নারী নির্যাতন
মানুষ তুমি মানুষ হবে কবে?

মা-বাবা আদর করে নাম রেখেছিল সুখী। তখন কি তারা জানত মেয়ের নাম একদিন পত্রপত্রিকায় ছাপা হবে? সারা দেশের মানুষ জানবে? সুখীর গল্প কাঁদিয়েছে মানুষকে। ওর নামের সাথেই ভাগ্য যেন নির্মম পরিহাস করেছে। যৌতুকের টাকার জন্য নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি সুখীর স্বামী রবিউল। ইলেকট্রিক টেস্টার দিয়ে স্ত্রীর চোখ উপড়ে ফেলে তার ক্ষোভ মিটিয়েছে। রবিউলের স্বজনরাও এই মহান(!) কাজে হাত লাগিয়েছে। সুখীর ঘরের স্বপ্ন দৃষ্টি হারানো চোখের নোনা জলে ভেসে যায়।
পত্রিকার পাতায়, টিভি স্ক্রিনে সুখীর বীভৎস চেহারাটা অনেকেই সহ্য করতে পারেননি। কিন্তু সুখীর কথা চাপা পড়তে বেশি সময়ও লাগেনি। ততদিনে যৌতুকের জন্য নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে যশোরের নাসিমা, শরীয়তপুরের শিমু, নীলফামারীর আনোয়ারা, ঢাকায় মধুবাগের নাসরীনসহ আরো অনেক মেয়েকে। কতভাবে যে নির্যাতন করা যায় তার বিবরণ পড়তে পড়তে হয়তো অনেক পাঠক-দর্শকই ভুলে যান কোনটার চেয়ে কোনটা বেশি ভয়ংকর কিংবা অনেকেই নির্মমতার এসব বর্ণনা সহ্য করতে না পেরে এড়িয়ে চলেন এসব খবর। কিন্তু চাইলেই কি চোখ সরিয়ে রাখা যায়? বছর বছর যৌতুকের দাবিতে নারী নির্যাতন যে হারে বেড়ে চলেছে সমাজে, তা থেকে মনে সন্দেহ জাগে, বিয়েটা কি এখন আয়-রোজগারের কোনো উৎস? তা যদি না হবে, তবে এত সব কঠোর আইন হওয়ার পরও কেন শিক্ষিত, অশিক্ষিত, নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং এমনকি উচ্চবিত্ত সমাজেও যৌতুকের নামে নারী নির্যাতনের তালিকা দিনে দিনে লম্বা হচ্ছে?
পারিবারিক সহিংসতার ভয়াবহতা ঠেকাতে নারী নির্যাতন দমন আইন, যৌতুক নিরোধ আইন, পারিবারিক সুরক্ষা আইনসহ আইনের নানা ধারা সংশোধন করে নারী নির্যাতনকারীদের কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে কিন্তু তারপরও নারী নির্যাতন তো কমছেই না বরং দিন দিন আরো বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এবং নারীকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পারলে নারী নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু দেশে এখন মেয়েদের শিক্ষার হার তুলনামূলক বেড়েছে, গ্রাম-শহর সবখানেই মেয়েরা এখন কাজ করছে। অনেক মেয়েই এখন পরিবারের হাল ধরেছে। তারপরও কেন বাড়ছে নারী নির্যাতনের সংখ্যা? আমরা যদি গ্রামের কথাই ধরি, সেখানে মেয়েরা এখন কৃষিকাজ থেকে শুরু করে সব ধরনের কাজেই এগিয়ে এসেছে। শুধু স্বামীর ওপর নির্ভরশীল না থেকে তারা সংসারে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করছে। গার্মেন্টসগুলোর বেশির ভাগ শ্রমিকই নারী। শহরের কিংবা শহরতলির আশপাশে বস্তিগুলোতে একটু খোঁজ নিলেই জানা যাবে, সেখানে অনেক পুরুষই জায়গা বদল করে একাধিক বিয়ে করছেন, স্ত্রী-সন্তানের প্রতি দায়দায়িত্ব পালন না করলেও স্ত্রীর উপার্জনের টাকা কেড়ে নিচ্ছেন আর চাহিদানুযায়ী টাকা না পেলে চলে মারধর।
এ তো গেল সমাজের নিম্নবিত্তের চালচিত্র। নিম্ন মধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্ত সমাজের বাস্তবতা এর চেয়েও ভয়াবহ। শিক্ষিত এই পরিবারগুলো বিয়ে-উপযুক্ত মেয়ের জন্য ‘চাকুরে’ জামাই পেলে বরপক্ষকে যা লাগে তা দিতে দ্বিধাবোধ করে না। এর বাইরে ‘যৌতুক না চাইলে মেয়ের বাবা বেশি দেবেন’ এই ফর্মুলায় শিক্ষিত পরিবারে এখন যৌতুক বিষয়ে তেমন কোনো চাহিদা থাকে না। যে কারণে মেয়ের বাবা গয়না, আসবাবপত্র, ফ্রিজ, টেলিভিশন, মোটরসাইকেল, গাড়িসহ নানা পণ্য মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দেন। আইনকানুন সম্পর্কে ধারণা থাকলেও জ্ঞানপাপী এই স্তরের লোকেরা গোপনে যৌতুক দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হন না, দিনের পর দিন মেয়ের শ্বশুরবাড়ির আবদার মেটাতে মেটাতে পথে বসেন কিন্তু তারপরও প্রতিবাদ করেন না। কারণ, লোকলজ্জার ভয়। মেয়ে যদি নির্যাতনের শিকার হয়ে মরেও যায় তারপরও অভিভাবকরা কোনো উচ্চবাচ্য করেন না।
এখানেই শেষ নয়। শুধু কি যৌতুকের জন্য নারী নির্যাতিত হচ্ছে? অবশ্যই নয়। দুর্নীতি, কালো টাকা, অবৈধ সম্পর্ক, মাদকাসক্তিসহ আরো অসংখ্য কারণ রয়েছে এর পেছনে। এই মরণব্যাধি আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার ফলে পারিবারিক বন্ধন কিংবা সামাজিক দায়বদ্ধতা কোনো কিছুরই পরোয়া নেই।
হোক সে নামকরা চিকিৎসক, উকিল, শিক্ষক এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, কেউ পিছিয়ে নেই নারী নির্যাতক হিসেবে। কেউ টাকার জন্য, কেউ বা বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে দিনের পর দিন স্ত্রীর ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। যারা নির্যাতিত হচ্ছে তারাও কিন্তু সমাজে প্রতিষ্ঠিত নারী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা, বিএসএমএমইউর চিকিৎসক মেহজাবিন কিংবা সাংবাদিক নাজনীন আক্তার তন্বী তো স্বামীর ওপর নির্ভরশীল নন, বরং তারা পরিবারে অনেক বেশি কন্ট্রিবিউট করেন। কিন্তু দিনের পর দিন শারীরিক-মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়েও তাঁরা মুখ খোলেননি সমাজের ভয়ে। সমাজের অন্যান্য পেশার কথা না-ই বা বললাম, নিজের ঘরের মধ্যে যে অনাচার চলছে, তার দায় তো আমরা কেউ এড়াতে পারি না। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের কথা বলতে চাই। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে একের পর সাংবাদিকদের পারিবারিক সহিংসতা যে চিত্র বারবার বেরিয়ে আসছে তাতে মুখ লুকাব কোথায়?
আমরা যারা এই সময়ে সাংবাদিকতা করছি, তাদের চেয়ে অনেক বেশি ত্যাগের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে আমাদের অগ্রজদের। কিন্তু অনেক সহজেই এখন সাংবাদিক হওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ায় এই পেশার প্রতি কতটা সম্মান আমরা রাখতে পারছি তা ভেবে দেখার এখন সময় এসেছে। গত কয়েক মাসে বিভিন্ন স্বনামধন্য পত্রিকা ও টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধিদের স্ত্রী নির্যাতনের খবর বেরিয়েছে। কিছুদিন আগে সাংবাদিক রকিবুল ইসলাম মুকুল অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নির্যাতনের নির্মমতার এক নজির রেখেছেন। যদিও তাঁর স্ত্রীও একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক যিনি কিনা অসহায়ভাবে সব নির্যাতন সহ্য করেছেন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে। অন্যদিকে পুরুষরা যখন অবৈধ সম্পর্কে জড়াচ্ছেন সেখানে তো অবশ্যই একজন নারীর অংশগ্রহণ খুব জোরালোভাবেই আছে। মুকুলের বান্ধবী হিসেবে সিঁথির অবস্থান কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আবার সম্প্রতি একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের স্ত্রী থানায় গিয়ে নারী নির্যাতনের মামলা করেছেন। স্ত্রীর অভিযোগ, তিনি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। তাঁর স্বামীরও অভিযোগ, ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে তাঁকে ব্যবহার করা হয়েছে। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করছেন ওই নারী। পরপর ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো নারী সাংবাদিক হিসেবে যাঁরা গণমাধ্যমে কাজ করছেন, তাঁদের সামনে একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এতদিনের শ্রম, এত কষ্টে এগিয়ে চলার কি তবে কোনো গন্তব্য নেই? যাঁরা অন্যের প্রশ্ন নিজের কাঁধে আগ বাড়িয়ে নিয়ে সব প্রতিকূলতার মুখোমুখি হন, তাঁরা নিজেরা কতটা সুরক্ষিত? যে নির্যাতিতার চোখের পানি মুছিয়ে, তাঁর না বলতে পারা কথাগুলো সাহসের সঙ্গে সমাজের সামনে তুলে আনেন তিনি কি দিনশেষে বাড়ি ফিরে একই কারণে গোপনে চোখের পানি ফেলেন? নির্যাতিতা মেয়েটিকে সামনে এগিয়ে চলার সাহস দিয়ে এসে নিজে ঘর আর সন্তানের সুরক্ষার কথা ভেবে দিনের পর দিন সব নির্যাতন সয়ে যান? তন্বীর মতো সাহসী সাংবাদিক যখন অন্যের জন্য বেঁচে থাকার প্রেরণা, তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রমাণ করে দিনশেষে নারী শেষ পর্যন্ত নারীই। তারপরও আশা থেকে যায়, তন্বী পেরেছেন তাঁর প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। তবে সেই সঙ্গে একজন সংবাদকর্মী হিসেবে নিজেকে খুব অপমানিত লাগে, যখন কাউকে দেখি সংবাদমাধ্যমের ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন, তা সে পুরুষ কিংবা নারী যেই হোন না কেন। নারী হিসেবে তো আরো ছোট হয়ে যাই যখন আঙুল ওঠে কোনো নারীর দিকে কারণ আগেই বলেছি অবৈধ সম্পর্কের দায়ভার শুধু পুরুষের নয়, নারীরও আছে। নিজের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কারো কাছে ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগ তোলার আগেই তা ভাবা উচিত। আর যাঁরা ভেবেই নিয়েছেন তাঁদের নৈতিকতার চিন্তাধারার পরিবর্তন করবেন না, দয়া করে এই পেশাটি অন্তত পরিবর্তন করুন। দয়া করে সংবাদকর্মীদের মাথা উঁচু করে সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন না।
লেখক : সাংবাদিক