয়োজন ব্যাংকটির একটি নিয়মিত উদ্যোগ। এর মাধ্যমে গত অর্থবছরে বিকেবি ৪ হাজার ৩৪৩ দশমিক ৫৫ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছিল। যার মধ্যে শ্রেণিকৃত ঋণ আদায় হয়েছিল ৪৪৭ দশমিক ৩৮ কোটি টাকা। এত সব অর্জন ও সাফল্য এবং মানুষের দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ১ হাজার ৩৮টি শাখা, ৪টি উপশাখা ও প্রধান কার্যালয়ের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে।
আর্থিক পরিস্থিতি
কৃষি খাতে অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকটিকে ভর্তুকি সুদে কৃষি ঋণ দিতে গিয়ে বিশেষায়িত এই ব্যাংক আর্থিক সংকটে ধুঁকছে। আবার আমানত সংগ্রহ করতে হয় অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক সুদে। যেখানে অনেক ব্যাংকে আমানতকারীদের চেক অমর্যাদা করা ও ব্যাংকে গচ্ছিত আমানত উত্তোলন করতে না পারাসহ নানা সংকটের মধ্যেও আমানত সংগ্রহে বিকেবি’র সাফল্য ছিল ইতিবাচক। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিকেবি সরকারি ব্যাংক হিসেবে আমানতকারীদের আমানতের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য শতভাগ নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও নিশ্চয়তা এবং ঝুঁকিমুক্ত হওয়ায় সংকটকালীন সময়ে আমানত সংগ্রহ বেড়েছে। গত ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে বিকেবি’র আমানতের স্থিতি ছিল ৪৫ হাজার ১৮৮ দশমিক ০২ কোটি টাকা। কিন্তু গত ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে আমানতের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ২০৩ দশমিক ১৪ কোটি টাকা অর্থ্যাৎ পূর্বের বছরের তুলনায় ৫ হাজার ১৫ দশমিক ১২ কোটি টাকা বেড়েছে। কৃষি ব্যাংক আমানতকারীদের আস্থা অর্জন করতে পারায় প্রবল সংকটের মধ্যে আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল শতকরা ১১ দশমিক ১০ শতাংশ।
জানতে চাইলে বিকেবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সঞ্চিয়া বিন্তে আলী বলেন, ‘রেমিট্যান্স সংগ্রহে কৃষি ব্যাংকের বর্তমান অবস্থান আটটি সরকারি ব্যাংকের মধ্যে প্রথম এবং সব ব্যাংক অর্থাৎ ৬২টি ব্যাংকের মধ্যে দ্বিতীয়। রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির কারণ হলো সারাদেশে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ১ হাজার ৩৮টি শাখা এবং ৪টি উপ শাখার সব কটি অনলাইনে দ্রুত ও ডিজিটাল সেবা প্রদান করায় প্রবাসী আয় বৃদ্ধির একটি বড় কারণ। এছাড়া বিকেবি দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত, শতভাগ নিরাপদ ও আস্থশীল হওয়ায় রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় পাঠানোর ক্ষেত্রে বিকেবি’র দিকেই ঝুঁকছে প্রবাসীরা।’
সঞ্চিয়া বিন্তে আলী আরও বলেন, ‘এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সরকারের কৃষি নীতি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যা ভর্তুকি সুদে কৃষকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। প্রণোদনা স্কিমের আওতায় ৪ থেকে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ স্বল্প সুদে অধিক সংখ্যক প্রকৃত চাষি ও খামারি উপকৃত হয়েছেন। দেশের খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।’