রায়ে আংশিক সন্তুষ্ট, আপিল করব : মোয়াজ্জেমের আইনজীবী

ফেনীর সোগাজীর নুসরাত জাহান রাফির ভিডিও ভাইরাল করার ঘটনায় সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে আট বছর কারাদণ্ডের রায়ে ‘আংশিক সন্তোষ’ প্রকাশ করেছেন তাঁর আইনজীবী। তবে রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল দায়ের করার কথাও জানান তিনি।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রায় ঘোষণার পর ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী এক প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলেন।
‘আংশিক সন্তোষ’- এর ব্যাখ্যা দিয়ে মোয়াজ্জেমের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেছেন, ‘তিনটি অভিযোগের মধ্যে একটি অভিযোগে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে খালাস দিয়েছেন আদালত। এ জন্য রায়ে আংশিক সন্তুষ্টি প্রকাশ করছি।’
বিচারক আবেগের বশবর্তী হয়ে রায় দিয়েছেন মন্তব্য করে ফারুক আরো বলেন, ‘আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করব। এ ছাড়া ওসি মোয়াজ্জেম কারাগারে ডিভিশন পাবেন।’
এর আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনকে আট বছর কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড করেছেন আদালত। জরিমানা অনাদায়ে আরো এক বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। জরিমানার ১০ লাখ টাকা ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির পরিবারকে পরিশোধ করতে হবে।
আজ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আস-শামস জগলুল হোসেন এ আদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। নুসরাত জাহান রাফির ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে ওই মামলা করা হয়েছিল। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়্যেদুল হক সুমন ও নুসরাতের মামা সেলিম।
রায় ঘোষণা শেষে ব্যারিস্টার সুমন বলেন, ‘ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে বিচারের মুখোমুখি করতে পেরেছি, এটাই আমার সফলতা।’
নুসরাতের মামা সেলিম বলেন, ‘রায়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট। ব্যারিস্টার সুমনকে ধন্যবাদ।’
এর আগে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে আজ সকাল পৌনে ১০টার দিকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। তাঁকে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। এরপর দুপুর সোয়া ২টার দিকে তাঁকে আদালতের এজলাসে নেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর রায় পড়া শুরু করেন বিচারক সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আস-শামস জগলুল হোসেন। গত ২০ নভেম্বর তিনি রায়ের জন্য আজকের দিন নির্ধারণ করেন।
রায়ে বিচারক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৬ ধারায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাসের অতিরিক্ত কারাদণ্ডাদেশ দেন। এ ছাড়া ২৯ ধারায় তিন বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা এবং তা দিতে ব্যর্থ হলে ছয় মাসের অতিরিক্ত কারাদণ্ড দিয়েছেন। জরিমানার ১০ লাখ টাকা নুসরাতের পরিবারকে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
সোনাগাজী থানায় মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে ‘অসম্মানজনক’ কথা বলায় এবং তাঁর জবানবন্দির ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ এনে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়্যেদুল হক সুমন গত ১৫ এপ্রিল সাইবার ট্রাইব্যুনালে বাদী হয়ে এ মামলা করেন।
বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় করা অভিযোগটি পিটিশন মামলা হিসেবে গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। সেইসঙ্গে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে তদন্ত করে ৩০ এপ্রিল প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
গত ২৭ মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রীমা সুলতানা আদালতে প্রতিবেদন জমা দেন। একই দিন মামলার তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে একই ট্রাইব্যুনালের বিচারক সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। একই সঙ্গে ১৭ জুন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য করেন।
পিবিআইর প্রতিবেদনে বাদীসহ ১৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে সোনাগাজী থানার চারজন পুলিশ সদস্যও রয়েছেন।
প্রতিবেদনে পিবিআই বলেছে, ‘নুসরাত জাহান রাফির বয়স কম এবং তিনি একজন মাদ্রাসাছাত্রী। তাকে কয়েকজন পুরুষের সামনে শ্লীলতাহানির বক্তব্য শোনা এবং তা ভিডিও ধারণ করা ন্যায়সংগত নয়। নারী ও শিশুরা যেহেতু শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় থানায় আসেন, সেহেতু নারী ও শিশুদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশ সদস্যদের অনেক বেশি সহনশীল হওয়া প্রয়োজন।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও নিয়মবহির্ভূতভাবে ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফির বক্তব্যের ভিডিও ধারণ ও প্রচার করে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় অপরাধ করেছেন।’
গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন ভুক্তভোগী নুসরাতের মা। পরে সিরাজ-উদ-দৌলাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
যৌন হয়রানির অভিযোগ করতে যাওয়ার পর সোনাগাজী থানার ওসির কক্ষে ফের হয়রানির শিকার হতে হয় নুসরাতকে। নিয়ম না মেনে জেরা করতে করতেই নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেন ওসি। মৌখিক অভিযোগ নেওয়ার সময় দুজন পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেলেও সেখানে নুসরাত ছাড়া অন্য কোনো নারী বা তাঁর আইনজীবী ছিলেন না।
গত ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার আগমুহূর্তে মিথ্যা কথা বলে নুসরাতকে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয় দুর্বৃত্তরা। মামলা তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানালে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় তারা। ওই দিন নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে গত ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন নুসরাতের মৃত্যু হয়।
এদিকে গত ২৪ অক্টোবর নুসরাত হত্যা মামলায় ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার দায়ে মামলার প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১৬ আসামির সবার ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত।