মেঝ ছেলে জানায় রাকিব দুনিয়াতে নাই, রাকিবের বাবার সাক্ষ্য

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে রাজধানীর চানখারপুলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সদস্যদের গুলিতে শিক্ষার্থী আনাসসহ ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন শহীদ রাকিব হাওলাদারের বাবা ও বড় ভাই। সাক্ষ্য দিয়ে চানখারপুলে হত্যার জন্য দায়ী পুলিশের বিচার চেয়েছেন তারা।
আজ বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি মো. গোলাম মোর্তজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালীন সময়ে কথা বলেন তারা।
সাক্ষীর জবানবন্দিতে শহীদ রাকিব হাওলাদারের বাবা বলেন, ‘আমার নাম মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ৪৬ বৎসর। আমি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। আমি জুলাই আন্দোলনে শহীদ রাকিব হোসেন হাওলাদারের পিতা। আমার ছেলে ঢাকা চকবাজার থানাধীন নবাব বাগিচায় কাজল প্লাস্টিক ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের কাজ করতো। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সোমবার বেলা আনুমানিক ১টার দিকে আমার ছেলে তার প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে নাজিমুদ্দিন রোডে বোরহানউদ্দিন কলেজের সামনে আন্দোলনে যোগ দেয় এবং সেখানে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়।’
মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমার বড় ভাই মতিউর রহমান হাওলাদার আমাদের গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠি থেকে ফোনে আমাকে নবাব বাগিচায় কাজল প্লাস্টিক ফ্যাক্টরিতে যেতে বলে। আমি জিজ্ঞেস করলে বলে সেখানে গণ্ডগোল চলছে। আমি তখন কেরাণীগঞ্জ থেকে বেলা আনুমানিক সোয়া ২টায় কাজল প্লাস্টিক ফ্যাক্টরিতে আসি।’
জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমি মেঝ ছেলে রাহাতকে ফোন দিলে সে আমাকে জানায়, রাকিব দুনিয়াতে নাই। কাজল প্লাস্টিক ফ্যাক্টরির একটু সামনে আমার ছেলের লাশ দেখতে পাই। সেখানে আমার অন্য দুই ছেলেও উপস্থিত ছিল। সেখান থেকে লাশ ভ্যান গাড়িতে করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সেখান থেকে লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে জানাজা শেষে দাফন করি।’
জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলে রাহাত ঘটনাস্থলের একটি ভিডিও তার মোবাইল ফোনে সংগ্রহ করে। এই মোবাইলটি তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাদের কাছ থেকে জব্দ করে ভিডিওটি একটি পেনড্রাইভে কপি করে মোবাইলটি আমাদের জিম্মায় ফেরত দেয়। এই সেই জব্দ তালিকা। জব্দ তালিকায় এটা আমার স্বাক্ষর। এই সেই ভিডিও সম্বলিত পেনড্রাইভ। (ট্রাইব্যুনালে দুটি ভিডিও প্রদর্শিত হয়)। একটি ভিডিওতে পুলিশের পোশাক পরা একজনকে গুলি করতে দেখা যায়। সে আমার ছেলেকে গুলি করে। পরে জেনেছি তার নাম কনস্টেবল সুজন। অপর ভিডিওতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমার ছেলেকে লোকজন ধরাধরি করে নিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে।’
জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, এডিসি শাহ-আলম, রমনা জোনের এসি ইমরুল, শাহবাগ থানার ওসি আরশাদ হোসেনের নির্দেশে এবং উপস্থিতিতে কনস্টেবল সুজন, কনস্টেবল ইমাজ ও কনস্টেবল নাসিরুল আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। আমি মাননীয় ট্রাইবুন্যালের কাছে আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই। তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এই আমার জবানবন্দি।’
পরে সাক্ষ্য প্রদান করেন মো. রাকিব হাওলাদারের বড় ভাই রাহাত হাওলাদার। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘আমার নাম মো. রাহাত হাওলাদার। আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ২৩ বৎসর। আমি শহীদ রাকিব হাওলাদারের বড় ভাই।’
রাহাত হাওলাদার বলেন, ‘আমার ভাই রাকিব হাওলাদার জুলাই আন্দোলন চলাকালে ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে চানখারপুলের নবাব বাগিচা এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। আমার মোবাইলে আমার ভাইয়ের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত দুটি ভিডিও আমি আরটিভি এবং যমুনা টিভি থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। সেগুলো আমার মোবাইল ফোনে রাখা ছিল। সেই মোবাইল তদন্তকারী কর্মকর্তা জব্দ করে পেনড্রাইভে সে ভিডিওগুলো কপি করে নিয়ে মোবাইল ফোনটি আমার জিম্মায় ফেরত প্রদান করেন। এই সেই জব্দ তালিকা। জব্দ তালিকায় এটা আমার স্বাক্ষর। এই সেই ভিডিও সম্বলিত পেনড্রাইভ।’
এ সময় ভিডিও দুটি ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত হয়। প্রদর্শনকালে ভিডিওতে সাক্ষী গুলিতে নিহত তার ভাই রাকিবকে শনাক্ত করেন এবং কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সুজনকেও সাক্ষী সনাক্ত করেন। এ ছাড়াও আরও দুইজন পুলিশ গুলি করে। তাদের একজনের নাম ইমাজ এবং আরেকজনের নাম নাসিরুল।
রাহাত হাওলাদার বলেন, ‘আমি আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’