শ্রদ্ধাঞ্জলি
চিত্রা নদীর পাড় থেকে ভারতের ফার্স্ট লেডি

প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতা। ভূত-ভবিষ্যৎ অনেকটা অদৃশ্যের ওপর দুলছে। ভাবনার দোলাচলে অনেকটাই নিয়তির দুর্বিপাক। গত শতকে সেই সাতান্নের দিকে গাঁটছড়া বাঁধেন শুভ্রা। তার পর শর্মিষ্ঠা, অভিজিৎ কিংবা ইন্দ্রজিতের মা হওয়ার পাশাপাশি শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের বড় পরিচয় ভারতের ফার্স্ট লেডি। প্রণবের সঙ্গে দাম্পত্যে ছয় দশকের মাত্র দুই বছর কম থাকতেই চলে গেলেন তিনি। সময়ের বিচারে দীর্ঘ পথপরিক্রমা হলেও আলোচনার পাদপ্রদীপ তেমনভাবে ঘিরে ধরেনি শুভ্রাকে। তাই অনেক আলোচিত, সমালোচিত, বিখ্যাত ব্যক্তির সহধর্মিণী হওয়ার পরও থেকে গেছেন নিভৃতে। আর তাঁকে নিয়ে গণমাধ্যমও তেমন মাতামাতি করেনি।
ভারতের ফার্স্ট লেডি তিনি। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হলেও বাংলাদেশে তিনি এত আলোচিত হচ্ছেন কেন? প্রশ্নের উত্তরটা বোধ করি অনেক সহজ। তিনি জাতে বাঙালি, ধমনিতে বইছে খোদ বাংলাদেশি রক্ত। নিয়তি আর যা-ই হোক, মানুষকে তাঁর শেকড়কে ভোলাতে পারেনি, ঠিক তাই! বাংলাদেশকে ভুলতে পারেননি শুভ্রাও। হয়তো আমাদের অনেকেরই অজানা যে শুভ্রার জনকভূ তথা পৈতৃক ভিটা বাংলাদেশের নড়াইলে। আর ২০১৩ সালের দিকে প্রণব যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন স্ত্রী হিসেবে তিনিও ছিলেন সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত নড়াইলে নিজ বাড়িটি দেখে আসার ইচ্ছা সংবরণ করতে পারেননি।
হয়তো এ সময়ে এসে প্রণব মুখার্জি ভারতের রাষ্ট্রপতি। কিন্তু তাঁর স্ত্রী এখনো ভুলতে পারেননি বাংলাদেশে পুঁতে রাখা নাড়ির টান। তিনি আজ ভারতের ফার্স্ট লেডি হলেও বাংলাতেই তাঁর প্রাণ পড়ে ছিল নিশ্চয়। আর ছায়াঘেরা পাখি ডাকা সবুজ নড়াইলের চিত্রা নদীর তীরে সেই ছোট গ্রামটি আজো জ্বলজ্বল করছে তাঁর স্মৃতিকণ্ডুয়নে। চিত্রা নদীর পাড় থেকে রাইসিনা হিলের গৃহকত্রী হওয়ার পরও তিনি ভোলেননি বাংলাদেশ ও এখানকার মানুষকে। তাই তাঁর ধূসর স্মৃতিকে সঙ্গী করে আপ্লুত বাংলাদেশও। এদিকে, তাঁর রোগমুক্তি কামনায় দীর্ঘ প্রার্থনার আয়োজনও করা হয়েছে নড়াইলে। নড়াইল শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে একটি গ্রাম ভদ্রবিলা। চিত্রাপাড়ের এ গ্রামেই এক জমিদার বাড়িতে ১৯৪০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জন্ম তাঁর। শুভ্রার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বাংলাদেশের এ জেলাতেই। তাই হয়তো এখন বাংলাদেশের নাগরিক না হলেও নড়াইলের ভদ্রবিলা ও সীতারামপুর হারিয়ে যায়নি স্মৃতি থেকে। আর সেখানে থেকে যাওয়া তাঁর অগণন আত্মীয়স্বজন সেটাকে করেছেন আরো জোরদার। কেউ যদি দাবি করে বসেন, অন্তত এ জন্য হলেও জমিদার অমরেন্দ্র ঘোষ ও মীরা রানী ঘোষের মেয়ে শুভ্রাকে বাংলাদেশি বলে মেনে নিতে বাধা নেই।
দুরন্ত শৈশবে শুরুটা ভদ্রবিলায় হলেও পরে মা তাঁকে নিয়ে যান নড়াইলের সীতারামপুরে। সেখানে শুভ্রার মামাবাড়ি; চাঁচড়া বোলদেভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়, যা বর্তমানে চাঁচড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ। দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ার পর ১৯৫৫ সালেই শুভ্রা চলে যান কলকাতার তারকেশ্বর লাইনে। সেখানে আরেক মামার বাড়ি ছিল তাঁর। এভাবে দেখতে দেখতে শুভ্রার বয়স ১৪ আর প্রণবের ২২। তার পর প্রণবের সঙ্গে প্রণয় ধীরে ধীরে গড়ায় পরিণয়ে। ব্যক্তিগত জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষার্থী শুভ্রা পেশায় ছিলেন অধ্যাপক। রবীন্দ্রসংগীতটাও গাইতেন বেশ ভালো করে। এদিকে, গীতাঞ্জলি নামে একটি সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান হয়েছিলেন তিনি। এখন লেখক হিসেবে সময়ের আবর্তে যশস্বী হয়ে ওঠা শুভ্রার কলমে ভাষা খুঁজে নিয়েছে অসংখ্য গল্প, প্রবন্ধ ও ফিচার। আজ তিনি চলে গেলেন, রেখে গেলেন অনেক স্মৃতি। আর সে স্মৃতি রোমন্থন করে ফিরবে চিত্রাপাড়ের মানুষ, তাঁকে মনে রাখবে পুরো বাংলাদেশ।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।