তাজউদ্দীনের জন্মদিন
আলোকের দিশারি

(তাজউদ্দীন আহমদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই। তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সম্মুখ সারির নেতা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন। আজ এই সৎ ও মেধাবী রাজনীতিবিদের জন্মদিনে তাঁর মেয়ে শারমিন আহমদের স্মৃতিচারণামূলক লেখাটি ছাপা হলো। রচনাটি শারমিন আহমদের প্রকাশিতব্য বই ‘মুক্তির কাণ্ডারী তাজউদ্দীন : কন্যার অভিবাদন’ থেকে নেওয়া হয়েছে।)
১৯৬৬ বা ১৯৬৭ সালের কথা। ময়মনসিংহ কারাগার থেকে রাজবন্দি তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর স্ত্রীকে লিখেছিলেন, ‘সাধারণ, অসাধারণ, ছোট, বড় কোনো অভিজ্ঞতাই ফেলে দেবার নয়। সব অভিজ্ঞতাই জীবনের বিভিন্ন ফুলে গাঁথা মালা। জীবনের অমূল্য সঞ্চয়।’
হাসিকান্না, সাফল্য, ব্যর্থতা, সাধারণ, অসাধারণ এমনি সব ঘটনায় গড়া অতীতের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলে মনে হয়, সত্যিই জীবনে সব ধরনের অভিজ্ঞতারই প্রয়োজন রয়েছে। জীবনের প্রতিটি ঘটনাই জীবনের এক একটি রত্নস্বরূপ। তারা যেন কোনো এক অদৃশ্য সুতায় গাঁথা বাহারি ফুলের সমাহার; জীবনের পরবর্তী ধাপে উত্তরণের পথনির্দেশক, যেন এক অনুপম, অপার্থিব সত্ত্বা!
আমি আজ এমনি কিছু স্মৃতিচারণা করব। ১৯৬৯ সালের একটি স্মৃতি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবে মুক্তি পেয়েছেন। তিনি পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং আমার বাবা তাজউদ্দীন আহমদ সে সময় সাধারণ সম্পাদক। তাঁরা সে সময়গুলোতে সব সময়ই পরস্পরের বাড়িতে যাতায়াত করতেন। দলীয় ও দেশ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। একত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। সেদিনও তিনি এলেন। ৭৫১ সাতমসজিদ রোডে অবস্থিত আমাদের ধানমণ্ডির বাড়িটিতে। সে সময় পড়ন্ত বিকেল। প্রবেশদ্বারের দেয়ালটি মাধবীলতায় ছাওয়া। আমি ও আমার ছোটবোন রিমি বাড়ির ভেতরে ঢোকার পথটিতে দাঁড়িয়ে একমনে স্কিপিং করছি। স্কিপিং করতে করতেই হঠাৎ চোখ পড়ল ওনার দিকে। উনি দাঁড়িয়ে এই দুই বালিকার খেলা দেখছেন। ঠোঁটে কৌতুকমাখা স্মিত স্নেহময় হাসি- যেন কোনো মজার দৃশ্য উপভোগ করছেন। যেন তাঁর নেই অন্য কোনো তাড়া। আমরা স্কিপিং থামিয়ে আনন্দে ‘মুজিব কাকু’ বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। (বঙ্গবন্ধুকে আমরা ওই নামেই সম্বোধন করতাম)। উনি এগিয়ে এসে আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমরা কোন ক্লাসে উঠেছি, কোন স্কুলে পড়ছি, এমনি টুকিটাকি কথা জিজ্ঞেস করলেন। খুব ছোট্ট স্মৃতি। মাত্র কয়েক মিনিটের। পরবর্তীকালে মুজিব কাকুর সঙ্গে আরো কত দেখা হয়েছে। কত গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশে তাঁর ভাষণ শুনেছি, ঘরোয়া পরিবেশে আলোচনা খুব কাছ থেকে শুনেছি, অল্প স্বল্প কথাও বলেছি তাঁর সঙ্গে। অথচ স্মৃতির বর্ণালি উদ্যানে ওই মাধবীলতায় ঘেরা পড়ন্ত বিকেলে, এক অবিসংবাদিত নেতার স্নেহময় কৌতুকমাখা চোখের দৃষ্টিটিই হৃদয়কে অভিষিক্ত করেছে।
১৯৭০ সালের শেষের দিকে আমাদের একতলার বারান্দায় ঝোলানো টব, যাতে মানিপ্ল্যান্ট শাখা-প্রশাখায় বৃদ্ধি পেয়ে চলছিল, তাতে এক বুলবুলি পাখি এসে বাসা বাঁধল। শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাদের আব্বুর (আমরা বাবাকে আব্বু সম্বোধন করতাম) সচেতন দৃষ্টি ছিল যাতে পাখিটিকে আমরা বিরক্ত না করি; সে যাতে নির্ভয়ে, নিরাপদে তার সযত্নে গড়া নীড়টিতে শান্তির আশ্রয় খুঁজে পায়। ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পরদিন আমি ও আমার ছোট দুই বোন রিমি ও মিমি আব্বুকে খুঁজে পাই ওই বুলবুলির পাখির ভাঙা নীড়টির সামনে। আব্বুর মেলে ধরা দুই হাতে পাখিটির প্রাণহীন দেহ। আব্বুর সজল দুটি চোখে মৌন আর্তনাদ। এরপর তিনি সারা দিন বিমর্ষ হয়ে রইলেন। বারবার নিজেকে ধিক্কার দিলেন পাখিটির নিরাপত্তাকে নিশ্চিত না করার জন্য। মাত্র কিছুকাল পরেই ওই মানুষটিই এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, লাখকোটি নির্দোষ প্রাণের আকুতি এক নিরাপদ মুক্ত স্বদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
১৯৭১ সালের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনের সময় আমাদের বৈঠকখানার জানালার সামনে ছোটখাটো হাসিখুশি চেহারার এক ব্যক্তি এসে উপস্থিত হলেন। আমি ও রিমি তখন জানালার সামনে বসে ইকড়িমিকড়ি চামচিকিড় জাতীয় খেলা খেলছি। তিনি আমাকে ও রিমিকে ইশারায় ডাকলেন। আমাদের নাম জিজ্ঞাসা করলেন। আমরা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে আব্বুকে ডেকে দিতে বললেন। বললেন, ‘ওনাকে বলো যে তেজগাঁও থানা হতে শিলু দারোগা দেখা করতে এসেছে’। (ওনার প্রকৃত নাম ছিল সিরাজউদ্দিন)। আমরা দৌড়ে ভেতরে গিয়ে আব্বুকে খবর দিলাম। আব্বু তখন জরুরি কোনো বিবৃতি লেখার কাজে ব্যস্ত। তিনি খবরটি শোনামাত্রই লেখার কাজ অসমাপ্ত রেখে বৈঠকখানায় গেলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। এরপর বেশ কয়েকবারই শিলু দারোগা আমাদের বাসায় এসেছেন প্রায় একই সময়ে। সন্ধ্যা হয় হয়, এই সময়টিতে। তিনি ভেতরে ঢুকতেন না, বৈঠকখানার জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন আব্বুর অপেক্ষায়।
পরে জেনেছিলাম যে তিনি পাকিস্তানি প্রশাসনের ভেতরের গোপন খবর জোগাড় করে আব্বুর কাছে পৌঁছে দিতেন। বিশেষ করে তারা যেসব বাঙালি পুলিশ কর্মচারীদের ওপর কড়া নজর রাখছে, তাদের নিরস্ত্র করছে এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অবাঙালি সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে চালান দিয়ে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে, এমনি সব গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ যা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হতে পারে।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করল। আব্বু, আত্মগোপন করে তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে স্বাধীন বাংলা সরকার গঠন করলেন। তিনি তখন হলেন পাকিস্তান সামরিক সরকারের একনম্বর শত্রু। পাকিস্তানি শোষক সম্প্রদায় তখন প্রচার করল যে, তাঁর নাম আসলে তাজউদ্দীন নয়, ‘তেজারাম’। তিনি ভারতীয় হিন্দু এবং ভারতীয় চক্রান্তকে সফল করার জন্যই তাজউদ্দীন নামে তাঁর পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ। তারা তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম মৃত্যু তালিকায় ঢোকাল। আম্মা, সে সময় তাঁর চার নাবালক সন্তানসহ গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে চষে বেড়াচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।
ঠিক এমনি এক দুর্যোগপূর্ণ সময়েই আবারও দেখা সেই শিলু দারোগার সঙ্গে, অনেকটা অলৌকিকভাবেই। এক গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথের ধারে আরো কিছু মানুষের সঙ্গে তিনি বসে রয়েছেন। আমাদের দুই বোনকে তাড়া খাওয়া মানুষের ভিড়ের মধ্যেও চিনতে পারলেন। (আমরা সবে অন্য একটি গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে এসেছি। সেই গ্রামটিকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল।) এরপর সেই শিলু দারোগা হলেন আমাদের দুর্যোগপূর্ণ যাত্রাপথের সঙ্গী।
লাশের পাহাড়, আগুনে ছাই হয়ে যাওয়া কত গ্রাম অতিক্রম করে, পাকিস্তানি মিলিটারির গানবোট ও জিপ এড়িয়ে লাখ লাখ শরণার্থীর সঙ্গে আমরাও রওনা দিলাম ভারতীয় সীমান্তের পথে। রহমত আলী (বর্তমানে গাজীপুর জেলা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাংসদ), তাঁর শ্যালক রতন ভাই, মুক্তিযোদ্ধা মুস্তফা, মোশারফ ও শিলু দারোগাসহ আমরা একদিন ভারতীয় সীমান্তে প্রবেশ করলাম। আমাদের পৌঁছে দিয়েই শিলু দারোগা সেখান থেকেই বিদায় নিলেন। বললেন, শিগগিরই তাঁর স্ত্রী, ছেলেসহ আমাদের সঙ্গে মিলিত হবেন। তিনি চলে গেলেন। পেছনে ফেলে আসা প্রিয় জন্মভূমির বিচ্ছেদ বেদনার মতোই, তাকে হারানোর ব্যথা আমাদের দুই বোনকে ব্যথাতুর করে তুলল। তিনি ছিলেন ছোটবড়ো সবার যথার্থ সঙ্গী। আম্মার হাতে মুঠো করা বাংলাদেশের মাটি। শিলু দারোগা ফিরে গেলেন সেই মাটিতেই। কয়েক মাস পর আমরা সেই মর্মান্তিক খবরটি শুনতে পেলাম। শিলু দারোগা এই পৃথিবীতে আর নেই। তাঁর স্ত্রীর সামনেই তাঁর একমাত্র ছেলেসহ পাকিস্তানি মিলিটারিরা তাঁকে গুলি করে হত্যা করেছে। ওই মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী তাঁর স্ত্রী হারিয়েছেন মানসিক ভারসাম্য। শিলু দারোগা চলে গেলেন, বিজয়ের স্বপ্ন বুকে গেঁথে নিয়ে। নিঃসাড় মৌন প্রদোষের আঁধারে যেন তিনি আবারও ফিরে আসবেন, নতুন কোনো সংবাদ নিয়ে। এমনি প্রত্যাশায় আমরাও দিন কাটালাম অনেকদিন পর্যন্ত।
জীবনের এমনি সব ঘটনাবলি থেকে আহরিত অভিজ্ঞতার আলোকে জীবনের অনিত্য অবস্থান সম্বন্ধে ধারণা খুব অল্প বয়সেই হৃদয়ে প্রথিত হয়ে যায়। মানুষকে তার বিশাল পরিচিতির বাইরেও তার অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে একজন সম্পূর্ণ মানুষকে খোঁজার এবং জানার প্রচেষ্টাও এই অনিত্য জীবনের এক নিত্য অন্বেষায় রূপান্তরিত হয়।
শারমিন আহমদ : বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে।