আজও অপরিচিতার চকলেট পাওয়ার অপেক্ষায় ছাত্রলীগনেতা সাদ্দাম

সাদ্দাম হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত মুখ। দেখতে যেমন সুদর্শন, তেমনই মিষ্টভাষী। নেতৃত্বের গুণাবলীও প্রখর। তাই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (ডাকসু) সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) নির্বাচিত হয়েছেন। হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকও।
রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত কারণে প্রায়ই আলোচনা ও গণমাধ্যমে শিরোনামে আসেন এই নেতা। গতকাল ছিল তাঁর জন্মদিন। জন্মদিনের দুই দিন আগে তাঁর স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত বর্ষের ফল ঘোষণা করা হয়। চার বছরের কোর্স শেষ করতে তাঁর সময় লাগে নয় বছর। যদিও তাঁর বক্তব্য ছিল, নয় বছর না, আট বছরে স্নাতক পাস করেছেন তিনি। আইন বিভাগ থেকে তিনি সিজিপিএ ২.৭১ পেয়েছেন।
আর এসব নিয়ে আজ বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন সাদ্দাম হোসেন। সেই স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, তাঁর মনে আছে কয়েকজন মেয়ের কথা, যাঁরা বলেছিলেন অনার্স শেষ করলে তাঁর জন্য চকলেট পাঠাবেন। তিনি চান, শেষ হোক অপরিচিতার চকলেট পাওয়ার জন্য তাঁর অপেক্ষাও। শুধু তা-ই নয়, তিনি আশা প্রকাশ করেন, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও দ্রুততর সময়ে খোলা হোক। ক্যাম্পাসে আবার গান হোক, প্রেম হোক, জারুল ফুটুক।

এনটিভি অনলাইনের পাঠকদের জন্য সাদ্দামের স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো :
নতুন করে আবার আলোচনায় আসায় দ্বিতীয়বারের মতো কিছু বলতে চাওয়া। এমনিতেও ছাত্ররাজনীতির কর্মী হিসেবে আমি আমার জীবনটাকে একটা উন্মুক্ত বইয়ের মতো মনে করি, যার প্রত্যেকটি পাতাকে শিক্ষার্থীরা পড়তে পারে, প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে, সমালোচনা করতে পারে। একাডেমিক বিষয় নিয়ে লুকোছাপার কিছু নেই এবং আমি স্বাচ্ছন্দ্যের সাথেই এই বিষয়টি মোকাবিলা করতে পছন্দ করি। গতবার এটি নিয়ে যৌক্তিক সমালোচনা হয়; এবারের আলোচনার যৌক্তিকতাকেও আমি স্বীকার করি। গতবার ফলাফল খারাপ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমি নিঃসঙ্কোচে বলেছিলাম এটি ভালো উদাহরণ নয় এবং আমার প্রচেষ্টা থাকবে নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রমের। স্নাতক সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে সে চেষ্টায় হয়তো একেবারে ব্যর্থও হইনি। গণমাধ্যম এবার যা বলেছে, এখান থেকেও আমি আগামীতে নিজেকে আরো পরিশীলিত করার দ্যোতনা খোঁজার চেষ্টা করব। সব খবর আমি আগ্রহের সঙ্গে পড়ার চেষ্টা করেছি এবং পুরো বিষয়টিকে গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে আমার 'বার্থডে গিফট' হিসেবে নিয়েছি।
এত কিছু বলার কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা রয়েছে। আলোচনা-সমালোচনার প্রশ্নোত্তর পর্ব নয়, এই দায়বদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে বলা আমার কাছে সম্মানের। ঠাকুরগাঁও জিলা স্কুল এবং নটরডেম কলেজে লেখাপড়া শেষ করে খ ইউনিটে ১৫তম হয়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হই। আমার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এইচএসসিতে প্রত্যাশিত ফলাফল না করা সত্ত্বেও আমি কোনো ধরনের কোটায় আবেদন করিনি। একাডেমিক লেখাপড়ায় মনোযোগের ধারাবাহিকতা, আত্মনিবেদন, সঠিক পরিকল্পনা ও কর্মপ্রচেষ্টা আমি আগেও খুব ভালোভাবে অনুসরণ করতে পারিনি, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বরং এসব জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। এসবের সমষ্টিই আমার খারাপ ফলাফল। এর বাইরে উপস্থিতির হার পর্যাপ্ত না থাকায় আমি একবার ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণই করতে পারিনি, আরেকবার ভাইভাতেই অংশ নেইনি। টার্ম পরীক্ষায় অংশ না নেওয়া, টিউটোরিয়াল না দেওয়া ছিল নিয়মিত ঘটনা। এজন্যই আমার স্নাতক পর্ব শেষ হতে আট বছর সময় লেগেছে। ছয় বছরের প্রাথমিক নিয়ম অতিক্রম করলে একাডেমিক কমিটি আর ডিনস কমিটির মাধ্যমে আরো ন্যূনতম দুই বছর কিংবা তার অধিকও অনুমতি পাওয়া যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর দশজন সাধারণ ছাত্রের মতো আমার ক্ষেত্রেও এ নিয়ম প্রযোজ্য হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অবশ্যই তৃপ্ত যে, শেষ পর্যন্ত এ যাত্রা সমাপ্ত হয়েছে। আমার সহপাঠী, বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী, অগ্রজ, অনুজ সবাইকেই শুভেচ্ছা।

আরেকটি বিষয় হলো, আমি সব সময়ই আমার নিজের মতো করে জীবনটা যাপন করতে চেয়েছি। জীবন নিয়ে আমার অনুভূতি নিজস্ব। ব্যক্তিগত একাডেমিক-রাজনৈতিক-সামাজিক জীবন নিয়ে আমার কোনো খেদও নেই। আমি নিজেকে বরং সৌভাগ্যবান মনে করি যে, আমার একাডেমিক জীবন দীর্ঘায়িত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ পেয়েছি, নতুন নতুন তারুণ্যদীপ্ত উদ্ভাবনী ভাবনার কথা জানতে পেরেছি, জানতে পেরেছি তাদের অভাব-অভিযোগ-অভিমান আর অনুভূতির কথা। আমার মাস্টার্স যেহেতু চলমান রয়েছে, এ সুযোগ আমি আরো কিছু দিন নিশ্চয়ই পাব এবং অবশ্যই মাস্টার্সে অনার্সের ধারাবাহিকতা না থাকাটাই ভালো হবে! আমি নিজেও এতে দ্বিমত পোষণ করি না!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পথচলায় শিক্ষার্থীরা আমাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছে। আমার অনেক সময়ই মনে হয়েছে এবং আমি এখনো দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃপ্ত মেধাবী, শাণিত প্রতিবাদী, আধুনিক-প্রাগ্রসর এবং অপরাজেয় বাংলার মতোই অপরাজেয় চেতনার অধিকারী শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সত্যিকারের কোনো যোগ্যতা আমার নেই। এ জন্য আমি সবসময়ই নিজেকে সাধারণের একজন ভেবেছি এবং হতে চেয়েছি তাদেরই মতো একজন, যাতে অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিরজাগরুক তরুণদের স্পর্ধিত মিছিলে আমিও একজন হতে পারি, ছাত্রদের একজন সহযোদ্ধা হতে পারি, বন্ধু হতে পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা আমাকে সর্বোচ্চ ভোটে নির্বাচিত করেছিল। কখনো ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি এজন্যই যে, এই সমর্থনের কোনো যোগ্য উপহারই আমি দিতে অক্ষম। শুধু এটুকু বলতে পারি, কৃতজ্ঞতার এই ঋণ শোধ করার সামর্থ্য আমার নেই। আমার সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি-সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাকে নিজেদেরই একজন ভাবায় প্রিয় এই প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থীকে ভালোবাসা, ভালোবাসা আর ভালোবাসা।
পথ চলতে গিয়ে আমার সব পদক্ষেপও হয়তো সঠিক হয় না, এটা আমি জানি। কিন্তু প্রতি মুহূর্ত আমি শিখতে চাই। সত্যি বলতে কি, এমনকি শিক্ষার্থী বা বন্ধুপ্রতীম সংগঠনগুলোর সহযোদ্ধাদের করা মিমস, ট্রল পেজের স্ট্যাটাস, বুদ্ধিদীপ্ত কমেন্ট সবকিছুকেই আমি প্রচণ্ডভাবে উপভোগ করি। তরুণদের ভাবপ্রকাশের এই বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমেই আমি নিজেকে আরো গভীরভাবে বুঝতে পারি, নিজের ভুলগুলো ধরতে পারি, এমনকি অনুভব করি আমার ব্যক্তিগত শুভঙ্করের ফাঁকিগুলোও।

আমার এই পথচলায় শত প্রতিকূলতার মাঝেও বন্ধুদের নিঃশর্ত সমর্থন আমি পেয়েছি সমস্ত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনটি থেকেই। বন্ধুত্ব ছাড়া তাদের দেওয়ার আর কিছুই আমার নেই। আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকেরা আমাকে স্নেহ করেছেন, আমার দুর্বলতার কথাগুলো বলেছেন, জীবনের নানা বিষয়ে আমাকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছেন। ছাত্র রাজনীতি করার কারণে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে নয়, ছাত্র হিসেবেই আইন বিভাগে আমি যাতায়াত করেছি, ক্লাস করেছি, পরীক্ষায় অংশ নিয়েছি। গৌরব করে এ কথা বলা নয়, ঘটমান জীবনের সারাংশটুকু বলার চেষ্টা মাত্র।
শেষ কথা বলি। গতবার যখন আমার পরীক্ষার ফলাফল শুধু প্রশাসনিক ভবনের দেয়াল বা ফেসবুকের ওয়ালে নয়, অনেক গণমাধ্যমেও চিত্রিত হচ্ছিল, আমি যদিও একেবারেই স্বাভাবিক ছিলাম পুরো বিষয়টি নিয়ে, কিন্তু আমি জানি, আমি অনেকের মন খারাপের কারণ হয়েছিলাম। আমার মনে আছে, অনেকেই আমাকে ফেসবুকে, মেসেঞ্জারে, ফোনে, হোয়াটসঅ্যাপে এমনকি চিঠিতেও লেখাপড়া করার কথা বলেছিল, শুধরে নেওয়ার কথা বলেছিল। আমার মনে আছে, কয়েকজন মেয়ের কথা; যারা বলেছিল অনার্স শেষ করলে আমার জন্য চকলেট পাঠাবে। অনেকদিন ক্যাম্পাস বন্ধ, এক মহামারি এসে পৃথিবীই বদলে দিয়ে গেল। শূন্য ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের পদচারণার জন্য শ্বাসরুদ্ধকরভাবে প্রহর গোনে। আজকের দিনে এটিই চাওয়া, এ মহামারি কেটে যাক। নিরাপদ বিশ্বে পৃথিবীর সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সময়ও আরো দ্রুততর হোক। আমাদের ক্যাম্পাসে আবার গান হোক, প্রেম হোক, জারুল ফুল ফুটুক। এবং শেষ হোক অপরিচিতার চকলেট পাওয়ার জন্য আমার অপেক্ষাও।