সমসাময়িক
তথ্যপ্রযুক্তি আইন ও সেন্সরশিপ নিয়ে দুই প্রস্থ

তথ্যপ্রযুক্তি আইন ও এর ৫৭ ধারা এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। এই আলোচনা-সমালোচনা বেড়ে গেছে সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের গ্রেপ্তার ও জামিনের পর। সমালোচনা হচ্ছে, এই ধারা নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠছে কি না। তার আগে দেখে নেওয়া যাক, কী আছে এই ৫৭ ধারায়। আইনটির ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে :
‘কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানী প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’
৫৭ ধারায় বেশ কিছু শব্দ আছে, যা স্পষ্ট নয়। ‘যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে কিংবা রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় অথবা কারো বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়,’ এই শব্দসমষ্টি কারো কাছেই খুব পরিষ্কার নয়। শব্দগুলো খুব স্পষ্ট না হলেও ধারাটিতে শাস্তি আবার খুব স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে। শাস্তির কথা এবার বলা যাক। এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে আবার বলা হয়েছে, অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং এক কোটি টাকা জরিমানা। অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো, শুরুতে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সাজা ছিল ১০ বছর, যা পরে বাড়িয়ে ১৪ বছর করা হয়। আর ৫৭ ধারায় মামলা হলো অজামিনযোগ্য। শুধু তা-ই নয়, ২০০৬ সালের এই আইন ২০০৯ ও ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী কিংবা ব্লগার তার লেখার মাধ্যমে অনলাইনে কারো মানহানি করলে তার শাস্তি ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং এই অপরাধের জন্য তিনি জামিন পাবেন না; আর জরিমানা তো আছেই। কিন্তু এর উল্টোচিত্র দেখা যায় বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৫০০ ধারায়। সেখানে বলা হয়েছে, মানহানির সাজা দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড। একটি দেশে মানহানির এ দুই রকম সাজা আইনপ্রণেতাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। অথবা তাঁরা ধরেই নিয়েছেন, মুদ্রণ মাধ্যমের চেয়ে বেশি কার্যকর হলো অনলাইন বা তথ্যপ্রযুক্তি।
এর যথেষ্ট কারণও আছে বৈকি। ২০১৫ সালের মে মাসের হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জনে প্রায় ২৮ জন ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ২০১২ সালের বাংলাদেশের ৩৩ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারী এখন বেড়ে হয়েছে প্রায় এক কোটি। এখন অনলাইনের সঙ্গে একটি পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে । অনলাইনে কোনো বিষয় ভাইরাল বা অতি প্রচলিত হয়ে উঠলে তা স্থান পায় পত্রিকার পাতায় কিংবা অনলাইন সংবাদমাধ্যমে। তাই সরকার বাহাদুর মনে করছে, হয়তো অনলাইনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে যাবতীয় প্রচারণা বন্ধ হবে। সাংবাদিকতায় দুই ধরনের সেন্সরশিপের কথা শোনা যায়। একটি হচ্ছে, গণমাধ্যমের সম্পাদক বা বার্তা সম্পাদক যে সংবাদটি ছেঁটে ফেলে দেন সেটি; আরেকটি হলো, ভয়-ভীতি কিংবা আশপাশের পরিস্থিতি দেখে সাংবাদিক নিজেই নিজের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করেন, যা সেলফ সেন্সরশিপ নামে পরিচিত। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা এ দুই ধরনের সেন্সরশিপেরই কারণ হয়ে উঠেছে।
সাধারণত অনলাইন মাধ্যমে মানুষ নিজের মতামত প্রকাশ করে স্বাধীনভাবে। এখন এই স্বাধীনতা কতটা থাকবে কি থাকবে না, তার নির্ধারক হয়ে উঠেছে এই ৫৭ ধারা। তবে সরকারের নানা ধরনের সেন্সরশিপ আরোপের কারণে ২০১৪ সালের ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের ইন্টারনেট ও ডিজিটাল স্বাধীনতায় ৮৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৬৩ নম্বরে। এখানে আশার কথা হলো, বাংলাদেশ সামগ্রিক বিচারে পাকিস্তানের চেয়ে ভালো করেছে; কারণ পাকিস্তান আছে ৭৬ নম্বরে। আর হতাশার কথা হলো প্রতিবেশী দেশ ভারত বাকস্বাধীনতায় বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে, তালিকায় ভারতের অবস্থান ৪৮ নম্বরে। ২০১৫ সালের নতুন তালিকায় বাংলাদেশ আরো পেছনের দিকে যাবে, আশপাশের সেন্সরশিপের মাত্রা দেখে তা আন্দাজ করা খুব কঠিন কিছু নয়।
শুধু আইন দিয়েই সেন্সরশিপ আরোপ ছাড়া আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য। ৩ আগস্ট-২০১৫ সালের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের খবর অনুযায়ী, সরকার রাষ্ট্রের আরো বেশি নিরাপত্তা আনয়নের জন্য সাতটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে আড়িপাতার যন্ত্রপাতি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার মধ্যে আছে আমেরিকা ও ইসরায়েলিভিত্তিক যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ভেরিয়েন্ট সিস্টেম। এই প্রতিষ্ঠান তার আড়িপাতার যন্ত্র বিক্রি শুরু করেছিল ফিলিস্তিনের গাজার জনগণের মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের আড়িপাতা কাজের জন্য। এর আগে এই প্রতিষ্ঠান তার আড়িপাতার যন্ত্র বিক্রি করেছে ভারত ও মেক্সিকোর কাছে। পত্রিকাটির খবর অনুযায়ী এই যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে স্থাপিত হলে ফোন, ই-মেইল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আরো নিবিড়ভাবে নজরদারি চালানো যাবে।
একদিকে তথ্যপ্রযুক্তির আইনের ৫৭ ধারা, আরেকদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে নজরদারির যে ব্যবস্থা, তা সামনের দিন সব মাধ্যমে সরকারি আরো কঠোর নজরদারিরই কথা বলে। ধারাটির কারণে মানুষ জেল-জরিমানার ভয়ে নিজেই নিজের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করবে, আর নজরদারির নানা সফটওয়্যার কারা কারা ভিন্নমত পোষণ করছে, তাদের খুঁজে বের করবে। প্রবাদে আছে, যায় দিন ভালো, আর আসে দিন খারাপ। বাংলাদেশে মতপ্রকাশের পরিমণ্ডল কি তাহলে সেদিকেই এগোচ্ছে?
লেখক : শিক্ষক, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।