রাষ্ট্রের আয়ব্যয় প্রশ্নের ঊর্ধ্বে কেন?

১
একটি সমাজকে বেশ কিছু মানদণ্ড দিয়ে বোঝা যায়। অর্থনৈতিক, দর্শন, সংস্কৃতি যেমন, তেমনি আইন দিয়েও একটি সমাজকে নির্দিষ্টভাবে বোঝা যায়। রোমান আইন দিয়ে যেমন রোমান সাম্রাজ্য, মুঘল আইন দিয়ে যেমন মুঘল সাম্রাজ্য, ব্রিটিশ ল দিয়ে ইংলিশ সাম্রাজ্য; তেমনি বাংলাদেশি আইন দিয়ে বাংলাদেশকে বোঝা যায়। কিন্তু আমাদের মধ্যে এই বিবেচনা নাই বললেই চলে। গণতন্ত্রের সংগ্রাম যে গণতান্ত্রিক আইন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামও বটে, এটা আমরা ভুলে বসে আছি। বলা হয়, দুনিয়াজুড়ে জনপ্রিয় ও প্রচলিত মিথ্যাচারগুলোর বেশির ভাগই আইন নিয়ে। সম্ভবত, বাংলাদেশে এটা আরো বেশি। অথচ আমাদের জ্ঞান চর্চায় অর্থনীতি, দর্শন ও ইতিহাসের তুলনায় আইনকে দ্বিতীয় সারির বিষয় মনে করা হয়।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষায় এ দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে রক্তক্ষয়ী লড়াই করেছে। দুবার স্বাধীনতাসহ বহু ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু দিন শেষে দেখা গেছে ব্যক্তি বা দল বা পোশাকের বদল ঘটলেও যে ব্যবস্থা বদলের আশায় ত্যাগ স্বীকার করেছে, তা অর্জিত হয়নি। কারণ দেশ ভেঙে, দেশ স্বাধীন করলেই কিংবা সরকার বিদায় করলেই একটি সমাজ বা রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হয় না। তার জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক আইন-কানুন ও বিধি।
অথবা বলা যায়, নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে আমরা যত মাথা ঘামাই, রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে তার এক ভাগও না।
আমরা যখন সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা ইত্যাদি নীতিগুলো দেখি আর ব্যবহারিক জীবনে জানতে পাই উল্টো ঘটনা, তখন ধরে নিই- রাষ্ট্র সংবিধান মতে চলছে না। কিন্তু একটু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যাবে- রাষ্ট্র যথার্থই সংবিধানসম্মতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। একটু উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে: জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এবং এসব নীতির বিবরণ দিয়ে অনুচ্ছেদ ৮(২)-এ বলা হয়েছে : ‘এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ পরিচালনার মূল সূত্র হইবে। আইন প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবে। এই সংবিধান ও অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকের কাজের ভিত্তি হইবে...।’ এই পর্যন্ত এসে একটু থামুন, কারণ পরের অংশটুকুতে একটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে একটি ‘তবে’ দিয়ে। বলা হয়েছে- ‘তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না।’ এই আপাত নির্দোষ ‘তবে’ শব্দযুক্ত শর্ত বাক্যটি বুঝলেই টের পাওয়া যাবে- কেন মন্ত্রী-এমপিরা ব্যবসায়ীদের সাফাই গায়, মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দেয়। কেন অনুচ্ছেদ ১৫ তে ‘অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসা, জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ, যুক্তিসঙ্গত মজুরি, বিশ্রাম-বিনোদন ও অবকাশের অধিকার নিশ্চিত করা’-এর কথা বলা হলেও কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে? কেন তোবা গার্মেন্টসের শ্রমিকরা পাওনা মজুরির জন্য অনশন করে? কেন পুনর্বাসন ছাড়াই বস্তি উজাড় হয়?
২
মওলানা ভাসানী, মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে সর্বদলীয় সর্বজনীন ভোটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন কর্ম পরিষদের নেতৃত্বে ১৯৬৪ সালের ১৮ মার্চ পথসভা ও খণ্ড মিছিল এবং ১৯ মার্চ হরতাল ও পল্টন ময়দানে জনসভার আহ্বানে একটি লিফলেট বের করা হয়। সেই লিফলেটে বলা হয়েছিল : যে দেশবাসী রাষ্ট্র পরিচালনার রসদ জোগাইতেছে, খাজনা-ট্যাক্স যোগাইতেছে, তাঁদের দেওয়া টাকা কীভাবে খরচ হয় তাহাতেও তাঁহাদের মতামতের কোনো সুযোগ নাই- কোনো স্বাধীন দেশে এ ব্যবস্থা চলিতে পারে না। অথচ বর্তমান সরকার উক্ত অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেশে চালু করিতে চাহিতেছেন এবং ক্ষমতাবিহীন জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদগুলিকে এক তামাসায় পরিণত করিয়া অর্ডিন্যান্স- এর দ্বারা দেশ শাসন করিয়া চলিয়াছেন।
সেদিনের সেই কথা কি স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সময় মনে রাখা হয়েছিল? যে দাবি আইয়ুব খানের নিকট উত্থাপন করা হয়েছিল, পরে উত্থাপনকারীরা ক্ষমতায় গিয়ে তা কি মনে রেখেছেন? সংবিধান বলছে, কেউ কথা রাখেনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ভূখণ্ডের জনগণ ২২ পরিবারের হাত থেকে মুক্তি চেয়েছিল। কিন্তু এখন বেশুমার কোটিপতি। রক্ত দিয়ে যে দেশটির স্বাধীনতা অর্জিত হয়, সে দেশটি দুর্নীতির জন্য লাগাতার চ্যাম্পিয়ন হয়, পদ্মা সেতুর চুক্তি প্রত্যাহার হয়। বেশির ভাগ সম্পদশালীই সরকারি সম্পত্তি, ব্যাংক-বীমা-বাণিজ্য ইত্যাদি লুটপাটের মধ্যদিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। লুটপাটের এক সংস্কৃতিই যেন গড়ে উঠেছে। কিন্তু কীভাবে সম্ভব হলো? রাষ্ট্র তো পরিচালিত হয় সংবিধান অনুযায়ী। কাজেই রাষ্ট্রের চরিত্র প্রতিফলিত হয় সংবিধানের মধ্যে।
সংবিধানের ৭নং অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে’ জনগণের ক্ষমতা চর্চার সবচেয়ে বড় তিন প্রতিষ্ঠানের একটি হলো সংসদ। ৬৫ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদের। সংবিধানের পঞ্চম ভাগের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে আইন প্রণয়ন ও অর্থ সংক্রান্ত পদ্ধতির দিক নির্দেশনা দেওয়া আছে। সংবিধান ‘আইন প্রণয়ন ও অর্থ সংক্রান্ত পদ্ধতি’ পরিচ্ছেদে অনুচ্ছেদ ৮০ থেকে ৯০-এর মধ্যে অর্থ বিল, বাজেট, বার্ষিক বিবৃতির পদ্ধতি ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে।
খেয়াল করার বিষয়, সংবিধান রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়কে যে ভাষায় প্রশ্নের ঊর্ধ্বে, আইন-আদালতের ধরা ছোঁয়ার বাইরে নিরঙ্কুশ করেছে তেমন ভাষা আর কোনো বিষয়েই করেনি, না কারো জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নেও না। অনুচ্ছেদ ৮০-তে আইন প্রণয়ন পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে- প্রতিটি আইন সংসদে বিল আকারে উত্থাপিত হবে এবং সংসদ কর্তৃক পাস হলে তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য প্রেরিত হবে এবং অর্থবিল ছাড়া অন্য কোনো বিলের ক্ষেত্রে তিনি বিলের কোনো বিশেষ বিধান পুনর্বিবেচনা কিংবা কোনো সংশোধনী বিবেচনার জন্য সংসদে পাঠাতে পারবেন। সংসদ এ ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে বিবেচনাসহ বা বিবেচনা ছাড়া বিলটি পুনরায় পাস করে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রেরণ করলে তিনি স্বাক্ষর করুন বা না করুন নির্দিষ্ট সময় পরে বিলটি আইনে পরিণত হবে। অর্থাৎ আইন প্রণয়নের যে প্রক্রিয়া, তাতে অর্থ বিল যেখানে রাষ্ট্রের আয়ব্যয়ের প্রশ্ন জড়িত সেখানে অন্য কারো তো প্রশ্নই ওঠে না, স্বয়ং রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত বিলটি পুনর্বিবেচনার অনুরোধও করতে পারেন না।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী যেসব সাংবিধানিক পদ রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সবচেয়ে কম আলোচিত, কম পরিচিত পদের নাম মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক। সংবিধানের অষ্টম ভাগের ছয়টি অনুচ্ছেদের মাঝে (১২৭-১৩২) মহাহিসাব নিরীক্ষকের ক্ষমতা, কার্যাবলী, কর্মের মেয়াদ ইত্যাদির বিবরণ দেওয়া হয়েছে। অনুচ্ছেদ ১২৭-এ বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি একজন মহা হিসাব নিরীক্ষক নিয়োগ করবেন (প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে এ পদেও তাঁরই পছন্দসই একজন ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে বাধ্য থাকেন রাষ্ট্রপতি)। প্রজাতন্ত্রের সরকারি হিসাব, সরকারি কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারীর সরকারি হিসাব ইত্যাদির নিরীক্ষা ও রিপোর্ট প্রদান তার দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে (পড়–ন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে) তিনি যেরূপ নির্ধারণ করবেন, সেই আকার ও পদ্ধতিতে প্রজাতন্ত্রের হিসাব রক্ষিত হবে। অথচ আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা কথায় কথায় যেসব দেশের উদাহরণ দিতে পছন্দ করেন তারাও অন্তত এ পদে বিরোধীদলের কাউকে না কাউকে বসিয়ে থাকেন। বিরোধীদলকে ডেপুটি স্পীকারের পদ দিয়ে আমাদের ফায়দা কী, যদি না হিসাব নিরীক্ষকের পদটি না দেওয়া হয়। আমাদের সংবিধান বলেন, মহা হিসাব নিরীক্ষক কথিত পদ্ধতিতে রক্ষিত হিসাব সম্পর্কিত রিপোর্ট রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করবেন এবং রাষ্ট্রপতি তা সংসদে পেশ করার ব্যবস্থা করবেন। তারপর সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধিতে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত একটি স্থায়ী কমিটি করার বিধান রয়েছে। অথচ সংসদে এ নিয়ে আমরা আলোচনা করতে দেখিনি কখনো। সংসদ প্রধান বা প্রধানমন্ত্রী, যিনি একমাত্র ক্ষমতার অধিকারী, যার আনুকল্য ছাড়া আলোচনা করার সুযোগ নেই। সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধির ২৩৩-এ অন্যান্যের মধ্যে বলা হয়েছে, উক্ত কমিটি সরকারের বার্ষিক আর্থিক হিসাব পরীক্ষা করবে এবং কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি বা অনিয়ম পরীক্ষা করে তা দূরীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ সংসদে রিপোর্ট পেশ করবে। কিন্তু খেয়াল করে দেখা যাবে, অনিয়মকারীদের শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা, শাস্তি সুপারিশ করার এখতিয়ারও নেই এই কমিটির। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধের ভবিষ্যৎ কী হবে, এটা আলোচনা না করলেও চলে। গত ৪২ বছরে মহা হিসাব নিরীক্ষক ও সংসদীয় কমিটি বড় কোনো গড়মিল আবিষ্কার করতে পেরেছে বলে জানা নেই।
সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ ও লুটপাট বন্ধের ব্যবস্থা না করে যত বড় বড় বাজেট, যত বড় উন্নয়ন প্রকল্প, যত বেশি করারোপ, যত বেশি নির্মাণ কর্ম চলবে; তত বেশি বৈষম্য, তত বেশি সম্পদের পুঞ্জিভবন, তত বেশি নিঃস্বকরণ আর তত বেশি কালো টাকার পাহাড় তৈরির ব্যবস্থা নিরঙ্কুশ হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের আয়-ব্যয় যদি প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকে তবে আর এত রক্ত দান কেন করলাম আমরা?
লেখক : প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম|