প্রতিক্রিয়া
শিমুর বিয়ে এবং একটি অভূতপূর্ব পাবলিক ফ্যান্টাসি

সুমাইয়া শিমু একজন সু-অভিনেত্রী। বাংলাদেশের মিডিয়ায় যাঁরা অভিনয় করেন তাঁদের মধ্যে শিমুর অভিনয়, গতিবিধি, পর্দা উপস্থিতির পরিমিতিবোধ সবকিছুই তাঁকে অন্য অনেকের থেকে স্বতন্ত্র করেছে। তাঁকে নিয়ে তথাকথিত নেগেটিভ খবর আজ-অবধি কাগজে দেখা যায়নি। এহেন শিমুকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে রকম ‘আনসোশ্যাল’ আলোচনা হচ্ছে সেটা বিস্ময়কর। শিমু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, আমার অধীন নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ থেকে পিইচডি করছেন এবং আমার লেখা দুটো টেলিভিশন নাটকে অসাধারণ অভিনয়ও করেছেন। তাই এক ধরনের আত্মীয়তার অনুভব থেকে একজন মানুষের নিতান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে সংঘটিত অভূতপূর্ব এবং বিব্রতকর বাক-কারখানায় খানিকটা তৎপর হতে হলো।
আলোচনা বা বিতর্কের পয়লা বিষয়ই হলো : ‘ফর্সা/সুন্দর’ শিমু বিয়ে করেছেন একজন ‘কালো/অসুন্দর’ পুরুষকে।
সেই আদিম ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’-এর ডায়ালেক্ট।
বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকায় এই মুহূর্তে ভারি বর্ষণ হচ্ছে, বন্যা আসছে, ঘরবাড়ি ভেসে যাচ্ছে, চলছে নামে বেনামে খুন ধর্ষণ, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ছে...
এই সবকিছুর মধ্যে একজন অভিনেত্রীর বিয়ে যে এতটা আলোচনায় এলো, সেটা ভাবলে মনে পড়ে যায় রজত কাপুরের ‘রঘু রোমিও’ সিনেমার কথা। টিভি সিরিয়ালের জনপ্রিয় এক চরিত্রের নায়িকার অন্ধ অনুরক্ত এক সাইকোপ্যাথ যুবক তাকে অপহরণ করে ফেলে। তাকে দেবীর মতো পূজা করবে সে। কাহিনীর সঙ্গে মিলিয়েই সে তাকে জাজ করতে থাকে। এবং একদিন সে তার মহা ভুল বুঝতে পেরে ভঙ্গুর স্বপ্নসৌধের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
এটাই হলো তৃতীয় দুনিয়ার মানুষের জীবনের রঙিন ফ্যান্টাসি। এই ফ্যান্টাসি ছাড়া তার জীবন পানসে। রিয়েলিটির অপ্রাপ্যকে সে ফ্যান্টাসির মধ্যে পেতে চায়। এমন না যে তারা শিমুর বরের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখে, কিন্তু তারা চায় তাদের ‘সুন্দর’ আরেক ‘সুন্দর’-এর পাশে থাকুক। শিমুর অতি ‘বাস্তবিক’ ‘মানুষসুলভ’ ‘সাধারণ’ দর্শন স্বামী তাদের ফ্যান্টাসির সামনে বড় আঘাত। এই লোক তাদের পর্দাদেবীকে রক্তমাংসে পায় ক্যামনে! তাইলে আমার কী কমতি ছিল! ইত্যাদি।
শিমুর স্বামী যত ‘কদর্য’ হন, পাবলিকের নিজেকে তত শিমুর কাল্পনিক স্বামী হিসেবে প্রতিযোগিতায় নামাতে সুবিধা হয়। আর এই যৌনমনস্তাত্ত্বিক অবদমন আর অভিপ্রকাশের অমীমাংসার খেলায় দর্শক বা জনচিত্ত ততই বেসামাল হয়ে পড়ে।
এই বুঝেই ভারতবর্ষীয় অবতার শ্রীকৃষ্ণ কালো হয়েই শ্রীবিশিষ্ট ছিলেন। গৌর বা ফর্সা রাধা তাঁর প্রেমে মশগুল। কালো কোনো অর্থে ভালো, তা প্রমাণ করতে বৈষ্ণব পদকর্তাদের উপমার বাঁধ ভেঙে গেছে। তারাশঙ্কর তাঁর ‘কবি’তে বলিয়েছেন, ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দো কেনে!’
‘কালো’ দার্শনিকভাবে যুগে যুগে লড়াই করেই টিকেছে।
হঠাৎ করে এই সময়ে এত ক্ষোভের শিকার কেন হলো?
তার কারণ আমাদের আর্থিক, রাজনৈতিক, ভার্চুয়াল সেক্স সবকিছুর সাদাশাসন।
সাদারাই আমাদের শাসন করে, সাদাদের করপোরেট গণিতের হিসাব আমাদের মেলাতে হয়, সাদাদের পর্নো দেখে আমরা শরীর চিনি...
ভেতরে ভেতরে এখনো সাদার মনোদৈহিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, আর্থরাজনৈতিক উপনিবেশ কায়েম হয়ে চলেছে আমাদের মধ্যে...
কিন্তু বিব্রত হওয়ার দরকার নাই শিমুর। তিনি যে ভারতীয় সিরিয়াল পীড়িত বাংলাদেশের ম্রিয়মাণ ছোটপর্দার একজন অভিনয়কর্মী হয়েও পাবলিক ফ্যান্টাসির নায়িকা হতে পেরেছেন, এটা আনন্দেরই কথা।
পুনশ্চঃ খুব একটা প্রাসঙ্গিক না হলেও একটা মজার ঘটনা বলব। শিমু হয়তো পড়ে আনন্দ পাবেন। কাজী নজরুল ইসলামের ভাবনা থেকে একটা টিভি নাটক লিখেছিলাম। নাম ছিল ‘অভিমানিনী’। বন্ধুবর কাওনাইন সৌরভের পরিচালনায় নাটকটি বাংলাভিশনে প্রচার হয়। সেই নাটকে এক কালো মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শিমু। একজন কবি যখন তাঁকে প্রেম নিবেদন করে, নিজে তার প্রতি খুব দুর্বল হলেও সে গভীর আহত বোধ করে। নিজের বাবার কাছে কাঁদতে কাঁদতে সে বলতে থাকে ‘...সব সহ্য হয় বাবা, কিন্তু ও কেন আমাকে করুণা করবে! কেন আমার ভালোবাসাকে অপমাণ করবে!’
কেবল গায়ের রঙের কারণেই সে নিজেকে কারো প্রেমের যোগ্য বলে মনে করতে পারে না। সেই অভিমান থেকে মেয়েটি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয় কবির কাছ থেকে এবং তিলে তিলে কাছে ডেকে নেয় মৃত্যুকে! অভিনীত নাটকের সেই কাহিনীই যেন শিমুর জীবনে খানিকটা দূরান্বয়ে ফিরে এলো। হোয়াট আ মিরাকল!
আর এও আশ্চর্য, আজ থেকে ৬০-৭০ বছর আগে লেখা নজরুলের সেই কাহিনীর শ্লেষ/শ্লাঘা আজও একবিন্দু মুছে যায়নি, বরং ভীষণ দগদগে হয়ে জ্বলছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আছড়ে পড়া শত শত প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাকে আরেকবার চিনে নেওয়া গেল।
লেখক : কবি, নাট্যকার ও নাট্যনির্দেশক