সমসাময়িক
মিডিয়ার স্বাধীনতা

১.
মার্কসবাদীরা বহু আগে থেকেই বলে আসছেন, শ্রেণীবিভক্ত সমাজে কোনো ঘটনাই শ্রেণীর ঊর্ধ্বে না। পুঁজির দুনিয়ায় সবকিছুই পুঁজি নামক সম্পর্কের দ্বারা নির্ধারিত হয়- এগুলো বর্তমানে প্রচণ্ডভাবে হাজির থাকলেও আমাদের ঠাঁওড়ে তা ধরা পড়ে না। কারণ কী? বেশির ভাগ মানুষের প্রচলিত বিশ্বাস যে, মিডিয়া অত্যন্ত স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। ফলে বাইরের দুনিয়ার সাথে আমাদের মাথার ভেতরের ছবিগুলোর যে ফারাক থাকে, তা ভরাট করে দেয় মিডিয়া, একটা ছদ্ম বাস্তব হাজির করে। আর ছদ্ম বাস্তবের কারণে পুঁজির চরিত্র আমাদের কাছে ঢাকা পড়ে যায়। তবে যেসব দেশে মিডিয়া সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে তার চরিত্র জনগণের কাছে স্পষ্ট থাকে।
একটি জনপ্রিয় মিথ্যাচার হচ্ছে, মিডিয়া বাস্তবের আয়না। মনে হয়, মিডিয়ার যেন নিজস্ব ভূমিকা নেই, যেন নিষ্ক্রিয় জড় পদার্থ। প্রকৃত অর্থে মিডিয়া অত্যন্ত সক্রিয় প্রতিষ্ঠান। ২৪ ঘণ্টা নিজেই বাস্তবকে উদ্ভাবন করতে থাকে। আর সেখানে যে ছবি চিত্রিত হয়, তা বাস্তব বলে বিশ্বাস করতে থাকি এবং সেই মতে আমাদের সিদ্ধান্ত তৈরি হয়।
হ্যারম্যান ও চমস্কি নামের দুই মার্কিন বুদ্ধিজীবী তাঁদের 'সম্মতি উৎপাদন' নামক বিশাল গ্রন্থে সংবাদ উৎপাদনের তল্লাশি চালাতে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পাঁচটি ছাঁকুনির দেখা পেয়েছেন। সেগুলো হচ্ছে : ১. মিডিয়ার কেন্দ্রীভূত মালিকানা, মালিকের সম্পদ এবং সাংবাদিকের মুনাফামুখিনতা, ২. আয়ের প্রাথমিক উৎস হিসেবে বিজ্ঞাপনদাতাদের ওপর একান্ত নির্ভরতা, ৩. সোর্স হিসেবে সরকার, সরকারি মহল এবং পছন্দসই বিশেষজ্ঞদের দেওয়া তৈরিকৃত তথ্যের ওপর নির্ভরশীলতা, ৪. করপোরেট-তহবিল সমর্থিত মিডিয়া-বিষয়ক নানা ইনস্টিটিউট প্রভৃতি চিন্তাক্ষেত্রের সমালোচনা-গবেষণা-রিপোর্ট ইত্যাদির মাধ্যমে মিডিয়াকে করপোরেট অনুসারি থাকার অংশ হিসেবে ক্ষমতাওয়ালাদের চাপ ও ৫. ধর্মবিশ্বাসের মতো বাজারের ওপর অন্ধ আনুগত্য। এভাবেই তৈরি হয় কথিত বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ।
মিডিয়া তার গ্রাহকদের কী শেখায়, সমাজে কী ভূমিকা পালন করে, সব মিলিয়ে সমাজে মিডিয়ার প্রভাব কেমন -ইত্যাদি প্রশ্ন পশ্চিমা সমাজে গত চার দশকে দারুণভাবে ফুলেফলে বিকশিত হয়ে ডালপালা মেলেছে। সেজন্য মিডিয়াকে চোখে চোখে রাখার জন্য ব্যর্থতা নিয়েও অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রে এসবের বালাই নাই।
২.
ক্ষমতা মানেই তার লাগাম থাকা দরকার, সীমা চিহ্নিত করা দরকার। পত্রিকা মানে মুক্তচিন্তার আধার নয়, পত্রিকারও শ্রেণীচরিত্র আছে। আমরা তো আগেই বলেছি, মিডিয়ারও নজরদারি দরকার। কিন্তু সেটা কে করবে? রাষ্ট্র? রাষ্ট্র মানে তো জনগণ নয়। জনগণের ওপর ছড়ি ঘোরানো প্রতিষ্ঠান। ছড়ি ঘোরানো বলেই ৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের গোড়াতেই ৩৯ অনুচ্ছেদে যখন সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে 'আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে', তখনো কেউ কথা তোলেনি, ৪২ বছরেও তোলা হয়নি; তখন বুঝতে বাকি নেই যে শাসকশ্রেণীর বিভিন্ন গ্রুপ এই ভেবে আছে- আমরা আমরাই তো!
অথচ এত রক্ত দানের ওপর দাঁড়িয়েও চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতাকে নিরঙ্কুশ করা গেল না। উল্টো মিডিয়া-মালিকরা রাষ্ট্রের অপরাপর শক্তির সাথে মিলেমিশে জনগণের জন্য গর্ত খুড়েছে। তাই নিজেদের গর্তে নিজেরাই পড়ছে। রুশ কমরেড ভ. ই. লেনিন তো আগেই বলেছেন, শাসকশ্রেণীর মধ্যকার অবৈরী দ্বন্দ্বও কখনো কখনো তাদের ছাড়খাড় করতে পারে।
কৃতজ্ঞতা :
১. গণমাধ্যম পরিবীক্ষণের সহজ পুস্তক, সেলিম রেজা নিউটন, বাংলা একাডেমি, ২০০৮।
২. সম্মতি উৎপাদন, হ্যারম্যান ও চমস্কি, সংহতি প্রকাশন।
লেখক : প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।