শিশুর নিরাপত্তা
মায়ের কোলে নিরাপদ থাকুক শিশু

মা ও সন্তানের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কই বাঁচিয়ে তুলল শিশু সুরাইয়াকে। নাড়ির টানেই শিশু সুরাইয়া মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করেও ফিরে এসেছে মায়ের কোলে। মা-মেয়ে দুজনেই দুজনের সঙ্গে হাসি বিনিময়ের মাধ্যমে জানান দিয়েছে তাদের নিটোল সম্পর্কের কথাও। কী এক অদ্ভুত অনুভূতি, ফিরে পাওয়ার তৃপ্তি মা নাজমা বেগমের। সে অনুভূতির কিছুটা সুখ স্পর্শ করেছে আমাদেরও। ‘বেবি অব নাজমা’ পৃথিবীর আলোতে এখন সুরাইয়া। মা ও মেয়ের নতুন করে জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দে আনন্দিত আমরা সবাই। সরকার ও সংশ্লিষ্টদের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমাদেরও। কিন্তু আনন্দের প্রলেপে কতগুলো নিরাশাবাদী প্রশ্নও তাড়া করে বেড়াচ্ছে আমায়।
মাগুরার পর কুমিল্লায়ও একইভাবে সন্ত্রাসীর দুই গ্রুপের সংঘর্ষে তানভীর হাসান হৃদয়ের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা কোনো এক অজানা সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। কোথাও যেন মন পূর্ববর্তী ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছে। যখন ভারতে দুর্ধর্ষভাবে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনা পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেয়, তার ঠিক পরপরই আমাদের দেশে ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশের মাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। ঠিক সেভাবেই সুরাইয়ার ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পরে তানভীরের সঙ্গে একই রকমভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনের দরজায় ভীতির কড়া বাজিয়ে যাচ্ছে। একটি ঘটনার সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজছে আরেকটি ঘটনা। মন বলছে, আবারো প্রায় প্রতিদিনই হয়তো এ ধরনের সংবাদ পড়তে হবে আর আফসোস করতে হবে।
কেন জানি মনে হয়, এ ধরনের ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশ হলে অপরাধীরা তাদের মধ্যে এক ধরনের ভ্রাতৃত্ববোধ অনুভব করে, তাদের দেখে শিউরে ওঠা বা তাদের পাশবিকতার প্রতি সাধারণ জনগণের যে ভয়, তা দেখে অপরাধীরা মনে শক্তি সঞ্চার করে। এ রকম ঘটনা বারবার ঘটছে বলে লোকের মনে ভীতি সঞ্চারের এক অদ্ভুত উন্মত্ত নেশায় তারা মেতে ওঠে। কিন্তু ঠিক এর উল্টো ঘটনাটা যদি ঘটত, তবে বুঝি উল্টো ফলাফল মিলত। আমরা সাধারণ মানুষ যদি এক হয়ে এই অপরাধীদের এ রকম অপরাধকর্ম সংঘটনের পরে গণপিটুনিতে কয়েকজনকে হাসপাতালে শয্যাশায়ী করতে পারতাম, তবে এ ঘটনাগুলো কি কমে যেত? হয়তো কমে যেত। কিন্তু সেটা না হয় নাই বা করলাম। আস্থা রাখতে চাই আমার রাষ্ট্রের আইনি ব্যবস্থার ওপর, চাই এসব সন্ত্রাসীরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। কে জানে, না হলে বাঁচার একমাত্র উপায় হিসেবে হয়তো আমাদের গণপিটুনির রাস্তাই বেছে নিতে হবে।
অপরাধীদের বুঝিয়ে দেওয়া উচিত, ওরা সংখ্যায় একশ-দুইশ অথবা লাখ আর আমরা ষোলো কোটি দেশপ্রেমিক বাঙালি উড়িয়ে দেব, গুঁড়িয়ে দেব এ সন্ত্রাসীদের দল। নর্দমা পরিষ্কারে নর্দমায় তো নামতে হবেই যদি মিউনিসিপালটি করপোরেশন উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেয়। না হলে নর্দমার দুগন্ধ যে আমার বাড়িতে ছড়িয়ে জীবাণু সংক্রমণ ঘটাচ্ছে না, সেটার নিশ্চয়তা কে-ই বা দিতে পারে।
আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় রয়েছে পর্যাপ্ত আইন এবং বিভিন্ন সেল, যারা অপরাধ দমনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু আইনের ফাঁকফোকর ও কাজের অবহেলায় জন্ম হচ্ছে শত শত অপরাধীর। তারা শাখা-প্রশাখা ডালপালা বিস্তার করে অপরাধের ক্যানসার ছড়িয়ে দিচ্ছে। দেশে শিশুদের বিরুদ্ধে নির্যাতন বন্ধে সব আইন প্রণয়নে ও শিশুনীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু এখানে শিশুদের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট অনেক কম। এবং শিশুদের জন্য এ মন্ত্রণালয়ে খুব একটা গুরুত্বও দেওয়া হয় না। মন্ত্রণালয়ের লোকদের দাবি, পর্যাপ্ত লোকবল এবং বাজেট না থাকাই এর অন্যতম কারণ। তবে এর পাশাপাশি পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করাকেও আমরা দায়ী করতে পারি। শিশুদের জন্য এখন পর্যন্ত আলাদা কোনো মন্ত্রণালয় নেই। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ই শিশুদের নিয়ে কাজ করে। কিন্তু জনবলের অভাবে কাজ হচ্ছে বিঘ্নিত। আর শিশুনীতি বাস্তবায়ন এখন একটা ক্রসকাটিং ইস্যু। তাই মন্ত্রণালয়ের লোক দাবি করে অন্যান্য মন্ত্রণালয়েরও শিশুদের জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখা উচিত।
এ ছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি নম্বর আছে—১০৯২১, এতে ফ্রি হেল্পলাইন চালু আছে। যেখানে জরুরি অবস্থায় ফোন দিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জানানো যায়। গ্রামাঞ্চল তো দূরের কথা, শহরের অনেকেই এ হেল্পলাইনের কথা জানেই না। তাই এ বিষয়ে প্রচার ও প্রসারের জন্যও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। দরকার পড়লে প্রোমো তৈরি করে সরকারি ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে এখনই জরুরি ভিত্তিতে এ হেল্পলাইন নম্বরটা দিয়ে দেওয়া উচিত। কী কী আইন ও ব্যবস্থা প্রচলিত আছে, সেই তথ্যগুলো অন্তত সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হবে। না হলে বৃথা যাবে এসব ক্ষেত্রে অর্থায়ন। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন মাসে এক হাজার ২৯৯ শিশু নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। তাই দায় এড়িয়ে যাওয়ার সময় এটি নয়। সব মন্ত্রণালয় মিলেই কাজ করতে হবে। দরকার পড়লে বেশি জনবল নিয়োগ দিতে হবে, আরো যদি প্রয়োজন হয় আলাদা করে শিশু মন্ত্রণালয় খুলতে হবে। আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ গর্ভে থেকেই জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করুক, এটা আমাদের কাম্য নয়। সুরাইয়ার ঘটনা বারবার ঘটুক, এটাও আমরা চাই না। সাধারণ মানুষ প্রাণভরে বাঁচতে চায়, তার ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুটিকে স্কুলে পাঠিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে চায়। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে এই এতটুকু চাওয়া তো আমাদের থাকতেই পারে। কি, আমাদের থাকতে পারে না?
লেখক : প্রভাষক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।