সালিশি বৈঠকে তালাক, দুই ঘণ্টা পরই প্রেমিককে বিয়ে

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় সালিশি বৈঠকে স্বামী তালাক দেওয়ার দুই ঘণ্টা পর পরকীয়া প্রেমিককে বিয়ে করেছেন এক নারী (২৫)। গতকাল বুধবার (২৫ জুন) উপজেলার দক্ষিণ হিরণ গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে এলাকায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে।
পিঞ্জুরী ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার আনোয়ার হোসেন আনু বলেন, ৩ বছর আগে হিরণ ইউনিয়নের হিরণ গ্রামের সিদ্দিক মোল্লার ছেলে খায়রুল মোল্লা পিঞ্জুরী ইউনিয়নের চিতশী গ্রামের কেরামত আলী শেখের মেয়ে জেসমিন বেগমকে (২৫) বিয়ে করেন। বিয়ের দেড় বছর পর খায়রুল-জেসমিন দম্পতির একটি ছেলে হয়। জেসমিনের স্বামী খায়রুল ঢাকায় ফেরি করে বেডিংয়ের (লেপ-তোষক) ব্যবসা করতেন। জেসমিন হিরণ গ্রামের বাড়িতে থাকত। এ সুযোগে জেসমিন বেগম ওই গ্রামের আক্তার শেখের ছেলে হাসিব শেখের (২৫) সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে জেসমিনকে স্বামীর পরিবারের পক্ষ থেকে বারবার সতর্ক করা হয়। কিন্তু জেসমিন এ পথ থেকে ফিরে আসেনি। বুধবার (২৫ জুন) জেসমিনের শ্বাশুড়ি ফজরের নামাজ আদায় করতে ঘুম থেকে ওঠেন। তিনি জেসমিন ও হাসিবকে জেসমিনের ঘরে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পান। পরে তাদের ঘরের মধ্যে আটক করে রাখা হয়।
ইউপি মেম্বার আরো বলেন, এ ঘটনা নিয়ে বুধবার (২৫ জুন) বিকেলে খায়রুলের বাড়িতে সালিশ বৈঠকের আয়োজন করা হয়। সালিশ বৈঠকে এলাকার জনপ্রতিনিধিসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠকে খায়রুল ও তার স্ত্রী জেসমিন বেগম একে অপরের ঘর করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। খায়রুল তাকে তালাক দেবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। বুধবার সন্ধ্যায় কাজীর মাধ্যমে মাধ্যমে তালাক দেওয়া হয়। পরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে অ্যাডভোকেট বজলুল হক হওলাদারের কোটালীপাড়া উপজেলার ঘাঘর বাজারের চেম্বারে ৪ লাখ টাকা দেনমোহরে হাসিব শেখ (২৫) প্রেমিকা জেসমিন বেগমকে বিয়ে করেন। এ সময় ওই আইনজীবী তার চেম্বারে ছিলেন না।
এ ব্যাপারে আইনজীবী বজলুল হক হওলাদার বলেন, সালিশ শেষে সন্ধ্যার পর ২৫-৩০ জন আমার চেম্বারে আসেন। ধর্মীয় দৃষ্টিতে এটি নিয়ে বাধা আছে। তাই আমি তাদের কোন কথা শুনিনি। আমি এশার নামাজ আদায় করতে মসজিদে যাই। এ সময় আমার চেম্বারে হুজুর ডেকে হাসিব ও জেসমিনকে সরা পড়িয়ে দিয়েছেন বলে জানতে পারি।
সালিশ বৈঠকে পিঞ্জুরী ইউনিয়নের কাঠি গ্রামের মুরুব্বি আনোয়ার হোসেন ফকির, চিতশী গ্রামের আনোয়ার হোসেন আনু, গিয়াস উদ্দিন মাস্টারসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
এই বিয়েতে খুশি বলে জানান হাসিব শেখ ও জেসমিন বেগম। বিয়ের পর তারা সুখি দাম্পত্য জীবনের জন্য সকলের কাছে দোয়া চান।
হিরণ ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নান্নু দাঁড়িয়া বলেন, আমি অসুস্থ। তাই ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছিলাম। তখন কয়েক গ্রামের মুরব্বিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ওই সালিশে উপস্থিত ছিলেন। আমাকে সেখানে ডাকলে আমি বিষয়টি এড়িয়ে মুরিব্বিদের বিচার করে দিতে বলে চলে আসি।
এ বিষয়ে ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী কাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, তালাক দেওয়ার পর ৯০ দিন সময় দিতে হয়। তাই তালাকের ২ ঘণ্টা পর বিয়ে দেওয়া শরীয়ত ও আইন সম্মত নয়। এটি হবে অনিয়মিত বিয়ে। মুসলিম বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন অনুযায়ী বিবাহ রেজিস্ট্রি না হওয়ায় এটি বিবাহ হিসেবে গণ্য হবে না।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খান চমন-ই-এলাহী বলেন, ‘এভাবে তালাক দেওয়ার দুই ঘণ্টা পর বিয়ে দেওয়া শরিয়ত ও আইন সম্মত হয়নি। এ ধরনের সালিশ-দরবার যারা করেন, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা উচিত।’
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কোটালীপাড়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক রতন সেন কংকন বলেন, ‘নারী-শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের সালিশ অযোগ্য অপরাধও এখন কোটালীপাড়ায় সালিশ-দরবারের মধ্যে ফয়সালা হচ্ছে। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগী সঠিক বিচার পায় না বলে আমি মনে করি। তাই এ ধরনের সালিশ অযোগ্য অপরাধ যে সকল জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ সালিশ-দরবারের মাধ্যমে ফয়সালা করে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’
এ বিষয়ে কোটালীপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষ থেকে অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক আইনগতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’