ঢাকাই জামদানির প্রদর্শনী দিল্লিতে

বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন ঐতিহ্যের মায়াবী ঝলকে ঝলমলে হয়ে উঠল নয়াদিল্লির জাতীয় ক্রাফটস মিউজিয়াম। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় পাঁচ দিনব্যাপী জামদানি প্রদর্শনীর উদ্বোধনের পর ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশ ও জামদানি কেন সমার্থক, কোন অবিশ্বাস্য দক্ষতায় এই বুনন অনন্য শিল্পের মুগ্ধতা ছড়ায়, তা তুলে ধরতে এই প্রদর্শনীর আয়োজন।
রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, এবার স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে কিছু জামদানি শাড়ি এনেছিলাম। দেখলাম, এদেশে জামদানি নিয়ে নারীদের মধ্যে বিপুল আগ্রহ রয়েছে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উদ্ভাসে এমনভাবে অনন্য সাধারণ জামদানি প্রদর্শনী ভারতের রাজধানীতে এই প্রথম। দুই দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক আবহে এই প্রদর্শনী শরৎকালে বসন্ত–সমীরণের মতোই স্বস্তিদায়ক।
জামদানি বুননের দীপ্তি ও উদ্ভাসের ছটা শুক্রবারের সাপ্তাহান্তিক সন্ধ্যায় যে মায়াজাল ও বিস্ময় সৃষ্টি করেছে, সরকারি সহযোগিতায় তা সম্ভব করে তুলেছেন দুই দেশের দুই চন্দ্রশেখর। তাঁদের একজন বাংলাদেশের প্রখ্যাত ডিজাইনার ও কারুশিল্প পরিষদের নির্বাহী সদস্য চন্দ্রশেখর সাহা। অন্যজন ভারতের বিশিষ্ট টেক্সটাইল ও হ্যান্ডিক্রাফটস ডিজাইনার চন্দ্রশেখর ভেদা।
আয়োজন প্রসঙ্গে চন্দ্রশেখর ভেদা বলেন, জামদানি প্রদর্শনীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়েই চন্দ্রশেখর সাহা জানিয়ে দেন, আমার সাহায্য ছাড়া এই কাজে নামা কঠিন হবে। তখনই শুরু হয় আমার খোঁজ। ৪০ বছর আগে ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজাইনে একই সঙ্গে পড়েছিলেন দুই চন্দ্রশেখর। সেই থেকে একে অপরের ঘনিষ্ঠ, গুণমুগ্ধ। কর্মজীবনে দুজনেই প্রতিষ্ঠিত। চন্দ্রশেখর সাহা বাংলাদেশের কারুশিল্প পুনরুজ্জীবনের পথিকৃৎ। আড়ং ব্র্যান্ড জনপ্রিয় করে তুলতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া এই দুটি জামদানি ১৫০ বছরের পুরোনো। প্রদর্শনীর জন্য আর্কাইভ থেকে দিল্লিতে নেওয়া হয়েছে।
চন্দ্রশেখর ভেদাও হয়ে উঠেছেন ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের উজ্জ্বল নক্ষত্র। নিজের ব্র্যান্ড স্পাইডার ডিজাইনকে পরিচিতি দিয়েছেন। তাঁদের যুগলবন্দী কী অসাধ্য সাধন করেছে, এই প্রদর্শনী তার প্রমাণ। হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহর কথায় সেই কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ে, তাদের সহযোগিতা ছাড়া আমার এই স্বপ্ন পূরণ হতো না।
সেই স্বপ্নপূরণে দিল্লি আনা হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত দুই জামদানি বুনকর প্রবীণ মোহাম্মদ জামাল হোসেন ও নবীন মোহাম্মদ সজীবকে। তাঁরা সঙ্গে এনেছেন চিরায়ত তাঁত। প্রদর্শনীকক্ষের এক পাশে সেই তাঁতে তাঁরা বুনে চলেছেন এই অপার বিস্ময় শিল্প। একই সঙ্গে জবাব দিচ্ছেন আগ্রহী জনতার নানা প্রশ্নের। দুই বুনকরই বংশপরম্পরাকে ধরে রেখেছেন দেশ ও পরিবারের ঐতিহ্য। তাঁরা বলেন, দেশ ও পরিবারের ঐহিত্য রক্ষা করতে পারছি বলে আমরা গর্বিত।
ইউনেসকো ২০১৩ সালে জামদানিকে মানবতার একটা অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলাদেশ ধরে রেখেছে তা নিশ্চিত করে। জামাল হোসেন বলেন, পাওয়ারলুমের আধিক্য ও দামের অসাম্যের জন্য জামদানি আজ কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে দাঁড়িয়েছে। এই শিল্প আজ তাই সাধারণের নাগালের বাইরে। চন্দ্রশেখর ভেদার কণ্ঠেও তারই প্রতিধ্বনী। তিনি বলেন, যন্ত্র দিয়ে জামদানি তৈরি করা যায় না। এর স্বচ্ছতা, সূক্ষ্মতা ও জাদুকরি বুননের জন্য হৃদয় লাগে।
সেই সুরে সুর মিলিয়ে চন্দ্রশেখর সাহা বলেন, একটা সময় ছিল যখন বাংলার মসলিন ছিল ভুবনবিখ্যাত। জামদানিও সেই মর্যাদায় আসীন। এটি এমন এক শিল্প, যা শুধু নয়ন নয়, চেতনায় অনুভব করতে হয়।
প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন ভারতের বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার মুজাফফর আলী এবং ইন্টেরিয়র ডিজাইনার সুনীতা কোহলি। জামদানির ঐতিহ্য ও গৌরবগাথা সংক্ষেপে বর্ণনা করে সুনীতা বলেন, জামদানি হলো বাতাস বুনন, যা পেতে রাজা–মহারাজারা উৎসুক ছিলেন, বণিকেরা যা নিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিতেন এবং কবিরা এর সূক্ষ্মতার বিচারে কাব্য রচনা করতেন। জামদানি সেই ‘স্পর্শাতীত বিলাসিতা’ যার পরিমাপ মূল্যভিত্তিক নয়। ধৈর্য, স্পর্শ ও হৃদয়ের অনুভব দিয়ে করতে হয়।
মুজাফফর আলী বলেন, জামদানি সেই শিল্প, যেখানে আলো ও ছায়ার বুনন অভিনবত্ব সৃষ্টি করে। এই শিল্পের সৌন্দর্য ও মুগ্ধতা সীমানা পেরিয়ে হৃদয়ের মিলন ঘটায়। প্রদর্শনীর প্রথম দিন বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিক ও সমাজের বিশিষ্টরা ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। এ উপলক্ষে চন্দ্রশেখর সাহা ও সাইফুর রহমানের সম্পাদনায় ‘ট্রেডিশনাল জামদানি’ নামে একটি বই প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের নিমফিয়া পাবলিকেশনের পক্ষে বইটি প্রকাশ করেছেন করুণাংশু বড়ুয়া।