বেঁচে যাওয়া জাপানির স্মৃতিতে দুঃসহ সেই রাত

দুই সপ্তাহ আগে ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া একমাত্র জাপানি নাগরিক জানালেন দুঃসহ সেই রাতের স্মৃতি। গত মঙ্গলবার টোকিওর হাসপাতালে শুয়ে জাপান সরকারের তদন্ত কমিটিকে তিনি সেই রাতের বর্ণনা দিয়েছেন, যা আজ বৃহস্পতিবার জাপানের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
জাপানের আলমেক করপোরেশন নামে একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের কর্মী তামাওকি ওতানাবে জানিয়েছেন, নিজের বুদ্ধিমত্তায় গাছের আড়ালে আত্মগোপন করে তিনি প্রাণ বাঁচিয়েছেন। জাপান পুলিশ ডিপার্টমেন্টের তিনটি বিভাগ এবং মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিপার্টমেন্টের যৌথ তদন্তকারী দলের কাছে তিনি এ তথ্য জানান।
জাপান টাইমসের বরাত দিয়ে ডেইলি স্টার অনলাইন জানায়, ওতানাবেসহ আট জাপানি নাগরিক গত ১ জুলাই সন্ধ্যায় গুলশানে বিদেশিদের কাছে জনপ্রিয় ওই ক্যাফেতে গিয়েছিলেন রাতের খাবার খেতে। ওই আটজনের মধ্যে কেবল ওতানাবেই বেঁচে ফিরতে পেরেছেন।
পত্রিকাটি আরো জানায়, ২০১৩ সালে আলজেরিয়ায় ১০ জাপানি আইএসের হাতে নিহত হওয়ার পর বিদেশের মাটিতে এবারই একসঙ্গে সাত জাপানি নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটল।
জাপানের জাতীয় পুলিশের গড়া তদন্ত সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওতানাবে জানিয়েছেন, খেতে বসার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ গুলির শব্দে তিনি উঠে দৌড় দেন। সঙ্গে থাকা বন্ধুরাও রেস্তোরাঁর ভেতরে ছোটাছুটি শুরু করে দেন। হামলাকারীরা তখন এলোপাতাড়ি গুলি করছিল।
গোলাগুলির মধ্যেও ওতানাবে বেকারি ভবনের বাইরে বেরিয়ে কম্পাউন্ডের ভেতরে গাছের আড়ালে গিয়ে লুকান। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা অপর এক জাপানি বন্ধু গুলি খেয়ে পড়ে যান। ওতানাবে জানান, পালানোর সময় তাঁর মুখের একপাশে গুলি লাগে। গুলি আর একটু হলেই তাঁর মাথায় লাগত। এতে তিনিও বাঁচতেন না। বাইরে বেরিয়ে আসার পর সঙ্গে থাকা জাপানি বন্ধুদের আর কাউকে তিনি দেখতে পাননি বলেও জানিয়েছেন তিনি।
ওতানাবে পালিয়ে হলি আর্টিজানের পাশের আরেকটি ভবনে আশ্রয় নেন। ঢুকে বুঝতে পারেন ওই ভবনটিও রেস্তোরাঁর। এ ভবনটিতে পিৎজা তৈরি করা হয়। ওখানেই সারা রাত অবস্থান করেন তিনি। সকালে সেনাবাহিনীর অভিযানের পর তিনি উদ্ধার পান। ওতানাবে জানান, অন্য জাপানিদের কীভাবে হত্যা করা হয়েছে সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
ওতানাবে বলেছেন, বেঁচে ফেরার কথা সে সময় তিনি ভাবতে পারেননি। চারদিকে গুলির শব্দ আর চিৎকারে তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিল, এই বুঝি সন্ত্রাসীরা তাঁকে দেখে ফেলবে।
জাপানি পুলিশের বরাত দিয়ে দি ইনডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, তাদের সাতজন নাগরিকের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে গুলিতে। অধিকাংশই মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।
আর বাকি দুজনকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করা হয় বলে জাপানে করা দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
৪৬ বছর বয়সী ওতানাবে জাপান ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন এজেন্সির (জাইকা) অধীনে ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছিলেন। ক্যাফের বাগানে প্রাণ হাতে রুদ্ধশ্বাস ১২টি ঘণ্টা কাটানোর পর ২ জুলাই ভোরে ওতানাবেসহ মোট ১৩ জন জিম্মিকে উদ্ধার করেন বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা।
জাপান টাইমস জানিয়েছে, গুলিবিদ্ধ ওতানাবে ঢাকায় চিকিৎসা নিয়ে ফিরে যান জাপানে। ৫ জুলাই জাপান সরকার তাঁকে টোকিও হাসপাতালে ভর্তি করে।
এদিকে তদন্তকারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওতানাবের মুখে গুলির ক্ষত থাকলেও তিনি স্বাভাবিক কথা বলতে পারেন। সেখানেই তদন্তকারীরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনা করে আরো জিজ্ঞাসাবাদের পরিকল্পনা রয়েছে পুলিশের।
২ জুলাই সকালে সশস্ত্র বাহিনীর অভিযানে জিম্মি সংকটের অবসানের পর ভেতর থেকে ২০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়, যাদের মধ্যে নয়জন ইতালীয়, একজন ভারতীয় এবং তিনজন বাংলাদেশি।
সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী, মোট ৯০৬ জন জাপানি বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাস করছেন। এর আগে গত বছর রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও জঙ্গি হামলায় নিহত হন।