সাদা বাবু ১১ লাখ, কালু ৮ লাখ

শনিরআখড়ার পশুর হাটে একটি গরু পছন্দের পর ক্রেতা আতিকুল হক দাম জানতে চাইলে, মিনিট পাঁচেক নীরব থাকেন বিক্রেতা ফরিদপুরের রহমান। পরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে রহমান বলেন, ‘ওর নাম সাদা বাবু। অতিযত্ন ও মমতায় লালন পালন করেছি। ন্যাচারাল সব খাবার খেয়ে গত চার বছর আমার পরিবারের একজন সদস্য হয়েই বেড়ে ওঠেছে। রোদ ও বৃষ্টি থেকে রক্ষায় রেখেছি পাকা ঘরে।’ পরে মাটির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস দিয়ে রহমান বলেন, সাদা বাবুর দাম ১১ লাখ টাকা।
একই পশুর হাটে নড়াইল থেকে এসেছে একটি গরু, নাম কালু। বেচতে আসা সোহেল বলেন, ‘আমার ঘরে পালা আদরের কালু। সবার হাতে কালু খায় না। খুব যত্ন করে লালন-পালন করতে হয়েছে। এতে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে। কালুর দাম চাচ্ছি আট লাখ টাকা।’
কুষ্টিয়া থেকে এসেছে দুটি গরু। এর মধ্যে একটির নাম লাল পাহাড়। বেচতে আসা জহিরুল বলেন, ‘আমার পালের শান্ত মেজাজের গরু লাল পাহাড়। ওর খাবার সবই ন্যাচারাল। লাল পাহাড়ের দাম চাচ্ছি সাত লাখ টাকা।’ তেমনি কুমিল্লা থেকে গরু বেচতে আসা আবদুল বাতেন বলেন, ‘ঘরের পালা একটি গরু হাটে এনেছি। দাম চাচ্ছি সাত লাখ টাকা।’ বগুড়া থেকে ঘরে পালা তিনটি গরু নিয়ে এসেছেন মোহাম্মদ দুদু। গরু তিনটির দাম চাচ্ছেন ১২ লাখ টাকা। ব্যাপারিদের এমন আবেগের গল্প যেন পুরো পশুর হাটজুড়ে একাকার হয়ে ওঠেছে।
অজ বৃহস্পতিবার (৫ জুন) সরেজমিনে শনির আখড়ার হাটে দেখা যায়, গরু বেচতে গিয়ে কাঁদছেন অনেক ব্যাপারি। কেউ কেউ আদরের শেষ পরশ দিচ্ছেন। বিদায় বেলায় অনেকেই আদরের পশুটিকে জড়িয়ে ধরে থাকছেন অনেকক্ষণ। বিক্রি করে অনেকে নীরবে তাকিয়ে থাকছেন। পশু বিক্রি করে কেউ কেউ অতিকষ্টে টাকা নিজে না গুনে অন্যকে দিয়ে গোনাচ্ছেন। বিক্রি করে অনেকেই আবার অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছেন পালিত পশুটিকে।
পশুর হাটে কথা হয় মাদারীপুরের শিবচর বাসিন্দা ব্যাপারি দিদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঝড় বৃষ্টিতে এবার গরুগুলো অনেক কষ্ট পেয়েছে। বেশকিছু গরুর ঠান্ডা লেগেছে। তিনি বলেন, গত সোমবার ছোট ও মাঝারি ৩৩টি গরু নিয়ে হাটে এসেছি। এবারে ক্রেতা খুবই কম। যারা আসছেন, খুবই কম দাম বলছেন। এই পর্যন্ত গরু বিক্রি করেছি চারটি, প্রত্যাশার অনেক কম দামে। এই পশুর হাটে বেচাবিক্রি খুবই কম জানিয়ে ব্যাপারি রুবেল বলেন, আমার খামার ঢাকার কাজলায়। গত তিনদিন আগে হাটে ২৮টি গরু এনেছি। বিক্রি করেছি পাঁচটি। বাজার খারাপ, কম দামে গরু বিক্রি করতে হয়েছে।
শনিরআখড়ার পশুর হাট থেকে এক লাখ ৪০ হাজার টাকার দিয়ে গরু কিনেছেন রায়েরবাগের বাসিন্দা আবুল খায়ের। তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। গরু কিনতে ঘুরতে হয়নি। হাটে ঢুকেই পাঁচ মিনিটেই কিনেছি গরু। এবার দাম বেশি না, দাম ঠিকঠাক আছে বলে জানান তিনি।
২৪টি গরু নিয়ে পশুর হাটে এসেছেন শেরপুরের ব্যাপারি রাসেল। তিনি বলেন, আমার এখানে দুই লাখ থেকে চার লাখ টাকার দামের গরু রয়েছে। তবে বাজারে বেচাকেনা নেই। গত তিনদিনে ছয়টি গরু বিক্রি করেছি, সামান্য দামে। তিনি আরও বলেন, কাস্টমার আছে তবে কিনছে কম। দাম হাঁকাচ্ছেন কিন্তু প্রত্যাশিত দামের অনেক কম বলছেন ক্রেতারা। হাটে ৫০টি গরু নিয়ে এসেছি, এর মধ্যে সাতটি বিক্রি হয়েছে জানিয়ে ফরিদপুরের ব্যাপারি নুরুজ্জামান বলেন, দেড় লাখ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকার দামের গরু রয়েছে এখানে। আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, বাজার খারাপ, সবাই গরুর দাম কম বলছে। এবার মনে হচ্ছে ধরা খাবো।
কাজলায় কথা হয় গরু ক্রেতা আবু হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি সব সময় ছোট সাইজের গরু কোরবানি দিয়ে থাকি। বাজেট এক লাখ টাকার মধ্যে। খুব সহজেই পেয়েছি বাজেটের মধ্যে গরু। এখন গরু নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। গরুর কিনে বাড়ি যাচ্ছে এমন ডজন খানেক ক্রেতারা সঙ্গে কথা হয়। তারা বলছেন, এবার বাজেটের মধ্যে পছন্দমতো গরু পেয়েছেন সবাই। দামও ঠিকঠাক বলছেন তারা।
শনিরআখড়ার পশুর হাটের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সৈয়দ আবুল কালাম বলেন, গরুর বেচা এখনো জমে ওঠেনি। বাজারে ক্রেতা আছে, তবে কিনছে কম, তারা দেখছে। আশা করছি, আজ বিকেল থেকে বাজার বেচাবিক্রিতে জমে উঠবে। তিনি বলেন, বৃষ্টির কারণে অনেক সমস্যা হয়েছে। তবে গরু ও বেপারিরা যেন কষ্ট না পায়, সেজন্য সবধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাজারে ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর সংখ্যাই বেশি জানিয়ে আবুল কালাম বলেন, হাটে অনেক বড় সাইজের গরুও আছে। একটি গরু আট-দশ লাখ টাকারদাম চাচ্ছেন, এমন গরুও আমাদের এখানে আছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সাল মিলিয়ে গড়ে বছরে ৫৪ লাখের বেশি গরু-মহিষ কোরবানি হয়েছে। ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে গড়ে ৪৭ লাখ ৩৩ হাজার গরু-মহিষ কোরবানি হয়েছে। গরু-মহিষ কোরবানি কমেছে গড়ে ১৪ শতাংশ।