শ্রমিক সংকট ও বন্যার শঙ্কা, দুশ্চিন্তায় কিশোরগঞ্জের কৃষক
বোরো উৎপাদনে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় জেলা কিশোরগঞ্জের চারটি প্রধান হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলীতে চলতি মৌসুমে ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এ থেকে এক কোটি ৪০ লাখ মণ বোরো ধান উৎপাদনের আশা করছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকায় এ বছর মাঠের ফলন ভালো হয়েছে বলে খুশি হয়েছিল হাওর এলাকার কৃষক।
কিন্তু কৃষকদের খুশি ম্লান হয়ে যাচ্ছে ধান কাটা নিয়ে দুশ্চিন্তায়। কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার বোরোচাষিরা এখন বহুমুখী সংকটে দিশেহারা। একদিকে যখন করোনার কারণে ধান কাটার শ্রমিক সমস্যা প্রকট, তার ওপর পুরো ধান এখনো পেকে ওঠেনি, সেই মুহূর্তে পানি উন্নয়ন বোর্ড আগামী ২২ এপ্রিল থেকে ভারি বৃষ্টিপাতসহ উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে আসার সম্ভাবনার কথা জানিয়ে দ্রুত ধান কাটার তাগাদা দিয়েছে। এর ফলে পাহাড়ি ঢলের পানিতে বছরের একমাত্র ফসল অকালে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় চোখে অন্ধকার দেখছেন হাওরের কৃষক।

পানি উন্নয়ন বোর্ড, কিশোরগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী জানান, সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগ যৌথভাবে পূর্বাভাস দিয়েছে, ২২ এপ্রিল থেকে ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হতে পারে। এর পর পরই উজান (ভারত) থেকে পাহাড়ি ঢল নামার আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে দ্রুত ধান কেটে ফেলতে যথাসম্ভব মে মাসের ৭ তারিখের মধ্যেই ধান কাটা সম্পন্ন করতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কিশোরগঞ্জের উপপরিচালক, কৃষিবিদ মো. ছাইফুল আলম বলেন, ‘আবহাওয়ার বিষয়টি আমাদেরও জানানো হয়েছে। আবহাওয়া বিভাগের দেওয়া ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের পূর্বাভাস মাথায় রেখে আমরা কৃষকদের দ্রুত ধান কাটতে অনুরোধ করছি। ধানের ৮০ ভাগ শীষ পাকামাত্রই ধান যেন কেটে ফেলেন, সে জন্য কৃষকদের আমরা পরামর্শ দিচ্ছি।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষকদের ধান কাটার যে পরামর্শ দিয়েছে, বাস্তবতা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ, ইতোমধ্যে শুধু উচ্চ ফলনশীল জাতের হাইব্রিড জাতের ব্রি-২৮ ধান পাকতে শুরু করায় কৃষক সীমিতভাবে ধান কাটা শুরু করছেন। পুরোদমে ধান কাটা শুরু করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন শ্রমিক সংকটের কারণে।
স্থানীয় কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত ধান কাটার জন্য ৮০ ভাগ নির্ভরশীল থাকেন জেলার বাইরে থেকে আসা কৃষি শ্রমিকদের ওপর। কিন্তু চলমান করোনা মহামারিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় ও রোগ সংক্রমণের ভয়ে শ্রমিকরা ধান কাটতে হাওর এলাকায় আসতে পারছেন না। তার ওপর ব্রি-২৯সহ অন্যান্য জাতের ধান পাকতে ও কাটা শুরু হতে আরো দুই সপ্তাহ লেগে যাবে এবং ধান কাটা সম্পূর্ণ করতে আরো দেড় মাস বা মে মাস পেরিয়ে যাবে।

মিঠামইন উপজেলার গোপদীঘি গ্রামের গৃহস্থ রুহুল আমীন ভুঁইয়া বলেন, ‘একদিকে শ্রমিকের দেখা মিলছে না। মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ব্রি-২৮ জাতের ধানই কাটা শেষে হবে না। পুরো ধান কাটা মে মাসের মধ্যে সম্ভবপর হবে না।’
কৃষকদের মতে, ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল নামার পূর্বাভাস যদি সত্যি হয়ে যায়, তবে কৃষকদের গভীর দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে বোরো ধান কাটার আগেই অকালে ফসল ঢলের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে তারা নিঃস্ব হয়ে যাবেন। কারণ, হাওর এলাকায় বছরে এই একটি মাত্র ফসলের ওপর পরিবার-পরিজন নিয়ে কৃষক জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। ইতোমধ্যে নিয়মিত বৃষ্টি ও কোথাও কোথাও শিলায় ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা দুশ্চিন্তার চাপ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

অবশ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কিশোরগঞ্জের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. ছাইফুল আলম জানিয়েছেন, সব মহলের সমবেত প্রচেষ্টায় সমস্যা থেকে উত্তরণের চেষ্টার কথা। তিনি জানান, দ্রুত ধান কাটা নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় অন্যান্য জেলা থেকে কৃষি শ্রমিকদের আনার চেষ্টা চলছে। অনেক শ্রমিক ইতোমধ্যে এসেও পড়েছেন। তা ছাড়া জেলার অন্য এলাকার সব ধরনের কৃষি শ্রমিক, করোনার কারণে আপাতত বেকার হয়ে পড়া গার্মেন্টস ও পরিবহন শ্রমিকসহ উৎসাহী স্বেচ্ছাসেবীদের ধান কাটার কাজে যুক্ত করার চেষ্টা চলছে।’
তবে শ্রমিক সমস্যার সুরাহা হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের পূর্বাভাসমতে সম্ভাব্য সময়ের মধ্যে সব ধরনের ধান কাটা শেষ হবে কি না, এ নিয়ে সন্দিহান কৃষক ও খোদ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।