বিমানের নারিতা ফ্লাইট বন্ধে প্রবাসীদের ক্ষোভ

লোকসানের দোহাই দিয়ে মঙ্গলবার (১ জুলাই) থেকে বন্ধ হয়েছে বিমানের বহুল আলোচিত নারিতা ফ্লাইট। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ফের চালুর মাত্র দেড় বছরের মাথায় এমন একটি ‘প্রেস্টিজিয়াস’ রুট বন্ধ করায় চরম সমালোচনার মুখে পড়েছে বিমান।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এমন সিদ্ধান্তে চরম হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাপানে যাতায়াতকারী যাত্রী ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা। যাত্রী চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বহুল প্রত্যাশিত এই রুট বন্ধ করে দেওয়াকে ‘হটকারী ও গর্হিত’ সিদ্ধান্ত বলে আখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, চলমান বিপুল সম্ভাবনার বাস্তবতা উপেক্ষা করে এমন সিদ্ধান্ত বিমানের ভবিষ্যৎ রুট পরিকল্পনা ও ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এভাবে যদি হঠাৎ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বন্ধই করে দেওয়া হয়, তাহলে চালুরই-বা কী দরকার ছিল? লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বন্ধ না করে বিমানের উচিত ছিল যেকোনো মূল্যে এটিকে হয় লাভজনক করা কিংবা অন্তত লোকসান কমিয়ে আনা।
বিমানের এই সিদ্ধান্তে জাপানে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যে মুহূর্তে প্রধান উপদেষ্টা আগামী পাঁচ বছরে কমপক্ষে এক লাখ লোক জাপানে কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিশ্চিত করেছেন, ঠিক সে সময়ে নারিতার ফ্লাইট বন্ধ করার মানে কী! এখন যদি লোকসানও হয়, বিপুল সম্ভাবনার সুযোগতো খুব নিকটেই। তাহলে কেন এই হটকারী সিদ্ধান্ত?
বেশ কয়েকজন জাপান প্রবাসী ইউএনবিকে বলেন, ‘দুনিয়ার এয়ারলাইন্সগুলো নতুন নতুন রুট খোলে এবং বহর বাড়ায়, আর আমাদের বিমান চলছে উল্টা পথে। দীর্ঘ ১৭ বছর পর ২০২৩ সালে যখন ঢাকা-নারিতা-ঢাকা রুটে সরাসরি ফ্লাইট চালু হয়, তখন অনেক খুশি হয়েছিলাম। কারণ এর আগে ট্রানজিট নিয়ে দেশে ফিরতে কোনো কোনো দেশের বিমানবন্দরে ২১ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। গত বছর সরাসরি ফ্লাইট চালুর পর আমরা মাত্র ৮ ঘণ্টায় দেশে ফিরতে পারতাম। সাময়িকভাবে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ হলেও আমাদের সেই আগের ভোগান্তিই পোহাতে হবে।’
ঢাকা-নারিতা ফ্লাইটের একাল-সেকাল
দীর্ঘদিন স্থগিত থাকার পর ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা-নারিতা-ঢাকা রুটে ফের ফ্লাইট চালু করেছিল বিমান। এর আগে ১৯৮০ সালের ২৫ মে প্রথমবারের মতো এই রুটে ফ্লাইট চালু করে রাষ্ট্রায়ত্ত এই সংস্থাটি। পরে কয়েক দফা চালু ও বন্ধের মুখে পড়ে এটি। ২০০৬ সালে রুটটি একবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে ফের চালু করা হয় নারিতা ফ্লাইট।
সে সময় অত্যাধুনিক ড্রিমলাইনার ৭৮৭ দিয়ে ফ্লাইট চালু করে বিমান। জাপান প্রবাসীদের মাঝেও তখন বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল। কারণ ওই সিদ্ধান্তের ফলে ঢাকা-জাপান যাতায়তে সময় কমে আসে মাত্র ৬ ঘণ্টায়।
শুরুতে ফ্লাইটে যাত্রীর সংখ্যাও ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে তা পর্যায়ক্রমে নিম্নমুখী হতে থাকে। তারপর বিমান পর্ষদ এ বছরের মে মাসে সিদ্ধান্ত নেয় যে, ১ জুলাই থেকে নারিতা রুট বন্ধ করা হবে।
এর ফলে বাংলাদেশ থেকে জাপানে সরাসরি যেতে আর কোনো ফ্লাইট থাকছে না। যাত্রীদের এখন তৃতীয় দেশের ট্রানজিট ব্যবহার করতে হবে, যা খরচ ও সময়—উভয়ই বাড়াবে। তবে প্রায় দেড় বছর পর রুটটি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যাত্রীদের জন্য হতাশাজনক হলেও দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এটি ছিল প্রত্যাশিত।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বিমানের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম ইউএনবিকে বলেন, ‘নারিতা ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়াটা অত্যন্ত দুঃখজনক। একটি দেশে ফ্লাইট চালু করে তা আবার বন্ধ করা গর্হিত অন্যায়। জাপান বন্ধু দেশ, যেখানে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, প্রবাসীরা আছেন। বাংলাদেশের জন্য পর্যটনের বড় উৎস দেশ জাপান। জাপান ফ্লাইটে ট্র্যাফিক ভালোই ছিল, আরও চাহিদা বাড়ত। এর মধ্যেই বন্ধ করে দেওয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। শুরু করলে ফ্লাইট চালু রাখা উচিত।’
কাজী ওয়াহিদ বলেন, ‘মাথা ব্যথা হলে তো চিকিৎসা দিতে হবে। বিমান তো সেটা না করে এখন মাথাই কেটে ফেলতে চাইছে। নারিতা রুট দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর দেশি বিদেশি অংশীজন ও প্রবাসীদের দাবির মুখেই অনেক আশা-উদ্দীপনা নিয়ে চালু করা হয়। এবার লক্ষণও ভালো ছিল, কিন্তু মাত্র দেড় বছরের মাথায় বন্ধ করা দেওয়াটা একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বিগত ওয়ান ইলেভেনের সময় বোয়িং থেকে ব্র্যান্ড নিউ দশটি বিমান কিনেছিলাম। সেগুলো দিয়েই বিমান টিকে আছে। তারপর থেকে বিমান একটি প্লেনও কিনতে পারেনি। এমনকি একটি প্লেন লিজও নিতে পারেনি। পৃথিবীর অনেক এয়ারলাইন্সই প্রেস্টিজিয়াস রুটগুলোতে লোকসান দিয়ে হলেও চালু রাখে। একটি এয়ারলাইন্সও সব রুটেই শুধু লাভের আশায় ফ্লাইট চালায় না। দশটায় লাভ করবে, দুটোতে লোকসান দেবে—এটাই তো নিয়ম। পৃথিবীর অনেক এয়ারলাইন্স লোকসান দিয়ে নিউইয়র্ক, নারিতা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রেস্টিজিয়াস রুটগুলো চালু রাখে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিমান একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। যেকোনো দেশে ফ্লাইট চালুর আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা জরুরি। কিন্তু বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, নতুন যেসব রুটে বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে, তার কোনোটিরই সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। হুট করে সরকারপ্রধান মনে করলেন—নতুন একটি দেশের সঙ্গে বিমানের ফ্লাইট চালু করা দরকার, সেটিই করা হয়েছে। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই করা হয়নি। ফলে গত পাঁচ বছরে যেসব রুটে বিমানের নতুন ফ্লাইট চালু হয়েছে, এখন সবগুলো লোকসানে আছে।’
এ বিষয়ে অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম ইউএনবিকে বলেন, ‘ইউএস বাংলা যদি এয়ারক্রাফট ক্রয় করতে পারে, বিমান পারে না কেন? সরকার কখন বিমান কিনে দেবে—এই আশায় তারা বসে থাকে।’
‘লোকসান হলেও নারিতা ফ্লাইট চালু রাখা দরকার ছিল। লোকসান তো হবেই। কারণ অন্যান্য এয়ারলাইন্স থেকে আমাদের বিমানের সিটগুলো কমফোর্টেবল নয়। শুধু শ্রমিকদের বিবেচনায় ছিট রাখলে তো হবে না! অন্যান্য ভালো যাত্রীদের চাহিদা মোতাবেক ভালোমানের সিটও থাকা দরকার। তাহলে যাত্রী বাড়াবে।’
তিনি বলেন, ‘একটি দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক রেখেই দুই দেশের মধ্যে ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। তাহলে তড়িত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফ্লাইট চালু করলেন কেন? এখন আবার তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে বন্ধই-বা কেন করলেন? এতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হয়; দেশের বদনাম হয়। লাভ না হলেও বিমানের উচিত ছিল রান করা (চালু রাখা)। দুই বছর না চালিয়ে হঠাৎ করে বন্ধ করাটা ঠিক হয়নি। কীভাবে লাভ করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার ছিল।’
জাপানের যাত্রীদের এখন তৃতীয় কোনো দেশের ট্রানজিট ব্যবহার করতে হবে, যা খরচ ও সময় উভয়ই বাড়াবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ফ্লাইট বন্ধে বিমান কর্তৃপক্ষের ভাষ্য
এ বিষয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) মো. সাফিকুর রহমান ইউএনবিকে জানান, ক্রমাগত লোকসান হওয়ায় ১ জুলাই থেকে ঢাকা-নারিতা রুটে ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন রুট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঢাকা-নারিতা রুটটি কোনোভাবেই লাভজনক নয়। তাই বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটি বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
তার ভাষ্যে, প্রতি ফ্লাইটে বিমানের ৯৫ লাখ টাকা লোকসান হয়। এভাবেতো আর লোকসান দেওয়া উচিত নয়। সে কারণে আপাতত বন্ধ করার সিদ্বান্ত নিয়েছে বিমান পর্ষদ।
এই রুটে ফ্লাইট বন্ধের কারণ হিসেবে বিমান দেখিয়েছে ক্রমাগত লোকসানের মুখে ব্যবসায়িক বাস্তবতা, উড়োজাহাজ ও ক্রু স্বল্পতা।
সংস্থাটির তথ্য অনুসারে, ঢাকা-নারিতা-ঢাকা রুটে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ২২৫টি ফ্লাইটের মাধ্যমে ৮৪ হাজার ৬৭৪ যাত্রী ও ২৩৬৫ টন কার্গো পরিবহন করে বিমান। এতে কেবিন ফ্যাক্টর ছিল শতকরা ৬৯ ভাগ। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২১৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, যা ফ্লাইটপ্রতি গড়ে ৯৫ লাখ ৮১ হাজার টাকা।
বিমানের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, নারিতায় সপ্তাহে দুটো ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়ে সেই ফ্লাইট দিয়ে ঢাকা-মাস্কাট, ঢাকা-দাম্মাম ও ঢাকা-মদিনায় অতিরিক্ত একটি করে ফ্লাইট চালালে লাভ হবে মাসিক অন্তত ৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই একটি রুট বন্ধ করা হলে অন্য তিনটি রুটকে আরও লাভজনক করা সম্ভব হবে।