পয়লা বৈশাখে রক্তে রঞ্জিত হয় ভৈরব

১৯৭১ সালের সেদিনও ছিল পহেলা বৈশাখ। সারা দেশে যুদ্ধের দামামা বাজলেও বাণিজ্যকেন্দ্র ভৈরবের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছিল ‘হালখাতা’ উৎসব পালনের প্রস্তুতি। হঠাৎ করে ভৈরবের আকাশে দেখা যায় চারটি জেট বিমান, একাধিক হেলিকপ্টার এবং স্থলপথে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপার নরসিংদীর রায়পুরার রামনগর ব্রিজসংলগ্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আনাগোনা। পাকিস্তানি বাহিনী ওই এলাকা থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে ভৈরব শহরের দিকে অগ্রসর হয়।
ভৈরবের শিবপুর ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র নদের তীর পানাউল্লাহর চরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ হামলায় পাঁচ শতাধিক মানুষ নিহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার গুলি থেকে সেদিন নারী-শিশুরাও রেহাই পায়নি।
হানাদার বাহিনীর ভয়ে নিহতদের আত্মীয়-স্বজনরা লাশগুলোও দাফনও করতে পারেননি তখন। পরবর্তী সময়ে পাঁচ শতাধিক লাশ ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে গণকবর দেওয়া হয়। ভৈরবের মানুষ আজও ভুলতে পারেনি সেই মর্মান্তিক গণহত্যার কাহিনী। প্রতিবছরের ১৪ এপ্রিল ভৈরবের মানুষ ‘গণহত্যা দিবসে’ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শোক পালন করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল দুপুরে সামরিক বাহিনীর কয়েকটি হেলিকপ্টার থেকে ভৈরবের মধ্যের চর এলাকায় সেনা নামানো হয়। সেনাসদস্যদের দেখে সাধারণ মানুষ প্রাণভয়ে পালাতে থাকে। পাকিস্তানি সেনারা শহরে প্রবেশ করার সময় পথে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ করে মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ভৈরব উপজেলার কালিকাপ্রসাদ গ্রামের ৭০ বছর বয়স্কা হামিদা বেগম এনটিভি অনলাইনকে জানান, তাঁর স্বামী কাদির মিয়া তাঁকে এবং দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে খেয়া পারাপারের অপেক্ষায় ছিলেন। আচমকা পাকিস্তানি বাহিনীর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণে হতভম্ব হয়ে যান তাঁরা। এ সময় তিনি দুই শিশুসন্তানকে বুকে চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাণ্ডব শেষে তাঁর কোলে চেপে রাখা মেয়েশিশুটি বেঁচে গেলেও হাতে ধরে রাখা ছেলেশিশুটি গুলিতে মারা যায়। পরে অল্প দূরে স্বামী কাদির মিয়ার রক্তাক্ত লাশও পড়ে থাকতে দেখেন তিনি।
পৌর এলাকার কমলপুর গ্রামের মো. বিল্লাল হোসেন মোল্লা জানান, ওই দিনের ঘটনায় তাঁর নানা আবদুল কাদির মাস্টার, মামা গিয়াস উদ্দিন আহমেদ নাগর, চাচাতো নানা নাজির হোসেনসহ পরিবারের চারজন মারা যান।
ভৈরব উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার মো. সায়দুল্লাহ মিয়া এনটিভি অনলাইনকে জানান, ‘মর্মান্তিক ওই ঘটনার মাত্র ৫-১০ মিনিট আগে আমি খেয়া পাড়ি দিয়ে বর্তমান বেলাবো উপজেলার ইব্রাহিমপুর গ্রামে যাই। নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে সেখানে এসে দেখি লাশ আর লাশ। অনেকের মতো আমিও সেদিন বহুলোককে সেখানে গণকবর দিই।’
শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘর আসরের জাতীয় পরিষদের সদস্য অধ্যাপক সত্যজিৎ দাস ধ্রুব এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধের ৪৪ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো পানাউল্লাহর চরের মর্মান্তিক সেই ঘটনায় শহীদদের নামের তালিকা তৈরি হয়নি।’ তিনি অবিলম্বে এ তালিকা তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।