স্মরণ
একজন মাদার তেরেসা

মাদার তেরেসা বা মাদার টেরিজা নামটি আমাদের কাছে বেশ পরিচিত। কমবেশি তাঁর কথা আমরা সবাই জানি। তাঁর প্রতি সমালোচনার চেয়ে আমাদের ভালোবাসাই বেশি।
তিনি আজকের এই দিনে আলবেনিয়ায় একটি ক্যাথলিক খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই মহীয়সী জীবনটাকে উৎসর্গ করেছিলেন মানবসেবার তরে। তাঁর এই সেবা কার্যক্রমের গোড়াপত্তন ঘটে ভারতবর্ষেই। তাও আবার বাংলাদেশের কোলঘেঁষা দার্জিলিংয়ে। লাভ করেন সেখানকার নাগরিকত্ব।
মাদার তেরেসার এ ক্ষেত্রে আমরা মাও সেতুংয়ের কথা বলতে পারি। মাওয়ের বাবা একজন জোতদার ছিলেন। যার কারণে মাও ছোটবেলাতে প্রত্যক্ষ করেছিলেন কৃষকদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার, যা পরবর্তীকালে তাঁর কৃষিতান্ত্রিক সমাজ বিপ্লবে আত্মপ্রকাশ ঘটে।
মাদার তেরেসার বয়স যখন আট বছর, তখন তাঁর বাবা নিকোলো মারা যান। এ সময় তাঁর মা দ্রানা বয়াজু মেয়েকে ক্যাথলিক অনুশাসনে লালন-পালন করেন। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাঁর ১২ বছর বয়সে। ১৮ বছর বয়সে তিনি মিশনারি সন্ন্যাসী হয়ে দেশ ত্যাগ করেন।
ভারতবর্ষসহ সারা পৃথিবীতে তাঁর রেখে যাওয়া সেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সালে যখন তিনি পরলোকে পাড়ি জমান, তখন তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সংখ্যা ছিল ৬১০টিরও বেশি; যা ১২৩টি দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। মাত্র ১২ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে যাত্রা করা মাদার তেরেসার মৃত্যুকালে এ সংখ্যা ছিল এক লাখের ওপরে।
তিনি দরিদ্র শিশুদের আশ্রয়দানের পাশাপাশি এইডস, যক্ষ্মা ও কুষ্ঠরোগের মতো মারাত্মক রোগাক্রান্তদের সেবা করে গিয়েছিলেন। তিনি এগিয়ে গিয়েছেন যুদ্ধ-বিধ্বংস্ত দেশগুলোতে। ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার যুদ্ধাবস্থা তিনি কিছুদিনের জন্য হলেও বন্ধ রাখতে পেরেছেন।
পঞ্চাশের মন্বন্তর আর ১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা তাঁর মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। হয়তো এসব কারণেই শিক্ষিকা তেরেসা হয়ে উঠলেন একজন অনন্য সেবক তেরেসা হিসেবে।
যদিও তেরেসারৱ এসব ক্রিয়া-কর্মের সমালোচনাও করেছেন অনেকে। তবে তিনি নিজ অবস্থানে অটুট ছিলেন।
এ ব্যাপারে তাঁর বিখ্যাত উক্তি হলো ‘তুমি সমালোচনাকে একটি হাসির সঙ্গে গ্রহণ করো আর নিজের কাজ চালিয়ে যাও। এতে সমালোচনা তোমার কিছুই করতে পারবে না।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মাদার তেরেসার অন্যতম ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে তিনি বীরাঙ্গনাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। তাঁর সংস্থা অনেক যুদ্ধশিশুকে নিজেদের কাছে নিয়ে যায় এবং তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে।
এক্ষেত্রে আমরা যুদ্ধশিশু ‘শিখা’র কথা বলতে পারি। তাকে কানাডিয়ো দম্পত্তি ফ্রেডরিক ক্যাপাচিনো এখান থেকে দত্তক নিয়েছিলেন।
তিনি যেমন মানুষকে ভালোবেসেছিলেন, মানুষও তাঁকে কম ভালোবাসেনি। তিনি স্বীকৃতি হিসেবে জীবদ্দশাতেই পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার (১৯৭০) ও ভারতরত্ন পুরস্কারসহ (১৯৮০) অনেক কিছু।
তিনি মানুষের মরণটা যেন সুন্দর হয় সেদিকে লক্ষ রাখতেন। এ জন্য তাঁর সেবাখানায় যখন কোনো রোগী মৃত্যু পথযাত্রী হতেন, তখন তিনি তাঁদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতেন।
যতদূর জানা যায়, তিনি এসব করতেন ধর্মীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। তিনি ছিলেন সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক মানুষ। যেমন- মুসলমানদের জন্য কোরআন পড়া, হিন্দুদের জন্য গঙ্গার জল ও খ্রিস্টানদের জন্য অন্তিমলেপনের ব্যবস্থা করতেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর উক্তি ছিল "A beautiful death is for people who lived like animals to die like angels — loved and wanted."
মানুষের সেবা করতে করতেই তিনি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। তবে তাঁর স্বপ্ন চলে যায়নি। তিনি বিশ্বজুড়ে বেঁচে আছেন কল্যাণকামী মানুষের হৃদয়ে-মননে-কর্মে।
লেখক : শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক