প্রতিক্রিয়া
শিশু নির্যাতন কি বেড়ে গেছে?

ইদানীংকালে বেশ কয়েকটি মর্মস্পর্শী শিশু নির্যাতনের ঘটনা গণমাধ্যম মারফত আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এর মধ্যে শিশু সামিউল ইসলাম রাজনের হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং রাস্তার আন্দোলনে সারা দেশের মানুষ বেশ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছে। এখন প্রায়ই পত্রিকায় শিশু নির্যাতনের সংবাদ পাওয়া যায়। সংবাদগুলো পত্রিকাওয়ালারা বেশ গুরুত্ব সহকারেই ছাপে। এতে স্বাভাবিকভাবেই যে কারো মনে হতে পারে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে গেছে। আসলেই কি ব্যাপারটা তাই? সমাজের দিকে পর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টি রাখেন এমন যে কারো কাছ থেকে হয়তো উত্তরটা সহজ হবে না। কারণ কিছু কিছু সামাজিক প্রপঞ্চ বিশেষ প্রেক্ষাপটে আমাদের সামনে আসে যেগুলোর অস্তিত্ব মূলত পূর্ব থেকেই সমাজে বিদ্যমান থাকে। যেমন ইভ টিজিং একটা সামাজিক প্রপঞ্চ যার সাথে আমরা বছর দুই-তিনেক আগে বিশেষ ভাবে পরিচিত হয়ে উঠি। পত্রিকাগুলো ইভ টিজিং নিয়ে সংবাদ ছাপতে শুরু করে। টকশোতে এটা নিয়ে দিনের পর দিন আলোচনা হতে থাকে। এটা নিয়ে নাটক সিনেমা পর্যন্ত তৈরি হয়। পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় ইভ টিজিংয়ের কারণ, উৎপত্তি, প্রতিকার ইত্যাদি নিয়ে সারগর্ভ লেখা আসতে শুরু করে। মানুষজন ইভ টিজিংয়ের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। সরকারও নড়েচড়ে বসে। ইভ টিজিং প্রতিরোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। পুলিশ এর বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাতে শুরু করে। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে ইভ টিজিং-বিরোধী সেল গঠন করা হয়। এমনকি ইভ টিজিং প্রতিরোধে মেয়ে শিক্ষার্থীদের কারাতে শেখানোর প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়। একসময় ইভ টিজিং শব্দটার বদলে যৌন নিপীড়ন ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইভ টিজিং সম্পর্কে দেওয়ার মত আরো বিভিন্ন তথ্য আমরা জানি। এই কথাগুলো বলছি একটা বিষয় জানতেÑ ইভ টিজিং নিয়ে এত সব কীর্তির পূর্বে আমাদের সমাজে ইভ টিজিং কি ছিল না? নাকি কম ছিল? স্বীকার করতেই হবে, ছিল এবং সেটা তার আসল রূপেই ছিল। সাম্প্রতিক অতীতে আরেকটা আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিষয় ছিল পহেলা বৈশাখে নারী লাঞ্ছনার মতো ঘটনা। এটা নিয়েও বহু আলোচনা-সমালোচনা এবং বিভিন্ন আয়োজন হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে এই ধরণের বড় উৎসবে নারী লাঞ্ছনার ঘটনা কি এটাই প্রথম? নাকি আগেও ঘটেছে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটা বড় উৎসব কিংবা লোক সমাগমে এই ধরনের ঘটনা বহু আগে থেকেই হয়ে আসছে। পহেলা বৈশাখ, বইমেলা, জাতীয় দিবস, বিভিন্ন আঞ্চলিক মেলা এমনকি খালেদা-হাসিনার সমাবেশে সারাদেশে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এই ঘটনাগুলো আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে না সব সময়। কোনো একটা প্রেক্ষাপটে দৈবাৎ এগুলো আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়।
যেমন, আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি সেখানে শিশু রাজন হত্যার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন, মিছিল ইত্যাদির আয়োজন করেছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের ফেসবুক টাইমলাইন ঘৃণার বাণীতে সয়লাব হয়ে গেছে। অথচ এ বিশ্ববিদ্যালয়েই ২০০৮ সালের দিকে কোনো একটা হলে চুরির অভিযোগ এনে একজন কিশোরকে নৃশংসভাবে সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তেমন কোনো প্রতিবাদ হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও ব্যাপারটা দিব্যি হজম করে ফেলেছে। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাগিং নামের একটা অপসংস্কৃতি চালু রয়েছে। এর মাধ্যমে নবীন শিক্ষার্থীদের আদব-কায়দা শেখানোর নাম করে মানসিক এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। পত্রিকায় র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে শিক্ষার্থী আহত হওয়ার সংবাদ মাঝেমধ্যেই আসে। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক সেভাবে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে না কখনো। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এটা একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। হয়তো কখনো এমন কোনো ঘটনা ঘটবে কিংবা প্রেক্ষাপট তৈরি হবে যখন এটা অধিকাংশ মানুষের মনযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হবে। তখন মানুষের কাছে মনে হবে এটা বোধহয় কোনো নতুন বিষয় কিংবা নতুন করে এর তীব্রতা বেড়ে গেছে। চার বছর আগে ডাকাতির অভিযোগ এনে কিশোর মিলনকে পুলিশ ধরে এনে জনতার হাতে ছেড়ে দেয়। তাকে সাপের মতো পিটিয়ে-পিটিয়ে, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলা হয়। হত্যা দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করে মোবাইলে মোবাইলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সে ঘটনার বিচার এখনো পায়নি তার পরিবার। পুলিশ ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সে সময় ঘটনাটা কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি। হয়তো তখনো পত্রিকায় সিঙ্গেল কলামে ব্যাপারটার সংবাদ এসেছিল কিংবা আসেনি। তবে রাজন হত্যার পর এ ঘটনার সংবাদ নতুন করে গুরুত্ব পায়। পত্রিকাতে এ নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট ছাপানো হয়েছে। সেই নৃশংস হত্যার ভিডিও দেখায় রাজন হত্যার ভিডিও দেখার সাহস পাইনি। বর্ণনায় যা জেনেছি, মিলন হত্যা এর চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিল না। এই উদাহরণগুলো দিয়ে যে কথাটা প্রমাণ করতে চাই, সেটা হলোÑ বাংলাদেশে শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে যায়নি। বরং বিষয়টা তাৎপর্যপূর্ণভাবে আমাদের সামনে এসেছে। সুতরাং শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কিংবা বিচার চেয়ে সমাধান খুঁজলে যথেষ্ট হবে না। যে বিষয়টা সমাজের গভীর অভ্যন্তরে মূল গেড়ে বসে আছে সে বিষয়টাকে কিছু সময়ের জন্য সামাজিক ইস্যু বানিয়ে যদি আশা করা হয়, এটা একেবারে খতম হয়ে যাবে তাহলে সেটা হবে পুরোদস্তুর অবিবেচক ভাবনা। আসলে জাতি হিসেবে আমরা সামগ্রিকভাবে শিশুদের প্রতি স্নেহশীল নই। এটা আমাদের মূল্যবোধগত সমস্যা এবং ব্যাপারটা আমাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। এ দেশের শিশুদের বেশিরভাগই নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে বড় হয়। বলা যায় নিষ্ঠুরতার সাথে অভিযোজিত হয়ে বড় হয়।
আমাদের অনেকের জীবনেই হয়তো শৈশবে নিষ্ঠুরতার শিকার হওয়ার দু-একটা মনে রাখার মত ঘটনা রয়েছে। কিংবা অন্য কোন শিশুকে শিকার হতে দেখেছি। বিশেষ করে যাদের জন্ম হয়েছে নি¤œবিত্ত কিংবা নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারে। আমরা সবাই শিশুদের শাস্তি দিয়ে এক ধরনের মজা পাই। এমনকি এ দেশের অধিকাংশ মা-বাবাও শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুর।
ইউনিসেফের সহযোগিতায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা যায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬৫.৯%) শিশুকে শারীরিক শাস্তি দেন মা-বাবা। সবচেয়ে বেশি মারধর করা হয় তিন-চার বছরের শিশুদের। ৭৪.৪% শিশুকে শৃংখলা শেখানোর জন্য মানসিক চাপ প্রয়োগ করেন মা-বাবাসহ অভিভাবকরা। বিদ্যালয়েও শিশুর সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়। কিছু কিছু কওমি মাদ্রাসায় শিশুদের এমন কঠিন শাস্তি দিয়ে পড়তে বাধ্য করা হয়- যা রীতিমতো লোমহর্ষক। এসব মাদ্রাসায় শিশুরা প্রায় বন্দী জীবন যাপন করে।
আমাদের প্রিয়নবী শিশুদের প্রতি এত স্নেহশীল ছিলেন যে, নামাজের সিজদায় গেলে তার নাতি হাসান তার ঘাড়ে চেপে বসতেন। তিনি সিজদা থেকে সাথে সাথে উঠতেন না এই ভয়ে যে তার নাতি পিঠ থেকে পড়ে ব্যথা পাবেন। তাঁর এই শিক্ষা থেকেও আমরা শিশুদের প্রতি স্নেহশীল হতে পারি।
সমাজের যখন এ চিত্র তখন শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধে তাৎক্ষনিক কোনো সমাধান নেই। প্রতিবাদ, বিচার চাওয়া, কঠিন আইন প্রণয়নের প্রয়োজন আছে। তবে শেষ সমাধান হিসেবে ভাবার সুযোগ নেই। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদে কাজ করতে হবে। কাজ করতে হবে আমাদের মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। এ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে হবে কবি-সাহিত্যিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, নাট্যকার, অভিনেতা, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং সমাজকর্মীদের। গণমাধ্যমের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। আমাদের বুঝতে হবে এবং বুঝাতে হবে, শিশুরা হচ্ছে কাঁচা সোনা। যারা আমাদের জন্য আগামী দিনের সম্ভাবনা। প্রতিটি শিশুর সুকোমল মন ফুলের মতো সুবাসিত। এ জন্য সাদা-কালো, ধনী-গরিব বিবাদ বিভেদ ভুলে, নির্বিশেষে সবশিশুকে ভালোবাসতে হবে। তাদের বড় হওয়ার জন্য সৃষ্টি করতে হবে অনুকূল পরিবেশ এবং কোনোভাবেই শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা নয়।
লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, নৃ-বিজ্ঞান বিভাগ।