যে মন্দিরের দেখভাল করেন মুসলমানরা

কাশ্মীর-কাগুজে নাম পৃথিবীর ভূস্বর্গ। কিন্তু স্বর্গোদ্যানের কালসাপের মতো এখানে প্রায়ই নেমে আসে নরকের হাহাকার। ভূস্বর্গের বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গি হামলা, সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন প্রায় নিত্য ঘটনা। গুলির লড়াইয়ে সেনা-জওয়ান থেকে সাধারণ নাগরিকের রক্তাক্ত নিথর দেহ, যেখানে কয়েক দশক ধরে অত্যন্ত পরিচিত একটি ছবি। সেখানেই কিছুটা ভিন্নস্বাদের ছবি ধরা পড়ল কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলায়। জেলার দূরে-পায়ার নামক গ্রামে একটি মন্দিরকে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে রক্ষা করছেন গ্রামের মুসলিম পরিবারগুলো। হিংসা হানাহানিতে দীর্ণ কাশ্মীরে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে সম্প্রীতির বার্তা বহনকারী।
জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে ওই সম্প্রীতির গ্রাম পায়রা। প্রতিদিন সকালে এই গ্রামের শতাব্দীপ্রাচীন একটি মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ শুধু মুসলিমরাই করেন না, প্রতিদিন সকালে ঝাঁট দিয়ে মন্দিরটি যিনি পরিষ্কার করে রাখেন, তিনিও একজন মুসলিম।
জানা যায়, ১৯৮৯ সালে ভারতে জরুরি অবস্থার সময় এই গ্রামে এসে বসবাস শুরু করে কিছু মুসলিম পরিবার। সেই সময় গ্রাম প্রায় জনশূন্য ছিল। এর আগে যে অল্প কিছু হিন্দু ওই গ্রামে বাস করত, জরুরি অবস্থার সময় ওই গ্রাম ছেড়ে তারা অন্যত্র চলে যায়। গ্রামে হিন্দুদের নিদর্শন হিসেবে পড়ে থাকে শতাব্দীপ্রাচীন একটি শিবমন্দির।
যে মন্দিরে নিয়মিত পুজো হওয়া তো দূরের কথা, ছিল না একজন পুরোহিতও। ফলে সময়ের করালগ্রাসে যখন মন্দিরটি পরিত্যক্ত হওয়ার দশা, তখনই শতাব্দীপ্রাচীন এই শিবমন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন। সেই থেকে আজও ওই মন্দিরের যাবতীয় পরিচর্যায় রয়েছে মুসলিমরাই।
বর্তমানে এই মন্দির দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা মুস্তাক আহমেদ শেখ। বছর পঁয়তাল্লিশের এই ব্যক্তি পেশায় একজন সরকারি কর্মী। পেশা এবং বাড়ির কাজ সামলেও প্রতিদিন মন্দির রক্ষায় অনেকটা করেই সময় ব্যয় করেন তিনি। নিজে হাতে ঝাড়ু নিয়ে মন্দিরের সিঁড়ি, চাতাল সবই ঝাঁট দেন। পানি দিয়ে পরিষ্কার করেন মন্দিরে জমে থাকা ধুলোবালিও। মুস্তাক শেখ জানান, সেই জরুরি অবস্থার আমল থেকে হিন্দুদের ফেলে যাওয়া এই শিবমন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণ করছেন তিনি। এমনকি একাধিকবার সন্ত্রাসী হামলার মধ্যেও মন্দিরটিকে আগলে রেখেছেন তিনি ও গ্রামের অন্য মুসলিম পরিবারগুলো।
মুস্তাক আহমেদ শেখ বলেন, ‘মসজিদকে যেভাবে বুকে আগলে রাখি, সেভাবেই এই পরিত্যক্ত মন্দিরটিরও রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছি আমরা। ধর্মে কোথাও মানুষ আর ধর্মের বিভেদের কথা বলা নেই। মহানবী (স.) বিদায় হজের ভাষণে মানবজাতির ঐক্যের কথা বলেছেন আর তা রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছেন মুসলমানদেরই।’
মুস্তাক আহমেদ শেখ আরো জানান, এই মন্দির রক্ষায় স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ প্রয়োজনে সমবেতভাবে চাঁদা তুলেও সংস্কার সাধন করেছেন।