নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে ইসির বৈঠক

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে একগুচ্ছ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেছে নির্বাচন কমিশন।
আজ বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) বেলা আড়াইটার পর রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে চার নির্বাচন কমিশনার (ইসি) এবং ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে এই বৈঠক শুরু হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বৈঠকে ছিলেন না। অন্যদিকে, ইসি সচিব জাপানে রয়েছেন।
ইসি আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আমরা বৈঠক শুরু করলাম। অনেকগুলো বিষয় থাকায় আজকের মধ্যে সম্ভব নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রোববার-সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, বৈঠকে কর্মপরিকল্পনা ফাইনাল করে তারপর সিইসিকে জানানো হবে।
আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে রোজার আগে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সংক্রান্ত চিঠিও দেওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনে।
নির্বাচন কমিশন বলছে, ভোটের তারিখের প্রায় দুই মাস আগে তফসিল ঘোষণা করা হবে। নির্বাচন কমিশন সভায় আলোচনা শেষে জানানো হয়, ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল দেবে ইসি।
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর ২০২৪ সালের নভেম্বরে দায়িত্ব নেয় এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশন। অন্য নির্বাচন কমিশনাররা হলেন- আব্দুর রহমানেল মাছউদ, তাহমিদা আহমদ, মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। ইসি সচিব হিসেবে রয়েছেন আখতার আহমেদ।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারসহ নানা সংস্কারের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজও চলে। সার্বিক সংস্কার বিবেচনায় রেখে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ধরে এগোচ্ছিল ইসি।
২০২৫ সালের শুরুতেই ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়। ভোটার দাঁড়ায় ১২ কোটি ৩৭ লাখের বেশি। এ ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে অন্যান্য অনুষঙ্গও চলমান রয়েছে।
বর্তমান ইসির কাজের সার্বিক অগ্রগতি
ভোটার তালিকা : প্রায় ৪৬ লাখ বাদ পড়া ভোটারের হালনাগাদের খসড়া প্রকাশ ও ৩১ অগাস্ট চূড়ান্ত; সম্পূরক তালিকা অক্টোবরে।
দল নিবন্ধন : বাছাই শেষে বাদ ১২১টি আবেদন। ২২টি দলের অস্তিত্ব, কার্যকারিতা মাঠ পর্যায়ে তদন্ত চলছে।
সীমানা নির্ধারণ-৩০০ আসনের খসড়া প্রকাশ : ১০ আগস্টের মধ্যে ৮২টি আসনে ১৭৬০টি দাবি আপত্তি আবেদন জমা পড়ে। শুনানি চলবে ২৪-২৭ আগস্ট। তারপর চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশ।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক : অন্তত ৩১৮টি সংস্থার আবেদন বাছাই করছে কমিটি।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) : ছোটোখাটোসহ অন্তত ৪৪টি সংস্কার চূড়ান্তের পর্যায়ে; আইনমন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। দল ও আচরণবিধি অনুমোদিত; আরপিও সংস্কার সাপেক্ষে জারি হবে।
প্রবাসীদের ভোটাধিকার : প্রবাসীদের জন্য আইটি সাপোর্টেড নিবন্ধন ও পোষ্টাল ব্যালট পদ্ধতি প্রক্রিয়াধীন, চূড়ান্ত হলে পদ্ধতি নিয়ে প্রচারণা।
নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটা : সেপ্টেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা।
রোডম্যাপ প্রকাশ : সংলাপ, মত বিনিময়, মিটিং, ব্রিফিং, প্রশিক্ষণ, মুদ্রণ, বাজেট বরাদ্দ, আইটি ভিত্তিক প্রস্তুতি, প্রচারণা, সমন্বয় সেল, আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক থেকে যাবতীয় কর্মপরিকল্পনা মাথায় রেখে উল্লেখযোগ্য খাত ও বাস্তবায়নসূচি রয়েছে।
তফসিলের আগে ও পরের কাজ থাকবে ও সম্ভাব্য বাস্তবায়ন সময় ধরে ইসির প্রস্তুতি চলে বরাবরই।
রোডম্যাপের ধারাবাহিকতা
নির্বাচন কমিশন প্রাক নির্বাচন ও তফসিল পূর্ববর্তী ‘প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা’ এবং তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন পরিচালনার জন্য ‘কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সূচি’ সংক্রান্ত চেক লিস্ট তৈরি করে কাজের সুবিধার জন্য।
২০০৭-২০০৮ সালে প্রথমবারের মত রোডম্যাপ ঘোষণা করে তৎকালীন ইসি। ২০০৭ সালের ১৫ জুলাই দেড় বছরের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়, যাতে ২০০৮ সালে অক্টোবর-ডিসেম্বরে তফসিল ও ভোটের সময়সূচি ধরা হয়। ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন শুরু হয়। আইন-বিধি সংস্কার, দল নিবন্ধনের পর সেই ভোটার তালিকা দিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন হয়।
পরবর্তী সময়ে বিষয়টি রোডম্যাপ বা অ্যাকশন প্ল্যান বা কর্মপরিকল্পনা বা চেকলিস্ট নামে পরিচিত রয়েছে, যা ইসি এখনও অব্যাহত রাখছে।
এর আগে দশম সংসদ নির্বাচনের দুই বছর আগে রোডম্যাপ ঠিক করে তৎকালীন ইসি।
একাদশ সংসদ ২০১৮ সালে অক্টোবরের মাঝামাঝি ভোটের কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নসূচি অনুমোদন করে তৎকালীন কমিশন। সবশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ‘কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ’ অনুষ্ঠান করে তৎকালীন ইসি।
ভোটের পথে তফসিলের আগে-পরে যত কাজ
>ভোটার তালিকা, আইন-বিধি-নীতিমালা সংস্কার, সংলাপ, সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস, নতুন দল নিবন্ধন।
>প্রবাসী বাংলাদেশিদের পোস্টাল ব্যালটে ভোটিং, দেশের অভ্যন্তরে তিন ধরনের ব্যক্তির পোস্টাল ব্যালট প্রস্তুত।
>চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ; তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সংসদীয় আসন অনুযায়ী ৩০০ এলাকার তালিকা প্রস্তুতি, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ, তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের অন্তত ২৫ দিন আগে গেজেট প্রকাশ।
>প্রশিক্ষণ, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন।
>প্রার্থীদের জন্য মনোনয়নপত্রের সঙ্গে নির্বাচনি এলাকাভিত্তিক ছবি ছাড়া ভোটার তালিকার সিডি প্রস্তুত।
>ছবিসহ ও ছবি ছাড়া ভোটার তালিকার প্রয়োজনীয় সংখ্যক কপি মুদ্রণ।
>সম্পূরক ভোটার তালিকার সিডি রেজিস্ট্রেশন অফিসারকে সরবরাহ।
>বিদেশি পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের জন্য হেল্পডেস্ক করতে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ; নিয়মিত সংবাদ অবলোকন করে কমিশনকে জানাতে টিম গঠন; সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে নির্বাচনি প্রচার নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সভা; সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের জন্য কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সভা পরিকল্পনা।
>নির্বাচনে ব্যবহৃত সব ফরম, প্যাকেট মুদ্রণ সম্পন্ন। ব্যালট বাক্স, লকসহ নির্বাচন দ্রব্যাদির মজুদ পরীক্ষা করে জেলা নির্বাচন অফিসারদের জানানো।
>মনোনয়নপত্র দাখিল সংশ্লিষ্ট প্রাথমিক পর্যায়ের বিভিন্ন ফরম (ফরম-১, ফরম ২, ফরম-৩), প্যাকেটসহ অন্যান্য দ্রব্যাদি মাঠ পর্যায়ে প্রেরণ। নির্বাচনি দ্রব্য- স্ট্যাম্প প্যাড, মার্কিং সিল, ব্রাস সিল, অফিসিয়াল সিল, গালা ইত্যাদি সংগ্রহ।
>ভোটের জন্য আগে সব ব্যালট বাক্স পুনরায় যাচাই ও ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা।
>ম্যানুয়েল মুদ্রণ শেষ করে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠানো।
>মাঠ পর্যায় থেকে ভোটকেন্দ্রের তালিকা কমিশনের অনুমোদনের জন্য নির্দেশনা (তফসিল ঘোষণার ৭ দিনের মধ্যে পাঠাতে হবে)।
>বিভিন্ন প্রকার ম্যানুয়াল ও নির্দেশিকা মুদ্রণ; ভোটের ফল প্রদর্শন, প্রচার, ডিজিটাল মনিটর স্থাপন ও যন্ত্রপাতি সংযোজন (ভোটের ১৫ দিন আগে)।
>আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক, ঋণখেলাপিদের সংগ্রহ তথ্য সংগ্রহ, ভোটকেন্দ্র থেকে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ভোট গণনার বিবরণী, ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি গঠনসহ সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবনা তৈরি।
>ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রাথমিক প্যানেল প্রস্তুতে কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা সংগ্রহে নির্দেশনা; তফসিল ঘোষণার পর রিটার্নিং কর্মকর্তা প্যানেল চূড়ান্ত করবে।
>উপজেলা নির্বাহী অফিসারের শূন্যপদ পূরণে জনপ্রশাসনকে অনুরোধ; সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিনে এবং অফিস সময়ের পরে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা;
>ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষ অনুসারে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নির্ধারণ করে রিটার্নিং অফিসারে কাছে তথ্য সংগ্রহ; ভোটের ১৫ দিন আগে নিয়োগ চূড়ান্ত ও প্রশিক্ষণ-সংক্রান্ত নির্দেশনা।
>আইন শৃঙ্খলা বিষয়ক প্রস্তাব ও সভার পরিকল্পনা; বিভিন্ন বাহিনী মোতায়েন, ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা পাঠানো সংক্রান্ত প্রস্তাব উপস্থাপন (তফসিল ঘোষণার পর কার্যক্রম গ্রহণ)।
>প্রশিক্ষণ, প্রচার : ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা; আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, ম্যাজিস্ট্রেট, ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি ও জেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা প্রণয়ন; প্রশিক্ষণ।
>তফসিলের আগে পরে ও ভোটের দিনের কাজ বিবেচনায় নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভা, বাজেট বরাদ্দ, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, সরকারের সব ধরনের সহায়তা, তথ্য প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, সমন্বয় সেল গঠন, ব্যালট পেপার ও নির্বাচন সামগ্রী আনা নেওয়াসহ কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ নানাবিধ কাজ রয়েছে।
>ফল সংগ্রহ ও পরিস্থিতি প্রতিবেদন।