অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা
লক্ষ্য বিকাশ নাকি বিনাশ?

জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা-২০১৫ (খসড়া) মারাত্মকভাবে হতাশ করেছে। এই নীতিমালা কেন? এটা কী? নীতিমালাটির খসড়া একাধিকবার পড়েও এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে সংশয় জাগায়, এমন নীতিমালা করার প্রয়োজনটা কী? অনলাইন গণমাধ্যমকে সুষ্ঠু ধারায় রাখতে একটি নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশ্যক। কিন্তু সেটি অবশ্যই হতে হবে অনলাইন মাধ্যমটির অগ্রযাত্রার সহায়ক, প্রতিবন্ধক নয়।
সম্প্রতি তথ্য মন্ত্রণালয় ‘জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা-২০১৫’-এর যে খসড়া তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে, তার ৮০ ভাগের বেশি অগ্রহণযোগ্য, অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক। নীতিমালাটি পড়তে গিয়ে কখনো কখনো মনে হয়েছে, সরকার কোনো এনজিওকে তার কার্যক্রম পরিচালনার শর্ত প্রদান করছে, অবার কখনো কখনো তা হয়ে উঠেছে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল।
মোট আট অধ্যায়ে বিভক্ত এই নীতিমালা প্রতিটি অধ্যায় ধরে আলোচনার দাবি রাখে। কারণ, প্রতিটি অধ্যায়েই রয়েছে নানা অসংগতিপূর্ণ শর্ত আর অপ্রয়োজনীয় বক্তব্যের সমাহার।
অধ্যায় এক : এ অধ্যায়ে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বলে একটি বিভাগ রয়েছে, সেখানে এক জায়গায় বলা হচ্ছে, ‘সকল অন্যায় ও বৈষম্য নিরসন করে ন্যায় ও সমতার নীতি প্রতিষ্ঠায় অনলাইন গণমাধ্যমের সুদৃঢ় ভূমিকা নিশ্চিত করা।’ এই যে ধারাটি এটা কেন বলা হচ্ছে, এর মাধ্যমে কী হবে, তা স্পষ্ট নয়।
অনলাইন গণমাধ্যমের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে দায়সারা একটি সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছে অথবা সাংবাদিকতার পরিধিকে অতিরিক্ত বিস্তর (!) করা হয়েছে। সংজ্ঞাটি এমন, ‘এই নীতিমালায় অনলাইন গণমাধ্যম বলতে বাংলা, ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে স্থির ও চলমান চিত্র, ধ্বনি ও লেখা বা মাল্টিমিডিয়ার অন্য কোনো রূপে উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ বা সম্প্রচারকারী ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে বোঝাবে।’
প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে যদি কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে বাংলা, ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে স্থির ও চলমান চিত্র, ধ্বনি ও লেখা বা মাল্টিমিডিয়ার অন্য কোনো রূপে উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, তবে সেটি অনলাইন গণমাধ্যম হয়ে যাবে? যেমন একটি ব্যাংকের বা শেয়ারবাজারের ওয়েবসাইট—এগুলো কি গণমাধ্যম!
আর ‘তথ্য-উপাত্ত’ মানে কী? সাংবাদিকতার ছাত্র বা একজন তরুণ সংবাদকর্মী মাত্রই জানেন যে সব সংবাদই তথ্য, তবে সব তথ্যই সংবাদ নয়। এই ধারণাটিকে মাথায় রেখে সংজ্ঞা নির্ধারণ করলেও তা কিছুটা গ্রহণযোগ্য হতে পারত।
সংজ্ঞা কেমন হতে পারত, তার একটি নমুনা তুলে ধরছি—এই নীতিমালায় অনলাইন গণমাধ্যম বলতে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সংস্থা থেকে নিবন্ধিত বাংলা, ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে স্থির ও চলমান চিত্র, ধ্বনি ও লেখা বা মাল্টিমিডিয়ার অন্য কোনো রূপে উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত বা সংবাদ প্রকাশ বা সম্প্রচারকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে বোঝাবে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে অনলাইন গণমাধ্যমের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে। এখানে একটি ধারা রয়েছে এমন, ‘কাগজ বা সম্প্রচারের জন্য নিবন্ধিত, ডিক্লারেশন বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত গণমাধ্যমকে অনলাইন প্রচার, প্রকাশ বা সম্প্রচারের জন্য নিবন্ধিত হতে হবে।’ এখানে বিষয়টি স্পষ্টকরণের দাবি রাখে। কারণ, যেকোনো প্রতিষ্ঠান থেকে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থাকতেই পারে, যেমন—ব্যাংক-বীমা। তবে এখানে কথা থাকে যে, যদি কোনো কাগজের দৈনিক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ওয়েব সংস্করণে সংবাদ আপডেট করে, সে ক্ষেত্রে আলাদা নিবন্ধনের বিধান থাকতে পারে।
এই নীতিমালার তৃতীয় অধ্যায়ে আলোকপাত করা হয়েছে অনলাইনে তথ্য-উপাত্ত প্রচার, প্রকাশ ও সম্প্রচার সংক্রান্ত বিষয়ে। এখানে একটি উপধারায় বলা হয়েছে, ‘সংস্কৃতির সমৃদ্ধির জন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিল্প ও শিল্পীদের অনুসন্ধান করে তাদের অনুপ্রাণিত করতে হবে এবং জনসমক্ষে তুলে ধরতে হবে।’ এ ধরনের বেশ কয়েকটি উপধারা এই অধ্যায়ে আছে। কিন্তু এসব কেন একটি গণমাধ্যম নীতিমালায় বলতে হবে, তা বোধগম্য নয়। অপর একটি ধারা দেখুন, ‘অনলাইন গণমাধ্যমে প্রচারিত, প্রকাশিত বা সম্প্রচারিত সব তথ্য-উপাত্তে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় তথা সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমমর্যাদা ও সক্রিয় অংশগ্রহণের লক্ষ্যে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নারী সমাজ আমাদের জাতিকে প্রত্যয়দীপ্ত রাখার ব্যাপারে সত্যিকারের অর্থপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, এর স্পষ্ট প্রতিফলন থাকতে হবে।’ এসব ধারা সংযুক্ত করে একটি উদ্যোগকে বাস্তবায়ন অযোগ্য করে তোলার কোনো প্রয়োজন আছে কি?
এই নীতিমালার তৃতীয় অধ্যায়ের ৫ দশমিক ৫ ধারাটি অত্যন্ত সন্দেহজনক। ধারাটি হচ্ছে এই, ‘মানবিক অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো মানুষ বা প্রাণী নির্যাতনের দৃশ্য, তথ্য-উপাত্ত বা দৃশ্যাবলি প্রচার, প্রকাশ বা সম্প্রচার করা যাবে না।’ এই ধারার মানে কী দাঁড়ায়? কোনো মানুষ বা প্রাণী নির্যাতনের দৃশ্য বা দৃশ্যাবলি প্রচার, প্রকাশ বা সম্প্রচার করা যাবে না, এতে কোনো ঝামেলা নেই। কিন্তু ‘তথ্য-উপাত্ত’ কেন প্রচার, প্রকাশ বা সম্প্রচার করা যাবে না? তাহলে গণমাধ্যমের কাজটা কী? এটা কি নিছক ভুল নাকি সব ধরনের নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশে বন্ধের হাতিয়ার?
এই নীতিমালার চতুর্থ অধ্যায় বিজ্ঞাপন-সংক্রান্ত। এটিই এই নীতিমালার সবচেয়ে বড় অধ্যায়। যে কারো মনে হতে পারে, এই নীতিমালা বিজ্ঞাপন নীতিমালা, অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা নয়। বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ বা এর মান নিয়ে সরকার যেন সব দায়িত্ব ঠেলে দিচ্ছে গণমাধ্যমের ওপর। এই শর্তগুলো মানতে হলে প্রতিটি অনলাইন নিউজপোর্টালকে আলাদা করে একটি বিজ্ঞাপন নিরীক্ষণ সেল থাকতে হবে। উদাহরণের জন্য একটি ধারা তুলে দিলাম, ‘বিজ্ঞাপনের অডিও মানসম্মত এবং শ্রুতিমধুর হতে হবে, অতি কোলাহলপূর্ণ ও কর্ণপীড়াদায়ক হবে না। বিজ্ঞাপনে বিকৃত ও অশ্লীল শব্দ, উক্তি, সংলাপ, জিঙ্গেল ও গালিগালাজ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।’ এসব নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার? এ রকম সামঞ্জস্যহীন অন্তত ৩০টি ধারা এই অধ্যায়ে আছে।
এর আগে গত বছর সরকার ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৪’ প্রণয়ন করে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়েছে। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, সেই সমালোচিত নীতিমালা থেকে এই অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালায় ৮০ ভাগের ওপরে কপি করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সর্বোপরি বলা চলে, ‘জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা-২০১৫’ অনলাইন গণমাধ্যমের বিকাশে অবদান রাখবে, এমন প্রত্যাশা থাকলেও এই খসড়া তা পূরণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি বেশির ভাগ ধারাই অস্পষ্ট রয়েছে, এমনটা বলাই যায়।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী