পুঁজিবাজার ট্রাইব্যুনাল
রায় হয়েছে পাঁচটি মামলার, ঝুলছে মাত্র একটি

পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। চলতি বছর জুনে এই ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরুর পর পাঁচটি মামলার রায় হয়েছে। বর্তমানে মাত্র একটি মামলার কার্যক্রম চলছে।
উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা কমেছে বলে মনে করছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে ভবিষ্যতে নতুন মামলার কার্যক্রম সরাসরি ট্রাইব্যুনালে যাতে করা যায়, সে জন্য আইন প্রণয়নের বিষয়ে ভাবছে কমিশন।
২০১০ সালে পুঁজিবাজার ধসের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুপারিশ করা হয়। ২০১২ সালে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অধ্যাদেশ, ১৯৬৯ সংশোধন করে সরকার। অধ্যাদেশের ২৫ ধারায় সেকশন ‘বি’ সংযোজন করা হয়। ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। পরে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শে বিশেষ জজ হুমায়ুন কবিরকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর পর ২০১৫ সালের ২১ জুন ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়।
নিম্ন আদালত থেকে স্থানান্তরিত ১৭টি মামলা নিয়ে পুঁজিবাজার ট্রাইব্যুনালে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। গত জুলাই মাসে চারটি ও সেপ্টেম্বরে আরো একটি মামলা নিম্ন আদালত থেকে ট্রাইব্যুনালে আসে। চলতি মাস পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে আসা মোট মামলার সংখ্যা ২২টি। এসব মামলা ১৯৯৬, ২০০০ ও ২০১০ সালে দায়ের করা হয়।
২২টির মধ্যে পাঁচটি মামলা নিষ্পত্তি শেষে রায় ঘোষণা দেওয়া হয়। অপেক্ষমাণ ১৭টি মামলার মধ্যে আসামিদের করা আবেদনে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১৪টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। বাকি তিনটির মধ্যে দুটি মামলা ট্রাইব্যুনালের বিচারের এখতিয়ারের বাইরে হওয়ায় ফেরত পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে একটি মামলার কার্যক্রম চলছে ট্রাইব্যুনালে। এটি হচ্ছে প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজ লিমিটেড ও এর পরিচালকদের ডিভিপি-সংক্রান্ত মামলা।
ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা যায়, আসামিদের পরিচালনাধীন প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজ লিমিটেড ১৯৯৬ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতারণার মাধ্যমে মিতা টেক্সটাইল, প্রাইম টেক্সটাইল, বাটা সু ও বেক্সিমকো ফার্মার মোট ১২৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকার শেয়ার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে ডেলিভারি ভার্সেস পেমেন্টে বা ডিভিপি প্রক্রিয়ায় বিক্রি করে। এ মামলার ১ নম্বর আসামি প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজ ওই সময় ২১ লাখ ৪৩ হাজার ৬৩টি শেয়ার বিক্রি করে, যার বাজারদর ছিল ৬৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
আসামিরা বিনিয়োগকারী ও কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ার বিক্রি করে। এতে প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজের লেনদেন করা বিপুল পরিমাণ শেয়ারের হিসাব অনিষ্পন্ন থেকে যায়। আর ডিভিপি দেওয়া উল্লিখিত সংখ্যক শেয়ার উদ্দেশ্যমূলকভাবে ও প্রতারণার জন্য নির্দিষ্ট কিছু ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হয়। এটি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অধ্যাদেশ ১৯৬৯-এর ১৭ ধারা লঙ্ঘন এবং একই অধ্যাদেশের ২৪ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজের মামলার রায় দেওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। এ মামলায় আসামিরা হলেন প্রিমিয়াম সিকিউরিটিজসহ কোম্পানির চেয়ারম্যান এম এ রউফ চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান, পরিচালক সৈয়দ এইচ চৌধুরী ও অনু জায়গীরদার।
এর আগে পুঁজিবাজার ট্রাইব্যুনালের বিচারক হুমায়ুন কবির এক মামলার শুনানিকালে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের উদ্যোগে গাফিলতি আছে বলে মন্তব্য করেন। এ ছাড়া নিম্ন আদালতের মামলা স্থানান্তর নিয়ে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কার্যক্রমে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি ।
এ বিষয়ে বিএসইসির আইন কর্মকর্তা রোকসানা আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, ‘নতুন মামলা ট্রাইব্যুনালে আনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এখন পর্যন্ত ২২টি মামলা এসেছে। পাঁচটির রায় প্রকাশ হয়েছে।
উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে ট্রাইব্যুনালে মামলার কার্যক্রমের ক্ষেত্রে কিছুটা সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন সাইফুর রহমান। তিনি বলেন, নিম্ন আদালত থেকে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে মামলা আসে। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে ভবিষ্যতে যাতে সরাসরি ট্রাইব্যুনালে মামলা করা যায়, সে ব্যাপারে ভাবছে কমিশন। এ জন্য আইন প্রণয়নে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা যায়, ১৯৯২ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত শেয়ার কারসাজি ও অনিয়মের অভিযোগে আদালতে পাঁচ শতাধিক মামলা হয়েছে। বিভিন্ন কারণে এসব মামলা কয়েক বছর ধরে ঝুলে আছে। দ্রুত বিচারিক কাজ সম্পন্ন করতে বিএসইসি ট্রাইব্যুনাল গঠন করলেও মামলার সংকটে লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না।
পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত বিশেষ ট্রাইব্যুনালের পেশকার মোহাম্মদ মামুন বলেন, ‘উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে ট্রাইব্যুনালে মামলা কমে যাচ্ছে। এতে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।’
মামুন আরো বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের জনবল কম হলেও বিভিন্ন মামলার কার্যক্রম একসঙ্গে চলতে পারত। কিন্তু নিম্ন আদালত থেকে মামলা স্থানান্তর না হলে তো কার্যক্রমশূন্য থাকবে ট্রাইব্যুনাল। এ সংকট থেকে উত্তরণে বিএসইসিকে তাগিদ দিয়েছেন বিচারক।’
ট্রাইব্যুনালে মামলার সংকট প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মোস্তাফিজুর রহমান দুলাল বলেন, ‘কয়েকটি মামলার রায় ও স্থগিতাদেশের কারণে বিচারাধীন মামলা কমেছে। স্থগিত মামলাগুলো চালুর প্রচেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে কয়েকটি মামলার স্থগিতাদেশ (স্টে অর্ডার) প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়েছে। এ ছাড়া নিম্ন আদালতের মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরের প্রক্রিয়াও চলছে। আইনি জটিলতা শেষে স্বল্প সময়ের মধ্যে কয়েকটি মামলা ট্রাইব্যুনালে আসবে বলে আশা করছি।’
ট্রাইব্যুনালের দেওয়া পাঁচটি রায়
প্রথম রায়
ফেসবুকসহ ছয়টি ওয়েবপোর্টালে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচার গুজব রটনাকারী মাহাবুব সারোয়ারকে দুই বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
দ্বিতীয় রায়
বাংলাদেশ (বিডি) ওয়েল্ডিং ইলেকট্রোডস লিমিটেডের শেয়ারদর নিয়ে কারসাজি করায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম নুরুল ইসলাম ও ডেইলি ইন্ডাস্ট্রিজ পত্রিকার সম্পাদক এনায়েত করিমকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, কারসাজি করায় ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে বিডি ওয়েল্ডিংয়ের শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে। তখন এ শেয়ারের দাম ছয় টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। আর এ সময়ে বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করেন আসামিরা। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হন বিনিয়োগকারীরা।
তৃতীয় রায়
শেয়ারদর নিয়ে কারসাজির দায়ে চিক টেক্সটাইল লিমিটেডের দুই পরিচালককে চার বছরের জেল ও ৩০ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
১৯৯৬ সালে চিক টেক্সটাইল লিমিটেডের শেয়ারের দর কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর অভিযোগে মামলা করে বিএসইসি। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. মাকসুদুর রাসুল ও পরিচালক ইফতেখার মোহাম্মদ এ মামলার আসামি।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ১৯৯৬ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে কারসাজির মাধ্যমে মুনাফা করার উদ্দেশ্যে ইঞ্জিনিয়ার মাকসুদুর রসুল আট লাখ ২৮ হাজার ৪৬৪টি ও পরিচালক ইফতেখার মোহাম্মদ ৮ লাখ ৩৫ হাজার শেয়ার লেনদেন করেন। এ অভিযোগে ১৯৯৭ সালের ২ এপ্রিল বিএসইসি ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলা (নম্বর ১০৮২) করা হয়। ১৯৯৯ সালে মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি (নম্বর ৩৫৭৯) স্থানান্তর করা হয়। পুঁজিবাজার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলাটির নতুন নম্বর দেওয়া হয় ১/২০১৫।
চতুর্থ রায়
২০১০ সালে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার দায়ে বিনিয়োগকারী সাত্তারুজ্জামান শামীমকে বেকসুর খালাস দেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১০ সালে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে সাত্তারুজ্জামান শামীমের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মামলার প্রধান আসামি ছিলেন গ্রিন বাংলা কমিউনিকেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রয়াত নবীউল্লাহ নবী। সাত্তারুজ্জামান শামীমকে নবীউল্লাহ নবীর প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পঞ্চম রায়
গত ৩০ নভেম্বর সৌদি বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি (সাবিনকো) লিমিটেডের মামলার রায় হয়। এতে সাবিনকোর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কুতুব উদ্দিন তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলা থেকে খালাস পান।
কুতুব উদ্দিন ২০০০ সালের জুন-জুলাই মাসে সাবিনকোর তিন কোটি টাকা অবৈধভাবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন তিনি। ওই সময় তিনি ও তাঁর পরিচিত কয়েকজন ব্যক্তি বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের সঙ্গে সমঝোতা করে কৃত্রিমভাবে শেয়ারদর বাড়ান। এতে ২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর বিএসইসির তৎকালীন পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।