‘দ্রুত হাসপাতালে আসেন, অন্যথায় লাশও পাবেন না’

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে হামলা, গুলিবর্ষণ, হত্যাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন শহীদ মাহামুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী। সাক্ষীর জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘১৯ জুলাই দুপুরে খাবারের পর আমার ভাই আন্দোলনে যোগদান করে। এদিন একজন অপরিচিত ব্যক্তি সৈকতের ফোন রিসিভ করে এবং আমার বাবাকে জানায়, এই ফোনটি যার তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। আমরা তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা দ্রুত হাসপাতালে আসেন, অন্যথায় লাশও পাবেন না।’
আজ সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে সাক্ষীর জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী। এ নিয়ে এ মামলায় ৪৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে।
সাক্ষী সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, মোহাম্মদপুর ঢাকা, ইংরেজি বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ মাহামুদুর রহমান সৈকতের বোন এবং আমি নিজেও একজন জুলাই যোদ্ধা।’
শহীদ মাহামুদুর রহমান সৈকতের বোন সেবন্তী বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৯ জুলাই (শুক্রবার) আমার ভাই জুমার নামাজ শেষে বাসা থেকে খেয়ে মোহাম্মদপুর এলাকার নুরজাহান রোডের দক্ষিণ মাথায় আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য যায়। আনুমানিক ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে পুলিশ অতি নিকট থেকে আমার ভাই সৈকতকে গুলি করে হত্যা করে। তখন আমার বাবা আমাদের গ্রামের বাড়ি সন্দীপে ছিলেন। তিনি সেখান থেকে সৈকতের মোবাইলফোনে কয়েকবার ফোন দেন। একপর্যায়ে একজন অপরিচিত ব্যক্তি সৈকতের ফোন রিসিভ করে এবং আমার বাবাকে জানায়, এই ফোনটি যার তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। আমরা তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা দ্রুত হাসপাতালে আসেন, অন্যথায় লাশও পাবেন না।’
‘আমার বাবা আমার ফুফাতো ভাই সাইফুর রহমান হায়দারকে উক্ত হাসপাতালে যেতে বলে। খবর পেয়ে আমি উক্ত হাসপাতালে ছুটে যাই। হাসপাতালে আমি আমার ভাইসহ পাঁচজনের লাশ দেখতে পাই। আমার ভাইয়ের মাথায় গুলি লেগেছিল। তার মাথায় মোটা রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ ছিল। অপর লাশগুলোর প্রত্যেকের মাথায়, পেটে ও বুকে গুলির চিহ্ন দেখতে পাই। আমি যতক্ষণ হাসপাতালে ছিলাম, ততক্ষণ অনবরত গুলিবিদ্ধ আন্দোলনকারীদের হাসপাতালে নিয়ে আসতে দেখি’, যোগ করেন সাক্ষী সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী।
সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী আরও বলেন, ‘হাসপাতালের মেঝেতে অনেক রক্ত দেখতে পাই। আমার ভাইয়ের মাথা থেকে নির্গত রক্ত একজনকে বালতি দিয়ে পানি ঢেলে ধুয়ে দিতে দেখি। আমার ভাইয়ের লাশ দেখে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। আমার মা একা বাসায় থাকায় ফুফাতো ভাইকে হাসপাতালে রেখে আমি বাসার উদ্দেশে রওনা হই। ঐ দিন রাত ৯টার দিকে হাসপাতাল থেকে আমার ফুফাতো ভাই আমার ভাই সৈকতের লাশ বুঝে পায়। পরদিন ২০ জুলাই সৈকতের জানাজা শেষে মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডের জামে মসজিদ কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।’
আদালতে সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী বলেন, ‘তখনও আন্দোলন চলমান ছিল এবং প্রতিনিয়ত আন্দোলনকারীদের হত্যা করা হচ্ছিল। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী, খুনি ও অবৈধভাবে নির্বাচিত তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা জনস্রোতের মুখে পদত্যাগ করে পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়ার কিছু মাস পরে আমি শেখ হাসিনার কিছু ফোন রেকর্ড শুনতে পাই।’
‘আল জাজিরা আমার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় আল-জাজিরার সাংবাদিক আমাকে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) মাকসুদ কামালের সঙ্গে শেখ হাসিনার ফোনালাপ শোনান। সেই ফোনালাপে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের রাজাকার আখ্যায়িত করে বলেন, ইংল্যান্ডের স্টাইলে স্টুডেন্টদেরকে হত্যা করা হবে। অপর ফোনালাপে মেয়র তাপসকে শেখ হাসিনা ড্রোন ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে অন্দোলনকারীদের অবস্থান নির্ণয়পূর্বক লেথাল উইপন ব্যবহার করে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেন। ঐ কথোপকথনে শেখ হাসিনা মোহাম্মদপুর এলাকার কথা উল্লেখ করেন, যেখানে আমার ভাই পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন’, যোগ করেন শহীদ সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী।
সাক্ষীর জবানবন্দিতে সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী বলেন, ‘পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে শেখ হাসিনার আরেকটি ফোনালাপ শুনতে পাই। ঐ ফোনালাপে শেখ হাসিনা জানায়, সে স্টুডেন্টদের ওপর বোম্বিং করার নির্দেশ দিয়েছে। জুলাইয়ের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আল জাজিরা আমার যে সাক্ষাৎকার নিয়েছিল, তার কিছু অংশ একটি ডকুমেন্টারি হিসেবে তাদের (সোশ্যাল মিডিয়া) পেজে প্রকাশ করেছে।’
সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে খুনি হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে দায়ী করছি। এছাড়া যারা তাদের নির্দেশ মেনে নিরস্ত্র, নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর লেথাল উইপন ব্যবহার করে নিহত ও আহত করেছে, তাদেরকে দায়ী করছি এবং তাদের বিচার ও ফাঁসি দাবি করছি।’
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই পাঁচটি অভিযোগে তাদের বিচার করা হচ্ছে। অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
গত ১ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগ আমলে নেন। আমলে নেওয়া পাঁচ অভিযোগ হলো—
প্রথম অভিযোগ
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আমলে নেওয়া অভিযোগের প্রথমটিতে বলা হয়, শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই চীন থেকে ফিরে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এ সময় আন্দোলনরত ছাত্রদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে অভিহিত করে ছাত্র- জনতার ওপর নির্যাতনের উসকানি দেওয়া হয়। আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন তার অধীনস্থ বাহিনীকে হামলার জন্য সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে নির্দেশ দেন। এতে করে রাজধানীর মিরপুর, আশুলিয়া, যাত্রাবাড়ি, গাজীপুরসহ সারা দেশে নিহতদের জানাজা ও সৎকার করা, হাসপাতালে লাশ হস্তান্তরে বাধা প্রদান করা হয়। এসব কর্মকাণ্ড করে আসামিরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
দ্বিতীয় অভিযোগ
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় সুপিরিয়র কমান্ডার শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভিসি) এস এম মাকসুদ কামাল ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এসব ফোনকলে আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্র-জনতার ওপর মারণাস্ত্রের ব্যবহার করার কথা বলা হয়। নির্দেশ পেয়ে হেলিকপ্টার থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করা হয়। এসব ফোনের অডিও ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে। নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এছাড়া সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বাহিনীকে মারণাস্ত্র ব্যবহারের জন্য নির্দেশনা দিয়ে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং ২৫ হাজার মানুষকে আহত করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
তৃতীয় অভিযোগ
১৬ জুলাই রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে তার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চারবার পরিবর্তন করা হয়। এ ঘটনায় নিহত আবু সাঈদের সহপাঠীদের আসামি করে মামলা করে পুলিশ। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে এই হত্যা, তথ্য গোপন ও মিথ্যা মামলা করা হয়। এসবের নির্দেশ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তিন আসামি।
চতুর্থ অভিযোগ
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে আসার সময় চাঁনখারপুল এলাকায় শহীদ আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে এ ছয়জনকে হত্যা করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
পঞ্চম অভিযোগ
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে আসার সময় আশুলিয়ায় ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা হয়। এ ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এই আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করে প্রসিকিউশন।