বাইক্কা বিলে বাড়ছে পাখি, কমছে হাকালুকি হাওরে

মৌলভীবাজারে বাইক্কা বিলে বেড়েছে পরিযায়ী ও দেশি জলচর পাখির সংখ্যা। তবে কমেছে হাকালুকি হাওরে।
পরিযায়ী ও দেশি জলচর পাখি মিলিয়ে বর্তমানে বাইক্কা বিলে ৩৯ প্রজাতির ১১ হাজার ৬১৫টি পাখি আছে। গত বছর এখানে ৩৮ প্রজাতির মোট পাঁচ হাজার ৪১৮টি পাখির দেখা মেলে।
অন্যদিকে ক্রমেই কমছে হাকালুকির পাখি। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরে এবারে ৫১ প্রজাতির সর্বমোট ৩৭ হাজার ৯৩১টি জলচর পাখি পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালে এর সংখ্যা ছিল ৪৫ হাজার ১০০টি।
সম্প্রতি করা এক পাখিশুমারিতে এ তথ্য দেওয়া হয়। গত ২৬ জানুয়ারি থেকে শুরু করে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত চার দিনব্যাপী ওই পাখিশুমারি অনুষ্ঠিত হয়।
এশিয়ান ওয়াটার বার্ড সেনসাস, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) অধীনে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা, পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক ও ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ পল থম্পসনের নেতৃত্বে ওই শুমারি পরিচালিত হয়।
‘নিরাপদ’ বাইক্কা বিলে পাখি বেশি
পাখিশুমারিতে দেখা যায় বাইক্কা বিলে পরিযায়ী ও দেশি জলচর পাখি মিলিয়ে বর্তমানে এ বিলে ৩৯ প্রজাতির ১১ হাজার ৬১৫টি পাখি আছে। এর মধ্যে পরিযায়ী পাখির ১৯টি ও দেশি জলচর পাখির ২০টি প্রজাতি রয়েছে। ২০১০ সালের পর এই প্রথম বাইক্কা বিলে এত বেশি পরিমাণ পাখির দেখা মিলেছে।
২০০৩ সালে স্থানীয় হাইল হাওরে ক্রমাগত মাছের বিলুপ্তি নিরসনে চাপড়া, মাগুরা ও যাদুরিয়া বিলের ১০০ একর জলাভূমিজুড়ে স্থায়ী অভয়াশ্রম হিসেবে বাইক্কা বিল গড়ে তোলা হয়। পরে ধীরে ধীরে বিলটি মাছ ও পাখিদের এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে।
পাখি বিশেষজ্ঞ পল থম্পসন জানান, ২০১০ সালে বাইক্কা বিলে ৪০ প্রজাতির মাত্র ১২ হাজার ২৫০টি পাখির দেখা মিলেছিল।
প্রতিষ্ঠার পর ২০০৪ সালের জুলাই মাস থেকে বাইক্কা বিলকে পাখিশুমারির আওতায় নিয়ে আসা হয়। ওই বছরে মোট ২৯৬টি জলচর পাখি এ বিলে আসে।
শুমারিসূত্রে জানা যায়, বাইক্কা বিলে এ বছর সবচেয়ে বেশি এসেছে গেওয়ালা বাটান পাখি। এদের সংখ্যা দুই হাজার ২৮০টি। প্রতিবছর এ সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া বিগত যেকোনো বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে খয়রা কাস্তেচরা নামের জলচর পরিযায়ী পাখির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এবারে বিলে ২৮৮টি কাস্তেচরা পাখি দেখা গেছে। এর বাইরে পাতি তিলি হাঁস দুই হাজার ২২০টি, রাজ শরালী ৩৯৮টি, পাতি শরালী ৮৬০টি, উত্তুরে ল্যঞ্জা হাঁস ৯২১টি।
বিলে পাখি উপস্থিতির হার যে প্রতিবছর বৃদ্ধি পায় তা নয়। বিভিন্ন সময় এ হারের উল্লেখযোগ্য হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। এর কারণ সম্বন্ধে থম্পসন বলেন, ‘অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাইক্কা বিলে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজকর্ম করা হয়। গাছ লাগানো বিশেষ করে হিজল, করচের বাগান ও খননকাজ করা হয়। এ কাজগুলো সাধারণত শুকনো মৌসুম, অর্থাৎ যখন পাখি আস্তে শুরু করে তখন করা হয়, ফলে পাখি আসা কমে যায়। কিন্তু যে বছর কাজ করা হয় না সে বছর আবার পাখি আসতে শুরু করে। পরিযায়ী পাখিরা কোনোখানে যাওয়ার পূর্বে আবাসস্থলটি নিরাপদ কি না, সেটি বিবেচনায় রাখে।’
থম্পসন আরো বলেন, ‘পাখি আসার মৌসুমে যদি জলাভূমিতে মাছ ধরা হয়, আর মানুষের আনাগোনা বাড়ে, সে ক্ষেত্রে শিকারের ভয়ে ও আবাসস্থল অনিরাপদ বিবেচনায় পাখিরা তা এড়িয়ে চলে। এ ছাড়া পরিযায়ী পাখিরা যেখান থেকে আসে সেখানে তাদের প্রজনন অবস্থা, আসা-যাওয়ার পথের সার্বিক অবস্থাসহ অনেক কিছুর ওপর পাখির আনাগোনা নির্ভর করে। অন্যদিকে বাইক্কা বিলের গভীরতা,মাছ, পোকামাকড়সহ জলজ উদ্ভিদের প্রাচুর্যের ফলে এ বিলকে পাখিরা পছন্দ করে। যখন তাদের অনিরাপত্তাবোধের বিষয়গুলো থাকে না, তখন বেশি সংখ্যক পাখির আগমন ঘটে।’
শঙ্কা মাছের খামারে
গত শুকনো মৌসুমে বিলে প্রচুর পরিমাণে শাপলা, শালুক ও পদ্ম ফুল ফোটার ফলে এবারে পাখির উপস্থিতি বেড়েছে। অন্যদিকে ২০১৭ সালে হাওরে পানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে ২০১৮ সালের শুকনো মৌসুমে পদ্ম, শাপলা, শালুক বেশি পরিমাণে জন্মাতে পারেনি। ওই কারণে সেবার শীত মৌসুমে পাখির উপস্থিতি এবারের চেয়ে কম ছিল বলে উল্লেখ করেন থম্পসন। কিন্তু বিলের আশপাশে বসতভিটা ও ব্যক্তিপর্যায়ে মাছের খামার যদি বেড়ে যেতে থাকে, তাহলে পাখির সংখ্যা আগামীতে কমে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বিলসংলগ্ন প্লাবনভূমিতে বিভিন্ন মাছের খামার প্রতিষ্ঠার সমালোচনা করে থম্পসন বলেন, ‘জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। মাছের খামারের কারণে উন্মুক্ত জলাভূমির ব্যাপ্তি কমে আসায় মাছের বিচরণ ক্ষেত্রের অপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কমে আসছে প্রজনন ক্ষেত্র। এতে করে বিভিন্ন দেশি প্রজাতির মাছকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় দরিদ্র জনসাধারণ জীবিকার প্রয়োজনে বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।’
পরিযায়ী পাখিগুলো মূলত কোন অঞ্চল থেকে আসে—জানতে চাইলে থম্পসন বলেন, ‘বাংলাদেশে এগুলো মূলত সাইবেরিয়া, চীন, মধ্য এশিয়া, ভারত ও আসাম থেকে আসে।’
হাকালুকি হাওরে ফাঁদ
দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরে এবারে ৫১ প্রজাতির সর্বমোট ৩৭ হাজার ৯৩১টি জলচর পাখি পাওয়া গেছে। মৌলভীবাজারের তিনটি উপজেলা কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা ও সিলেটের তিনটি উপজেলা বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জের ১৮ হাজার ১১৫ হেক্টরজুড়ে এ হাওরের অবস্থান। গতবারের চেয়ে এখানে পাখির সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ২০ হাজার ৩৫০টি।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের তথ্য অনুসারে ২০১৭ সালে হাকালুকি হাওরে পাখির সংখ্যা ছিল ৫৮ হাজার ২৮১টি। ২০১৮ সালে তা কমে এসে দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ১০০টিতে। ২০১৯ সালে ওই সংখ্যা আরো কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৯৩১টিতে।
এবারে পাখিসমৃদ্ধ বিলের মধ্যে নাগুয়াধলিয়া বিলে আট হাজার ৬৭৬টি ও চাতলা বিলে পাঁচ হাজার ৩২৭টি পাখি পাওয়া যায়। এর মধ্যে মাত্র ৪০৫টি সৈকত পাখির সন্ধান মেলে।
হাকালুকির যেসব বিলে এ শুমারি পরিচালনা করা হয় সেগুলো হলো—কালাপানি, রঞ্চি, দুধাই, গড়কুড়ি, চোকিয়া, উজান তরুল, হিংগাউজুড়ি, নাগাঁও, লরিবাঈ, তল্লারবিল, কাংলি, কুড়ি, চেনাউড়া, পিংলা, পরোটি, আগদের বিল, চাতলা, নামাতরুল, নাগুয়াধুলিয়া, মাইছলা ডাক, মালাম, ফুয়ালা, পলোভাঙা, হাওড় খাল, কইরকণা, মোয়াইজুড়ি, জল্লা, কুকুরডুবি, বালিজুড়ি, বালিকুড়ি, মাইছলা, গড়শিকোণা, চোলা, কাটুয়া, তেকোণা, মেদা, বায়া, গজুয়া, হারামডিঙা ও গোয়ালজুড়।
শুমারি শেষে হাকালুকি হাওরে পাখির উপস্থিতি কমার বেশ কিছু কারণ তুলে ধরা হয়। জানানো হয়, কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় অরক্ষিত হাকালুকি হাওরে বিষটোপ ও ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করায় দিন দিন অতিথি পাখির সমাগম কমছে। এ হাওরে মাছের অভয়াশ্রম থাকলেও সেগুলোতে বিভিন্ন সময় মাছ শিকারিরা হানা দেয়। এটিও পাখির উপস্থিতি কমার কারণ।
সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, শুমারি চলাকালেই এবারে হাওরের পরোতি, বালিজুড়ি ও নাগুয়াধলিয়া বিলে বিষটোপ দিয়ে মারা বিভিন্ন পাখির সন্ধান পাওয়া যায়।
এ ছাড়া জরিপে হুমকির মুখে আছে এমন ছয়টি প্রজাতির পাখির কথা উল্লেখ করা হয়। এগুলো হলো—মহাবিপন্ন বেয়ারের ভুঁতিহাঁস, সংকটাপন্ন পাতি ভুঁতিহাঁস ও বড় গুটিঈগল এবং প্রায় সংকটাপন্ন মরচেরঙ ভুঁতিহাঁস, ফুলুরি হাঁস ও কালামাথা কাস্তেচরা।