সেন্টমার্টিনে পর্যটক নিষিদ্ধ হলে জীবিকা হারাবে তিন লাখ মানুষ

প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে পর্যটক যাওয়া বন্ধ হলে স্থানীয় বাসিন্দা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ প্রায় তিন লাখের মতো মানুষ জীবিকা হারাবে। হুমকির মুখে পড়বে পর্যটন খাতে বিনিয়োগকারীদের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। তাই সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছে ট্যুর অপারেটরস্ অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক)।
টুয়াক জানিয়েছে, সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকদের ভ্রমণ সীমিতকরণ বা রাত্রীযাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে পর্যটন শিল্পে নিয়োজিত সাত থেকে আটটি জাহাজ, ২০০ থেকে ৩০০টি বাস-মিনিবাস, ১০০টি মাইক্রোবাস, ২০০টি ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান, ৪০০ টুরিস্ট গাইড এবং দ্বীপের ১২০টি হোটেল-কটেজ এবং ৭০টি রেস্তোরাঁয় কর্মরতদের জীবিকা হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে কথাগুলো জানায় পর্যটনভিত্তিক সংগঠন টুয়াক।
টুয়াক সভাপতি তোফায়েল আহম্মেদের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়েন কার্যকরী কমিটির প্রধান উপদেষ্টা মুফিজুর রহমান মফিজ।
মুফিজুর রহমান মফিজ লিখিত বক্তব্যে বলেন, “সরকার ২০০৯ সালে পর্যটনকে ‘শিল্প’ ঘোষণার পর থেকে দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে সম্পূর্ণ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পর্যটন শিল্প বিকশিত হয়েছে। দ্বীপে পর্যটন বিকশিত হবওয়ার আগে স্থানীয় জনগোষ্ঠী সমুদ্র থেকে মাছ আহরণের পাশাপশি প্রবাল উত্তোলন, প্রবাল পাথরকে নির্মাণ কাজে ব্যবহারের জন্য তুলে বিক্রি করা, মাছের অভয়ারণ্য ধ্বংস, শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করে বিক্রি, কাছিমের আবাসস্থল নষ্ট করাসহ বিভিন্ন উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করত। সেন্টমাটিনে পর্যটন শিল্প বিকাশিত হওয়ার পর ওই জনগোষ্ঠী বিকল্প জীবিকায়ন পেয়েছে। এতে তাদের জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন আসে এবং তারাই পরিবেশ রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।”

মুফিজুর আরো বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্ব-উদ্যোগে সর্বপ্রথম ২০১৬-১৭ সালকে পর্যটনবর্ষ ঘোষণা করেন। ফলে সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দারা উৎসাহিত হয়ে তাদের বাসা-বাড়ির দু-একটি রুম পরিবেশবান্ধব অতিথিশালা তৈরি করে পর্যটক সেবা দিয়ে আসছে। দ্বীপকে ভালোবেসে বছরে মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবসা করার ঝুঁকি নিয়ে উদ্যোগক্তারা বিপুল বিনিয়োগ করেছে।’
টুয়াকের কার্যকরী কমিটির প্রধান উপদেষ্টা মফিজ আরো বলেন, ‘সেন্টমার্টিন দ্বীপকে প্রতিবেশ সংকটপন্ন এলাকা ঘোষণার আগেই নির্মিত সাত থেকে আটটি বিল্ডিং ছাড়া বাকি সব স্থাপনা দ্বীপের ভারসাম্য রক্ষার উপযোগী ইকো-ট্যুরিজম ব্যবস্থাপনায় নির্মিত।
গত ৬ আগস্ট জুম মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে, প্রতিদিন মাত্র এক হাজার ২৫০ পর্যটক সেন্টমাটিন দ্বীপে দিনের বেলা ভ্রমণ করতে পারবে। তারা রাত্রি যাপন করতে পারবে না। সংবাদটি সেন্টমার্টিন দ্বীপনির্ভর পর্যটন ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে উদ্বিগ্ন ও বিস্মিত করেছে। পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন সাত থেকে আটটি জাহাজের মাধ্যমে চার থেকে পাঁচ হাজার পর্যটক দ্বীপটিতে ভ্রমণ করে এবং এর মধ্য থেকে শতকরা ৩০ ভাগ পর্যটক রাত্রিযাপন করে।’
মুফিজুর আরো বলেন, ‘বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভবিষ্যতে কী কী ক্ষতি সাধিত হতে পারে এবং ক্ষতি মোকাবিলায় কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ না করে শুধু পরিবেশ রক্ষার অজুহাতে পর্যটক সীমিত করে দ্বীপের কোনো উপকার হবে বলে আমরা মনে করি না। এই সিদ্ধান্ত দেশীয় পর্যটন শিল্প বিকাশে বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র বলে মনে করছি। এরই মধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে মিয়ানমার বারবার তাদের মানচিত্রে প্রদর্শিত করায় আমরা দুশ্চিন্তায় আছি।’
লিখিত বক্তব্যে মুফিজুর আরো বলেন, ‘আমরা দৃঢ়চিত্তে বলতে চাই, আমরা দ্বীপবাসী এবং দ্বীপনির্ভর পর্যটন ব্যবসায়ী দ্বীপকে অনেক ভালোবাসি এবং দ্বীপের পরিবেশ বিষয়ে অনেক সচেতন আছি। পর্যটন বাঁচিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রতিবেশ সংরক্ষণে সরকারি যেকোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আমরা সার্বিক সহযোগিতায় প্রস্তুত আছি।’
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলেন, এমনিতেই করোনাভাইরাসের প্রভাবে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাভাবে আমরা পর্যটন ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছি। এখনো পর্যন্ত সরকারি বা অন্য কোনো সংস্থা থেকে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সহায়তা বা প্রণোদনা পাইনি। দ্বীপকে ঘিরে পর্যটন ব্যবসায়ীরা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করলেও এখনো লগ্নীকৃত বিনিয়োগ ফিরে পাওয়ার সুযোগ হয়নি। তাই এখন এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেশীয় পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি পর্যটননির্ভর দ্বীপবাসীরা জীবিকা হারালে আবারও পরিবেশ ধ্বংসকারী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যেতে পারে।
সেন্টমার্টিন দ্বীপকে পরিবেশবান্ধব পর্যটন স্পট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।
প্রস্তাবনাগুলো হলো :
১. পর্যটন মৌসুমে সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রতিদিন ২৫০০ পর্যটক দিবাকালীন এবং ১৫০০ পর্যটককে রাত্রীযাপনের ভ্রমণ অনুমতি দিলে পর্যটন এবং পরিবেশ উভয়েই সুরক্ষিত থাকবে।
২. এরই মধ্যে টুয়াক সেন্টমার্টিনকে প্লাস্টিক ফ্রি করার জন্য ‘প্লাস্টিক ফ্রি ইকো ট্যুরিজম কক্সবাজার’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যা বাস্তবায়িত হলে দ্বীপের প্রতিবেশগত ক্ষয়-ক্ষতি থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারি অনুমোদন ও আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
৩. সেন্টমার্টিন দ্বীপে বসবাসকারী স্থানীয় প্রায় ১৫ হাজার জনগোষ্ঠীকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে দ্বীপ থেকে অন্যত্র পুনর্বাসন এবং পর্যটননির্ভর দ্বীপবাসী ও ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা নেওয়া।
৪. সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার আগে সংশ্লিষ্ট ট্যুর অপারেটর, পর্যটক পরিবহন ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হোটেল ব্যবসায়ী ও জাহাজ ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ ফিরে পাওয়ার ব্যবস্থা করা।
৫. সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রতিবেশ সংরক্ষণের পাশাপাশি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে হোটেল-মোটেলের বর্জ্য সরাসরি সমুদ্রে পড়ছে। হোটেলগুলোতে এসটিপি প্ল্যান বাস্তবায়নের মাধ্যমে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত রক্ষার পদক্ষেপ গ্রহণ।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে টুয়াক সভাপতি তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসে তাহলে আমরা শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে আইনের দ্বারস্থ হব। আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আমরা পর্যটনকে প্রমোট করতে কাজ করছি। আমার ভূখণ্ডে আমি ভিজিটে যাব। এতে কেউ বাধা দিতে পারে না। কক্সবাজারের পর্যটনকে সেন্ট্রালি নিয়ন্ত্রণ করলে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে। আমরা সম্মিলিতভাবে পর্যটনশিল্প বিকাশে সহযোগিতা চাই।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টুয়াকের ফাউন্ডার চেয়ারম্যান এম এ হাসিব বাদল, উপদেষ্টা কামরুল ইসলাম, সৈয়দুল হক কোম্পানি, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এস এম কিবরিয়া খান, সিনিয়র সহসভাপতি আনোয়ার কামাল, যুগ্ম সম্পাদক আল আমীন বিশ্বাস, মুনীবুর রহমান টিটু, এস এ কাজল, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ওমর ফারুক, পর্যটন বিষয়ক সম্পাদক মুহম্মদ মুকিম খান, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সম্পাদক মো. তোহা ইসলাম, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক মো. ইদ্রিচ আলী, সহসাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল আলম রনি।