ডেসপাইট বিয়িং এ ওমেন
মোদি আছেন ঘরে ঘরে

টুইটারে পোস্ট দিয়ে বিপদে পড়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে যা লিখেছেন, আশা ছিল এতে সবাইকে খুশি করতে পারবেন। তো, কিছু মানুষের কানে লেগেছে তাঁর ভাষা। তাঁরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার অনমনীয় আচরণের প্রশংসা করতে গিয়ে ‘ডেসপাইট বিয়িং এ ওমেন’, অর্থাৎ ‘নারী হওয়া সত্ত্বেও’ শব্দগুলো আগে জুড়ে দিয়েছেন তিনি। এটা তিনি করেছেন অভ্যাসের বশে। যুগ যুগ ধরে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে এভাবেই কথা বলেছেন নারীর ব্যাপারে। এবং এখনো বলছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর যোগ্যতা-মেধা-সাহসিকতা বারবার প্রমাণ হওয়ার পরও নারীর প্রশংসা আসে ওই ক’টি শব্দবন্ধ সঙ্গে করে নিয়েই। সে প্রশংসা যে-ই করুক না কেন। ওই কয়েকটি শব্দবন্ধ শুরুতেই সবাইকে মনে করিয়ে দেবে যে নারী দুর্বল, নারী অপারগ, নারী কম যোগ্য, নারী কম মেধাসম্পন্ন। এবং এত এত কম থাকার পরও কোনো এক নির্দিষ্ট নারী কাজটি পারছে, এ এক বিশাল ব্যাপার।
তো, নারীর প্রতি এ রকম ধারণা শুধু পুরুষেরই, তা নয়—নারীগণেরও। তাঁরাও নিজেদের দুর্বল, পুরুষের থেকে কম যোগ্যতাসম্পন্ন ও কম মেধাবী, কম সাহসী ভাবতেই অভ্যস্ত। এ দেশের, এই উপমহাদেশের নারী-পুরুষ এখনো কোনটি নারীর কাজ, কোনটি পুরুষের কাজ—তা মনের মধ্যে সাইনবোর্ডে লিখে লোহার পেরেক দিয়ে টাইট করে আটকে দিয়েছেন। ‘মেয়েটা মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও গাড়ি চালায় ভালো; মেয়েটা মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও অনেক সাহসী, চোর ধরেছে; মেয়েটা মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও পুলিশে গেছে এবং ভালো করছে; মেয়েটা মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও অনেক ভালো ডাক্তার, অপারেশনের হাত খুব ভালো; মেয়েটা মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও রাতের বেলা একাই বের হয়ে দরকারি ওষুধ কিনে এনেছে; মেয়েটা মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে; মেয়েটা মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও সব লোকের সঙ্গে তর্ক করেছে; মেয়েটা মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও কঠিন কঠিন অ্যাসাইনমেন্ট করেছে; মেয়েটা মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও একাই বিদেশ ভ্রমণ করেছে...’ আর কত বলব। মেয়ে যা কিছু করেছে, তা বলার আগে শুরুতেই বলে নেওয়া যে সে মেয়ে, তার যোগ্যতা কম, তার এটি পারার কথা নয়, তবু সে পেরেছে। এ হচ্ছে ‘জুতা মেরে গরু দান’।
তো, ভারতের প্রধানমন্ত্রীও নিশ্চয়ই ছোটকাল থেকে, তরুণকাল থেকে এই প্রবীণকাল পর্যন্ত এযাবৎ এভাবেই নারীদের প্রশংসা করেছেন। তাই মাননীয় শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও তাঁর প্রশংসার ধরন পাল্টে যায়নি। এর আগেও লিখেছিলাম—পুরুষ নারীদের পাশে বসে কাজ করে, আড্ডা দেয়, চলে-ফেরে; কিন্তু মনের ভেতরে সে যে পুরুষ, এই অহংকার তার ঘোচে না। সে শ্রেষ্ঠ, কারণ সে পুরুষ—এই বোধটি থেকেই এখন পর্যন্ত এ উপমহাদেশের পুরুষরা বের হয়ে আসতে পারেনি।
সাংবাদিক ফারজানা রূপার রিপোর্ট দেখে একদিন আমাকে একজন বললেন, ‘মেয়ে হয়েও রূপা কত সাহসী।’ মুন্নী সাহাকে নিয়ে কথা প্রসঙ্গে একজন বললেন, ‘ওর মধ্যে মেয়েসুলভ কিছু নাই।’ আমি বললাম, তিনি সাংবাদিক। সাংবাদিকসুলভ বিষয়টা আছে তো? ‘হ্যাঁ, তা আছে। কিন্তু মেয়েসুলভ না।’ অর্থাৎ সাংবাদিক তিনি কতটা হতে পারলেন, কতটা সাহসী হলেন, তার চেয়ে বড় কথা, তিনি মেয়ে হতে পারলেন কি না। তো, এসব আলোচনা-সমালোচনায় এ দেশের নারীরাও পিছিয়ে নেই। তারাও অহরহ অন্য মেয়েকে দেখিয়ে বলছে, মেয়ে হলেও মেয়েটা মেধাবী। মেয়েটা অমুক, মেয়েটা তমুক। তো, পুরুষের ক্ষেত্রেও ‘পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও’ এ শব্দগুলো কখনো কখনো ব্যবহৃত হয়। যেমন—‘ছেলে হলেও ও বাসার কাজ করে, ছেলে হলেও রান্না করে, ছেলে হলেও চরিত্রবান।’
তো, আসি মোদি প্রসঙ্গে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ দেশে সফরে এসেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন; অনেক জটিল, কঠিন গুরুত্বপূর্ণ আলাপ-আলোচনা হয়েছে তাঁদের মধ্যে। কী রকম বজ্রকঠিন হাতে শেখ হাসিনা দেশ চালাচ্ছেন, তা নিজ চোখে দেখে গেছেন। তার পর গিয়ে ওই টুইট করেছেন। এখন মোদি যদি জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের সঙ্গেও বৈঠক করতেন, সে ক্ষেত্রে টুইটারে লিখুন বা না লিখুন, মনের টুইটারে ওই একই কথা ভাবতেন মেরকেল সম্পর্কে—ডেসপাইট বিয়িং এ ওমেন’। এই উপমহাদেশের পুরুষরা এখনো নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে প্রস্তুত নয়। নারীকে এখনো তারা কাদার মতো তুলতুলে, গদগদে বস্তুপিণ্ডই মনে করে। যে কাদামাটি তাঁরা নিজেদের ইচ্ছামতো আকৃতিতে গড়ে নেবেন। এর বাইরে নারী যদি নিজস্ব আকার ধারণ করেন, তাহলে বড় বেকায়দায় পড়ে যান মোদি ভাইয়ারা।
লেখক : সাংবাদিক