অনাহারে-অর্ধাহারে থাকা কন্যারাই করেছে ‘বিশ্বজয়’

বাংলাদেশের ক্রীড়াপ্রেমীদের কমবেশি সবাই জানেন কলসিন্দুর গ্রামের নামটা। ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী এই গ্রামের অদম্য কিছু কিশোরীই বাংলাদেশের ফুটবলকে এনে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক সাফল্য। গত বছর এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ টুর্নামেন্টের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাজয়ী দলের ১০ জনই ছিল এই কলসিন্দুরের মেয়ে। কয়েক দিন আগে শেষ হওয়া এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বেও দারুণ সাফল্য পাওয়া দলের বেশ কয়েকজন এসেছে কলসিন্দুর গ্রাম থেকে। কলসিন্দুরের এই ফুটবল কন্যাদের কীর্তির কথা সবার মুখে মুখে ফিরলেও অনেকেই হয়তো জানেন না তাদের দারিদ্র্যপীড়িত জীবনের কথা।
ধোবাউড়া উপজেলা সদর থেকে আরো ১০ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে যেতে হয় কলসিন্দুর গ্রামে। ময়মনসিংহ থেকে দুরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। সেই অজপড়াগাঁওয়ের কলসিন্দুর স্কুল থেকেই কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেদের তৈরি করেছে এই ফুটবলাররা। মাঝেমধ্যেই তাদের দিন কাটাতে হয়েছে অনাহারে-অর্ধাহারে। তবে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি মার্জিয়া, নাজমাদের অদম্য ইচ্ছের সামনে। আজ তাদের গৌরবগাঁথার অংশীদার পরিবার, এলাকাবাসীসহ পুরো দেশের মানুষ। তবে কলসিন্দুরের এই ফুটবল কন্যাদের দারুণ সাফল্যে পরিবার ও শুভাকাঙ্খীদের মধ্যে গৌরবের চেয়ে ক্ষোভের মাত্রাটাই যেন বেশি।
কারণ দারুণ ফুটবল খেলে পুরো দেশের নাম উজ্জ্বল করলেও নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেনি কেউই। এখনো রিকশা চালাতে হচ্ছে মার্জিয়া খাতুনের বাবা মোতালিবকে। চায়ের দোকানই একমাত্র জীবিকা নাজমার বাবা আবুল কালামের। তাসলিমার বাবা সবুজ মিয়া সবজি বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। কৃষিকাজ করছেন মারিয়ার মা এনতা মান্দা। অনেকের মনেই ঘুরছে একটা প্রশ্ন : দেশের জন্য এত গৌরব বয়ে আনা ফুটবল কন্যাদের পরিবারে স্বচ্ছলতা আসছে না কেন? সরকার ও দেশ তাদের কী দিয়েছে, এমন প্রশ্ন ছিল অনেকের কণ্ঠে। তাদের ভাষায়, যারা ফুটবল খেলে দেশের জন্য এত গৌরবময় সম্মান বয়ে আনল তারা কী পেল?
মার্জিয়ার বাবা মোতালিব কিছুটা আক্ষেপ নিয়েই বলেছেন, ‘তার (মার্জিয়া) খাওয়াদাওয়া সব কিছুই আলাদা করে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হয়। সে খেলার জন্য অনেক পরিশ্রম করে। কিন্তু সে অনুযায়ী তাকে খেতে দিতে পারি না।’ পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য সরকারের কাছে আলাদা করে কিছু দাবি করেননি মোতালিব। তবে দেশের নাম উজ্জ্বল করা এই ফুটবলারদের জন্য সরকার নিজ উদ্যোগেই কিছু করবে এমনটাই আশা মার্জিয়ার বাবার। নাজমার বাবা আবুল কালামও সুর মিলিয়েছেন মোতালিবের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা সরকারের কাছে কী চাইয়াম? মেয়েরা বিদেশে দেশে চ্যাম্পিয়ন অইছে। সরকার ইচ্ছা করলেই দিতে পারে। মেয়েরার বাপের তো কিছুই নাই। সবাই দিনমজুর গরিব। আমি দিন আনি দিন খাই, চা দোকান করি।’
এলাকাবাসীর কণ্ঠেও শোনা গেছে ক্ষোভ আর নানা দাবির কথা। তারা কলসিন্দুরের এই ফুটবল কন্যাদের জন্য উন্নত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুযোগ, বৃত্তি প্রদান, বাসস্থানের দাবি করেছেন সরকারের কাছে। বাংলাদেশের ফুটবলের উন্নয়নের জন্য এ রকম তৃণমূল পর্যায়ের খেলোয়াড়দের নানাবিধ সহযোগিতা দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন মার্জিয়া-নাজমাদের কোচ মফিজুর রহমান। তিনি কিছুটা আক্ষেপের সঙ্গেই বলেছেন, ‘মেয়েরা বিদেশ থেকে খেলে আসার পর তাদের হাতে সাড়ে ছয় হাজার করে টাকা দেওয়া হয় বাড়ি ফেরা ও হাত খরচের জন্য। যারা সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে তাদের জন্য আরো ভালো কিছু করা দরকার।’