বাকৃবি গবেষকের পরামর্শ
যেসব তথ্য জানলে কোরবানির পশু কিনে ঠকবেন না

কোরবানির হাটে পশু আনা থেকে শুরু করে কোরবানির পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ সামগ্রিক প্রক্রিয়া কীভাবে নিরাপদ, বৈজ্ঞানিক ও জনস্বাস্থ্যবান্ধবভাবে সম্পন্ন করা যায়, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক, ইন্টার ডিসিপ্লিনারি ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটির (আইআইএফএস) পরিচালক এবং ভেটেরিনারি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ভ্যাব) সভাপতি ড. মো. মাহবুব আলম।
সম্প্রতি ইউএনবিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. মো. মাহবুব আলম এসব কথা বলেন। কোরবানির জন্য উপযুক্ত পশু চিনে বাছাই করা, তার যত্ন এবং বেশকিছু সতর্কতার কথা উঠে আসে এই বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপচারিতায়।
সুস্থ ও অসুস্থ পশুর বৈশিষ্ট্য
কোরবানির পশু শুধু কিনলেই হবে না, সেটি সুস্থ কিনা, কিংবা কোনোপ্রকার রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে পশুটিকে মোটাতাজা করা হয়েছে কি না— এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন ড. মাহবুব আলম।
সুস্থ পশুর লক্ষণ বর্ণনা করতে গিয়ে ড. মো. মাহবুব আলম বলেন, ‘সুস্থ পশু এমনিতেই চঞ্চল থাকবে, জাবর কাটবে, নাক ও মাজল ভেজা থাকবে। বিশেষ করে গরু, মহিষ বা ষাঁড়ের ক্ষেত্রে চামড়া টানটান ও পিঠের কুঁজ মোটা হবে, সব সময় কান ও লেজ নাড়াচাড়া করবে।’
ড. মো. মাহবুব আলম আরও বলেন, ‘সুস্থ পশুর চোখ উজ্জ্বল থাকবে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতি সেটি সজাগ থাকবে। এ ছাড়া খাবার দিলে আগ্রহ নিয়ে খাবে এবং স্বাভাবিকভাবে মলমূত্রও ত্যাগ করবে।’
অসুস্থ পশুর মধ্যে দুর্বল, ঝিমানো, কম চলাফেরা, খাবারে অনীহার মতো বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। পাশাপাশি এ ধরনের পশুর মুখ দিয়ে লালা পড়বে, শরীর থলথল করবে ও কান নিচের দিকে ঝুলে থাকবে বলেও উল্লেখ করেন ড. মো. মাহবুব আলম।
স্টেরয়েড বা হরমোন প্রয়োগ করা পশু
পশুকে পেশিবহুল ও মাংসল দেখানোর উদ্দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোরবানির পশুর শরীরে স্টেরয়েড ট্যাবলেট বা ইনজেকশন প্রয়োগের প্রবণতা বেড়েছে। অনেক অসাধু খামারি এবং পশু ব্যাবসায়ীই এ ধরনের কাজ করে থাকেন।
স্টেরয়েড প্রয়োগ করা পশুর মাংস খাওয়া মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অনেক সময় তা বিপজ্জনকও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে এই ধরনের পশু চিনব কীভাবে, সেই প্রশ্ন রাখা হয়েছিল বাকৃবির মেডিসিন বিভাগের এই অধ্যাপকের কাছে।
উত্তরে ড. মো. মাহবুব আলম বলেন, ‘স্টেরয়েড ট্যাবলেট খাওয়ানো বা ইনজেকশন দেওয়া গরু হবে অনেকটাই শান্ত প্রকৃতির; তারা ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারবে না, বিশেষ করে পশুর উরুতে অনেক মাংস রয়েছে বলে মনে হবে। আবার শ্বাস-প্রশ্বাস ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেও গরুকে ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়।’
ড. মাহবুব বলেন, ‘ট্যাবলেট খাওয়ানো গরুর শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়, মনে হয় যেন হাঁপাচ্ছে। তাছাড়া এ ধরনের একটি গরুকে প্রচণ্ড ক্লান্ত দেখায়।’
হাটে চকচকে চামড়ার যে গরু সহজেই নজর কাড়বে, সেটিই ট্যাবলেট প্রয়োগ করা গরু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে জানান তিনি।
ড. মো. মাহবুব আলমের ভাষ্য, ‘মানুষের শরীরের কোনো অংশ ফুলে গেলে বা পানি জমলে সেই অংশের ত্বক যেমন চকচক করে, ট্যাবলেট খাইয়ে মোটা করা গরুগুলোও তেমনি চকচকে হয়। অতিরিক্ত হরমোনের কারণে পুরো শরীরে পানি জমে পশুর শরীর মোটা দেখায়। এ ধরনের পশুর শরীরে আঙুল দিয়ে চাপ দিলে সেখানে দেবে গিয়ে গর্ত হয়ে থাকবে।’
ড. মো. মাহবুব আলমের মতে, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মোটা গরু না কেনাই ভালো। কারণ বেশি চর্বিযুক্ত মাংস খাওয়া ঠিক নয়। তার ওপর স্টেরয়েড ট্যাবলেট খাওয়ানো বা ইনজেকশন দেওয়া গরুগুলো বেশি মোটা হয়ে থাকে। তাই দেশি জাতের গরু কেনা উচিত।
কারণ হিসেবে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বিদেশ থেকে আসা পশুর সঙ্গে অনেকসময় নানা রকম সংক্রামক রোগ চলে আসার সম্ভাবনা থাকে। পাশাপাশি অনেক দূর থেকে আসে বলে পশুগুলোও অনেক ক্লান্ত থাকে। ফলে পশুটি সুস্থ নাকি অসুস্থ, তা সঠিকভাবে বোঝা যায় না।’
এ ছাড়া দিনের আলো থাকতে থাকতেই কোরবানির পশু কিনে ফেলা উচিত বলে জানান তিনি। কারণ রাতের বেলায় অনেকসময় রোগাক্রান্ত পশু দেখে বুঝতে অসুবিধা হতে পারে বলে মনে করেন ড. মো. মাহবুব আলম।
ব্রয়লার ফিড খাওয়ানোর ঝুঁকি
গরু মোটাতাজা করতে ব্রয়লার ফিড খাওয়ানো মারাত্মক বিপজ্জনক বলে মনে করেন অধ্যাপক মাহবুব। এ বিষয়ে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গরুকে অনেক খামারি মনে করেন মুরগির ফিড খাওয়ালে গরু মোটা হয়, কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। এই ফিডের কারণে গরুর চামড়ার নিচে পানি জমে, যার ফলে গরুকে নাদুসনুদুস দেখায়; কিন্তু জবাই করার পর দেখা যায় মাংস হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো চুপসে যায় এবং ওজনও কম হয়।
ড. মো. মাহবুব আলম জানান, মুরগি ও গরুর হজম প্রক্রিয়া ভিন্ন হওয়ায় গরু এই ফিড হজম করতে পারে না। ফলে কিডনি, লিভার, ফুসফুসে পানি জমে এবং এতে গরুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
এ ছাড়া ব্রয়লার ফিডে থাকা উচ্চমাত্রার প্রোটিন, এনার্জি ও স্টার্চ গরুর দেহে অতিরিক্ত তাপ, চর্বি ও মেটাবলিক হিট তৈরি করে, যা হিটস্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও পেটের নানা সমস্যার কারণ হয়।
এই ফিডে থাকা উপাদান গরুর মাংসের মানও নষ্ট করে জানিয়ে নিরাপদ মোটাতাজাকরণে গরুর জন্য উপযুক্ত ও পুষ্টিকর খাদ্য ব্যবহার জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কোরবানির পশুর রোগ নির্ণয়
এই পশু বিশেষজ্ঞের মতে, শরীরের গঠন, হাঁটার ভঙ্গি বা অবস্থান দেখে পশুর হাড় বা পেশিতে কোনো সমস্যা আছে কি না, সে বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। আবার চামড়ার কিছু অংশ ঘষে চর্মরোগ, যেমন: চুলকানি, ছত্রাক সংক্রমণ বা অ্যালার্জির মতো সমস্যা নির্ণয় করা যায়। এ ছাড়াও পশুর, বিশেষ করে গরুর ক্ষেত্রে চামড়ায় গুটির মতো ফোলা ফোলা ছোট ছোট গোটা দেখে এলএসডি রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। পাশাপাশি ক্ষুরের অস্বাভাবিকতা, যেমন: খুব মোটা ও বাঁকা হওয়া শরীরের ভেতরের কোনো রোগের লক্ষণ হতে পারে। আবার লালচে চোখ ও কর্নিয়ার ক্ষত দেখে চোখের রোগ নির্ণয় করা যায় বলে জানান তিনি।
পশুর বয়স নির্ধারণের মিথ্যা বনাম বাস্তবতা
পশুর দাঁত, ক্ষুর ও শিং দেখে বয়স নির্ণয় করা আমাদের সমাজে অতি প্রচলিত ও পুরোনো প্রথা। তবে এসব মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে পশুর বয়স নির্ণয় করতে গেলেও সঠিক বিষয়গুলো না জানা থাকায় অনেক সময় তা নির্ণয়ে ভুল হয়।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাকৃবির এই অধ্যাপক বলেন, ‘বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে খামারের মালিকের রেকর্ডবই দেখে জন্ম-তারিখ নির্ণয় করা। অনেক সময় মাঠপর্যায়ে দাঁত ও শিং দেখে (পশুর) বয়স নির্ধারণ করা হয়ে থাকে, যা তুলনামূলক কম নির্ভরযোগ্য।’
ড. মো. মাহবুব আলম বলেন, ‘জন্মের এক মাসের মধ্যে ৮টি অস্থায়ী কর্তন দাঁত ওঠে। এক বছরে মাঝের দুটি পড়ে গিয়ে দুটি স্থায়ী দাঁত ওঠে। দুই-আড়াই বছরে দুটি, তিন বছরে চারটি ও চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে আটটি স্থায়ী দাঁত পূর্ণরূপে গজায়। এরপর পাঁচ-ছয় বছর থেকে দাঁতের ক্ষয় শুরু হয়। ফলে কেবল দাঁতের সংখ্যা দেখেই বয়স নির্ণয় করে ফেললে তা বেশিরভাগ সময়ে ভুল হতে পারে। কারণ দাঁতগুলো অস্থায়ী নাকি স্থায়ী, তা দেখেই তো আর বোঝা যায় না সবসময়।’
শিং দেখে বয়স নির্ণয়ের ব্যাপারে অধ্যাপক মাহবুব আলম জানান, শিংয়ের রিং দেখেও বয়স অনুমান করা যায়। শিংয়ের গায়ে বলয়ের মতো কিছু চক্র বা দাগ থাকে, যাকে হর্ন রিং বলা হয়। সাধারণত প্রথম রিংটি গঠিত হয় আড়াই থেকে তিন বছর বয়সে। পরবর্তীতে প্রতি বছরে একটি করে রিং গঠিত হয়। তার মতে, শিংয়ে যদি চারটি রিং দেখা যায়, তাহলে গরুর বয়স হবে আড়াই বছর (প্রথম বাচ্চা দেওয়ার বয়স) এবং ৪ বছর; অর্থাৎ সাড়ে ৬ বছর।
পশু পরিবহণে সতর্কতা
কোরবানির পশু পরিবহণের বিষয়ে এই গবেষক বলেন, আমাদের দেশে দেখা যায় গাদাগাদি করে অনেক পশু একটি ট্রাক বা যানবাহনে করে পরিবহণ করা হচ্ছে। এতে ওই পশুগুলোর মধ্যে স্ট্রেস তৈরি হয়।
তার ভাষ্য, ‘পশুর দেহে স্ট্রেস সৃষ্টি হলে স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং কর্টিসল, অ্যাড্রেনালিন ও নর-অ্যাড্রেনালিন নামক হরমোন নিঃসরণ হয়। এতে শরীরের বিপাকক্রিয়া বেড়ে যায়, হৃদস্পন্দন ও দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে দেহের পেশিতে জমে থাকা গ্লাইকোজেন দ্রুত ক্ষয় হয়। এই গ্লাইকোজেন কমে যাওয়ার ফলে মাংসের পিএইচ (pH) বেড়ে যায়, যা মাংসকে শক্ত বা কম কোমল করে তোলে।’
তাই মাংসের গুণমান অক্ষুণ্ন রাখতে কোরবানির আগে পশু পরিবহণের সময় যতটা সম্ভব স্ট্রেসমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি বলে পরামর্শ দেন তিনি।
পশু পরিবহণে আইনের বিধানও আছে
বাংলাদেশে পশু পরিবহণের সময় পশু কল্যাণ আইন লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
নির্যাতনের মাত্রা বেশি হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যদি নিষ্ঠুরতা অত্যন্ত গুরুতর হয়, তাহলে জরিমানাসহ সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
তাই কোরবানির পশুর প্রতি নির্দয় না হয়ে বরং সদয় আচরণ করা উচিৎ বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম।