যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা
সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি

কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে এ রকম দেশগুলোর পতাকা স্থায়ীভাবে রাখা আছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবনের প্রধান ফটকের পাশে। ৫৩ বছর পরে গত ১৯ জুলাই রোববার মধ্যরাত থেকে সেখানে কিউবার লাল, সাদা ও নীল রঙের পতাকাও উড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রে কিউবার দূতাবাসটি প্রেসিডেন্টের আবাসিক কার্যালয় হোয়াইট হাউসের কাছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পতাকা তোলার পরপরই সেখানে তোলা হয়েছে কিউবার পতাকা। কিউবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুনো রদ্রিগেজ নিজে উপস্থিত ছিলেন সেই পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে। একইভাবে হাভানায় এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ‘ইন্টারেস্ট সেকশন’টি ছিল, সেটি পরিণত হয়েছে পূর্ণাঙ্গ দূতাবাসে। কিন্তু ৫৩ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকার পরিবর্তনের যে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সরে কি এসেছে সেখান থেকে?
এ প্রশ্নের উত্তরের খানিকটা আভাস মিলছে রিপাবলিকানদের সরাসরি বিরোধিতার মধ্যে। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ও কয়েকজন আইনজীবী সরাসরি ঘোষণা দিয়েছেন, এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে না। ওবামা প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তকে ভবিষ্যতে তাঁরা বাতিল করে দেবেন। এমনকি ওবামার বিভিন্ন বক্তব্যেও বিশেষ কিছু শব্দ আছে, যা থেকে নিশ্চিত, কোনো পরিবর্তন আসেনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থানে।
কিউবার পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের আগ্রহ অবশ্য বরাবরই ছিল। ১৯৫৯ সালে কিউবায় বিপ্লব হয় আর ১৯৬১ সালে হাভানার সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদ করে ওয়াশিংটন। তখন এই দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে ওঠে মস্কো। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার পতন ঘটার পর কিউবা অর্থনৈতিক দোলাচলে পড়ে যায়। এ সময় কিউবার অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার করে ভেনেজুয়েলা ও কিউবার মধ্যকার সম্পর্ক। কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক অস্থিরতা বেশ কয়েক বছর ধরে কিউবাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের সম্ভাবনা দেখা দেয় বারাক ওবামার প্রথম দফার শাসনকালে। ক্লিনটনের সময় কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশন্স প্রণীত ১৯৯৯-এর টাস্কফোর্স রিপোর্টকে ভিত্তি করে ওবামা প্রশাসন নতুন করে কাজ শুরু করে। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর বিশ্বের মানুষকে তাক লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রো ঘোষণা দেন, দুই রাষ্ট্রের সম্পর্ককে তাঁরা স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসবেন। এরপর গত এপ্রিলে প্যারাগুয়েতে এক সম্মেলন চলার ফাঁকে দুই দেশের দুই প্রেসিডেন্ট মিলিত হন একান্ত বৈঠকে। উন্নত বিশ্বেও ধর্মনেতাদের পরোক্ষ প্রভাবের ঘটনা দুর্লভ নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মধ্যকার সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি রেখেছেন পোপ ফ্রান্সিস। যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার সম্পর্কোন্নয়ন প্রচেষ্টা ২০১৪ সালে মুখ থুবড়ে পড়ে কিউবা গোয়েন্দাবৃত্তির দায়ে ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট-এর কন্ট্রাক্টর অ্যালেন গ্রসকে আটক করায়। কয়েক মাস গোপন আলোচনার পর গত বছরের ডিসেম্বরে কিউবা গ্রসসহ কয়েকজনকে মুক্তি দিলে ওবামা ও কাস্ত্রো একই দিনে সম্পর্কোন্নয়নের প্রত্যাশা জানান বিশ্বকে।
কেবল পোপ ফ্রান্সিস নয়, আরো কয়েকজনের তৎপরতা থেকে পরিষ্কার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিমিত্তমাত্র কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর চাপও রয়েছে। চুক্তি হওয়ার আগে কিউবা ঘুরে এসেছেন নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো, তাঁর সঙ্গে ছিলেন মাস্টারকার্ড, জেটব্লু, ফাইজার ও চোবানির প্রধান কর্মকর্তারা। ইউএস চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট টম ডোনাহুয়ে গিয়েছিলেন কারগিলের সিএফও এবং অ্যামওয়ের চেয়ারম্যানসহ কয়েকজনের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে। আটলান্টার মেয়র কাসিম রিড গিয়েছিলেন কিউবার বাজারে কোকাকোলা অনুমোদনের ও ডেল্টা এয়ারলাইনস চালু করার প্রত্যাশা নিয়ে। তার মানে, যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট শক্তির কাছে কিউবা নতুন এক মৃগয়ার ক্ষেত্র যেটি সম্পর্কে তাদের ধারণা এ রকম যে, দীর্ঘ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কিউবার বহুল আলোচিত ও প্রশংসিত শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যচিকিৎসায় ধস নামতে শুরু করেছে। কিউবার নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত তরুণরা এখন আর রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক উদ্যোগে বিশ্বাসী নয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে বাজার এখন সাধারণ কিউবাবাসীর নাগালের বাইরে, যারা কিনা বিভিন্ন রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত উদ্যোগ ও সংস্থাগুলোতে কাজ করে প্রতি মাসে মাত্র ৩০ ডলার আয় করে থাকে। খাদ্যভর্তুকির প্রাচুর্যও সন্তুষ্ট করছে না তাদের... ইত্যাদি ইত্যাদি। যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট শক্তির আশার জায়গা এই যে, সাম্প্রতিক এক জরিপ থেকে জানতে পেরেছে তারা, ৮০ ভাগ কিউবানই দেশটির অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে খুশি নয় এবং নিজের উদ্যোগে ব্যবসা পরিচালনা করতে আগ্রহী ৭০ ভাগ মানুষ। চিন্তার ক্ষেত্রে সামান্য একটু সংশোধনীই অবশ্য তাদের আগ্রহকে দমিয়ে দিতে পারে যদি তারা ভাবতে পারে, দীর্ঘ অর্থনৈতিক সংকট থাকার পরও কিউবা একটি স্থিতিশীল শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য-চিকিৎসাব্যবস্থা অব্যাহত রেখেছে; যা তাদের অসম্ভব প্রাণশক্তির অধিকারী করে তুলেছে।
এমনকি ফিদেল কাস্ত্রোকে বারবার পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার যুক্তরাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পরও কিউবা বিভিন্ন সময় সম্পর্কোন্নয়নের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে। কিউবার দিক থেকে তাই কূটনৈতিক সম্পর্কের এই পুনঃস্থাপন নতুন কোনো রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রকাশ নয়। কিন্তু বারাক ওবামার ঘোষণায় উচ্চারিত ‘promoting change’শব্দরাজি যে-কাউকে মনে করিয়ে দেবে কিউবার শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্য থেকে রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো সরে আসেনি। সম্পর্ক স্থাপনের যুক্তি হিসেবে তিনি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বনীতি কমিউনিস্ট কিউবায় কোনো পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছে, বরং সরাসরি সম্পৃক্ত হয়েই কিউবাকে গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির পথে আনতে হবে।
অবশ্য ওবামার ধারণা নয়, কিউবার নীতিনির্ধারকদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাষ্ট্রের ভেতর উদ্ভূত দুটি অর্থনৈতিক স্তর, যার একদিকে রয়েছে পর্যটন ক্ষেত্র থেকে আহরিত ডলার ও বিদেশে অবস্থানরত আত্মীয়দের কাছে আসা রেমিটেন্স-সমৃদ্ধ কিউবানরা, অন্যদিকে রয়েছে সরকারি বেতনে জীবনযাপনকারী কিউবানরা। রাউল কাস্ত্রো এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য এরই মধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক সংস্কার করেছেন। যার ফলে প্রায় পাঁচ লাখ কিউবান বা প্রতি ১০ জনের একজন কিউবানই এখন সরকারি পরিসংখ্যানেই সেলফ-এমপ্লয়েড।
এককথায়, রাউল কাস্ত্রো রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব সংস্কার আনছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের পুনঃস্থাপন তার পরিপূরক উদ্যোগ। রাজনৈতিকভাবেও কিউবা এত অনমনীয় যে, সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ গতি পায় মূলত যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের মদদদাতা রাষ্ট্রগুলোর তালিকা থেকে কিউবাকে বাদ দেওয়ার পর। কিউবার পক্ষ থেকে এ রকম কথাও বলা হয়েছিল, গুয়ানতানামো বে ফেরত না পেলে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের সম্ভাবনা নেই। ১৯ জুলাই কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পরও কিউবার পক্ষ থেকে একই দাবি তোলা হয়েছে। উভয় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণের বিতর্কিত দাবিরও কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। কাজেই কিউবা ও যুক্তরাষ্ট্র ভেতরে ভেতরে এখনো যুদ্ধমান। ‘অ্যা হিস্ট্রি অব কিউবান রেভ্যুলেশন’-এর রচয়িতা ইতিহাসবিদ আভিভা চমস্কি দুই রাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মন্তব্য করেছেন, এটি কোনো অপ্রত্যাশিত বিষয় নয়। তাঁর কাছে বরং অপ্রত্যাশিত হলো, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনো বারাক ওবামার প্রতিটি ঘোষণাই যুক্তরাষ্ট্র কিউবার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলোতে অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ করার যে নীতি দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করে আসছে, অব্যাহতভাবে তার প্রকাশ ঘটাচ্ছে। ‘বিধ্বংসী ইউএসএইড প্রকল্পসমূহ’ চিহ্নিত করে তিনি এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিউবার জনগণের অধিকার চায়, তা হলে তাকে তার তথাকথিত ‘গণতন্ত্র আনয়ন’ প্রকল্পকে পরিত্যাগ করতে হবে। ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের কন্ট্রাক্টর অ্যালেন গ্রসের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনাটিকে ফিরে দেখলেই বোঝা যায়, আভিভা চমস্কির পর্যবেক্ষণ কোন সত্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র যখন অব্যাহতভাবে এই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে পরিবর্তন আনয়নের স্বপ্ন দেখে চলে, কিউবার জনগণকে ‘সাহায্য’ করার কথা বলে, তখন এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কিউবার কাছে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কি কিছুই পাওয়ার নেই? এটি ঠিক, অন্যান্য দেশের মতো কিউবারও নানা সমস্যা রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রেরও এমন কিছু সমস্যা রয়েছে, যা কিউবার চেয়েও মারাত্মক। নেটফা ফ্রিম্যান এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে মনে করিয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা, সর্বোচ্চ শাস্তির বা মৃত্যুদণ্ডের হারের কথা, বর্ণবাদজাত বিভিন্ন ঘটনার কথা, সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসেবার অনুপস্থিতির কথা। অথচ সামাজিক সূচকের দিক থেকে কিউবার অবস্থান ঈর্ষণীয়। তা ছাড়া সবাই জানেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দুর্যোগে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে উপস্থিত হয়েছে শর্তযুক্ত সাহায্য ও সামরিক শক্তি নিয়ে, বিশ্বব্যাংক কিংবা আইএমএফের প্রেসক্রিপশন নিয়ে, একই স্থানে কিউবা গিয়েছে শর্তহীনভাবে ডাক্তার ও শিক্ষকদের নিয়ে নিজস্ব উপকরণ ও সাহায্য সামগ্রীসমেত। তাই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আহ্বান নিয়ে অন্তত কিউবায় সাড়া পাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব। কিউবাকে যৌক্তিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা না করলে যুক্তরাষ্ট্রের সমীকরণে ভুল হয়ে যাবে বিশেষ করে রিপাবলিকানরা যখন প্রকাশ্যেই ভুল করার জন্য তৈরি হয়ে আছে।
লেখক : সাংবাদিক