Skip to main content
NTV Online

শিশু-কিশোর

শিশু-কিশোর
  • অ ফ A
  • জবর খবর
  • আজব
  • রহস্য
  • ধাঁধা
  • জানো কি
  • তোমাদের জন্য
  • বাংলাদেশ
  • বিশ্ব
  • খেলাধুলা
  • বিনোদন
  • অর্থনীতি
  • শিক্ষা
  • মত-দ্বিমত
  • শিল্প ও সাহিত্য
  • জীবনধারা
  • স্বাস্থ্য
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ভ্রমণ
  • ধর্ম ও জীবন
  • নির্বাচন
  • সহজ ইংরেজি
  • প্রিয় প্রবাসী
  • আইন-কানুন
  • চাকরি চাই
  • অটোমোবাইল
  • হাস্যরস
  • শিশু-কিশোর
  • এনটিভি ইউরোপ
  • এনটিভি মালয়েশিয়া
  • এনটিভি ইউএই
  • English Version
  • এনটিভি বাজার
  • এনটিভি কানেক্ট
  • যোগাযোগ
  • English Version
  • এনটিভি ইউরোপ
  • এনটিভি অস্ট্রেলিয়া
  • এনটিভি ইউএই
  • এনটিভি মালয়েশিয়া
  • এনটিভি কানেক্ট
  • ভিডিও
  • ছবি
  • এনটিভির অনুষ্ঠান
  • বিজ্ঞাপন
  • আর্কাইভ
  • কুইজ
  • বাংলাদেশ
  • বিশ্ব
  • খেলাধুলা
  • বিনোদন
  • অর্থনীতি
  • শিক্ষা
  • মত-দ্বিমত
  • শিল্প ও সাহিত্য
  • জীবনধারা
  • স্বাস্থ্য
  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
  • ভ্রমণ
  • ধর্ম ও জীবন
  • নির্বাচন
  • সহজ ইংরেজি
  • প্রিয় প্রবাসী
  • আইন-কানুন
  • চাকরি চাই
  • অটোমোবাইল
  • হাস্যরস
  • শিশু-কিশোর
  • এনটিভি ইউরোপ
  • এনটিভি মালয়েশিয়া
  • এনটিভি ইউএই
  • English Version
  • এনটিভি বাজার
  • এনটিভি কানেক্ট
  • যোগাযোগ
  • English Version
  • এনটিভি ইউরোপ
  • এনটিভি অস্ট্রেলিয়া
  • এনটিভি ইউএই
  • এনটিভি মালয়েশিয়া
  • এনটিভি কানেক্ট
  • ভিডিও
  • ছবি
  • এনটিভির অনুষ্ঠান
  • বিজ্ঞাপন
  • আর্কাইভ
  • কুইজ
Follow
  • শিশু-কিশোর
ছবি

প্যারিসে রোমান্টিক মুডে মেহজাবীন-আদনান

দেশে দেশে ঈদুল আজহা উদযাপন

‘কনকা সেরা পরিবার’ সিজন- ৩ চ্যাম্পিয়ন ঢাকার শাহিদিন-ফারহানা পরিবার

কোহলির স্বপ্নজয়ে সারথি আনুশকা!

প্রকৃতিপ্রেমী বুবলী

ইউরোপের রাজাদের বিজয় উদযাপন

স্মার্ট লুকে কেয়া পায়েল

বর্ণিল আয়োজনে ‘মার্সেল হা-শো’ গ্র্যান্ড ফিনাল

জাপানে প্রধান উপদেষ্টা

কানে নজরকাড়া লুকে জাহ্নবী কাপুর

ভিডিও
জোনাকির আলো : পর্ব ১২৪
কোরআন অন্বেষা : পর্ব ১৮১
কোরআন অন্বেষা : পর্ব ১৮১
এক্সপার্ট টুডেস কিচেন : পর্ব ৩০১
এক্সপার্ট টুডেস কিচেন : পর্ব ৩০১
সংলাপ প্রতিদিন : পর্ব ২৫১
সংলাপ প্রতিদিন : পর্ব ২৫১
স্বাস্থ্য প্রতিদিন : পর্ব ৫৫৩৮
মহিলাঙ্গন : পর্ব ৩৬১
মহিলাঙ্গন : পর্ব ৩৬১
রাতের আড্ডা : পর্ব ০৭
আপনার জিজ্ঞাসা : বিশেষ পর্ব ৩৩৭৯
আপনার জিজ্ঞাসা : বিশেষ পর্ব ৩৩৭৯
ছাত্রাবাঁশ : পর্ব ১৪
ছাত্রাবাঁশ : পর্ব ১৪
একক নাটক : চীফ গেষ্ট
নাটক : চীফ গেষ্ট
রোজা শাওয়াল রিজওয়ান
১৫:০৮, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
আপডেট: ২০:০৪, ০৩ মে ২০১৬
রোজা শাওয়াল রিজওয়ান
১৫:০৮, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
আপডেট: ২০:০৪, ০৩ মে ২০১৬
আরও খবর
নারীদের ‘মানুষ’ মনে করে না তালেবান : মালালা
ভারতে মুসলিম ছাত্রীদের ‘হিজাব আন্দোলনে’ পাশে দাঁড়ালেন মালালা
বিরুদ্ধে নয়, বিয়ে নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা ছিল : মালালা
কে এই আসসার মালিক?
সুখী হও, বিয়ের পর মালালাকে প্রিয়াঙ্কার শুভেচ্ছাবার্তা

আমি মালালা বলছি

স্কুলে বেড়ে ওঠা

রোজা শাওয়াল রিজওয়ান
১৫:০৮, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
আপডেট: ২০:০৪, ০৩ মে ২০১৬
রোজা শাওয়াল রিজওয়ান
১৫:০৮, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
আপডেট: ২০:০৪, ০৩ মে ২০১৬

৩

স্কুলে বেড়ে ওঠা

ছয় বছর বয়সে আমার মা স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিলেন এবং কাছাকাছি সময়েই স্কুল ছেড়ে দেন। গ্রামের মানুষের কাছে তিনি কিছুটা ‘অস্বাভাবিক’ ছিলেন, কারণ তাঁর বাবা ও ভাইয়েরা তাঁকে স্কুলে যেতে উৎসাহিত করতেন। ক্লাসভর্তি ছেলের মধ্যে তিনিই একমাত্র মেয়ে ছিলেন। গর্বিত পদক্ষেপে তিনি ব্যাগভর্তি বই নিয়ে স্কুলে যেতেন এবং অন্য ছেলেদের চেয়ে মেধাবী ছিলেন বলে দাবি করেন। প্রতিদিন বাসায় তাঁর জ্ঞাতিবোনদের খেলতে দেখে মায়ের খুব ঈর্ষা হতো। স্কুলে পড়া আর না পড়া একই কথা ছিল, কারণ শেষমেশ তাঁকে রান্না, ধোয়ামোছা আর সন্তান লালনপালনই করতে হবে। তাই তিনি একদিন নয় আনা দিয়ে তাঁর বইগুলো বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে মিষ্টি কিনে বাড়ি ফেরেন, এবং আর স্কুলমুখো হননি। তাঁর বাবা তাঁকে কিছুই বলেননি। মা বলেন, নানা আসলে খেয়ালই করেননি। প্রতিদিন খুব সকালে তিনি ননী দিয়ে ভুট্টার রুটি খেয়ে চামড়ার ফিতায় তাঁর জার্মান পিস্তল ঝুলিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতেন এবং স্থানীয় রাজনীতি ও দ্বন্দ্ব মিটমাট করার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। এ ছাড়া তাঁর আরো সাতটি ছেলেমেয়ের কথাও চিন্তা করার ছিল।

 আমার বাবার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরই কেবল মায়ের মাঝে অনুশোচনা জাগ্রত হলো। বাবা অনেক বই পড়েছিলেন, তিনি মাকে এমন সব কবিতা পাঠাতেন যা মা পড়তে পারতেন না, এবং বাবার স্বপ্ন-লক্ষ্য ছিল নিজে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা। স্ত্রী হিসেবে মা চাইতেন বাবাকে এই লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে। যতদূর বাবার মনে পড়ে, তাঁর স্বপ্ন ছিল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা, কিন্তু তাঁর পরিবারের সঙ্গে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির যোগাযোগ এবং অর্থ না থাকায় এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা তাঁর পক্ষে অত্যন্ত কঠিন ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, জ্ঞানের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। তাঁর মনে পড়ে, গ্রামের নদীর পানি কোথা থেকে আসে এবং কোথায় যায়– এ নিয়ে তিনি বিভ্রান্ত ছিলেন – পরে পানিচক্রের কথা জানার পর তার বিভ্রান্তি দূর হয়।

তাঁর নিজের গ্রামের স্কুল ছিল ছোট্ট একটা ভবনে। তাঁদের অনেক ক্লাসই খালি মাটিতে গাছের নিচে বসে করতে হতো। কোনো শৌচাগার না থাকায় ছাত্ররা মাঠে গিয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিত। তবু বাবা নিজেকে ভাগ্যবান বলে দাবি করেন। আমার দেশের লাখ লাখ মেয়ের মতো আমার ফুপুরাও স্কুলে যায়নি। শিক্ষা ছিল বাবার কাছে এক মূল্যবান উপহার। তিনি বিশ্বাস করেন, পাকিস্তানের সব সমস্যার মূলে আছে অশিক্ষা। রাজনীতিবিদরা সাধারণ মানুষকে বোকা বানাত এবং খারাপ প্রশাসকরা পুনর্নির্বাচিত হতো মানুষের অজ্ঞতার কারণেই। বাবা ভাবতেন, ধনী-গরিব ছেলেমেয়ে সবারই স্কুলে যাওয়া উচিত। বাবার স্বপ্নের স্কুলে থাকবে লাইব্রেরি, কম্পিউটার, দেয়ালে উজ্জ্বল পোস্টার এবং সর্বোপরি শৌচাগার।

 সর্বকনিষ্ঠ ছেলেকে নিয়ে আমার দাদার একটা আলাদা স্বপ্ন ছিল – তিনি চাইতেন বাবা ডাক্তার হোক– এবং দুই ছেলের একজন হিসেবে সংসারের আয় বৃদ্ধিতে অবদান রাখুক। বাবার বড় ভাই সাঈদ রমজান একটি স্থানীয় স্কুলে অনেক বছর শিক্ষকতা করেছেন। তিনি তাঁর পরিবারকে নিয়েই দাদার সঙ্গে থাকতেন, এবং যখনই তিনি বেতন থেকে বেশ কিছু টাকা জমাতে পারলেন, তখনই মেহমানদের থাকার ঘরের পাশে ছোট একটা কংক্রিটের হুজরা তৈরি করলেন। তিনি পাহাড়ের পেছন থেকে জ্বালানি কাঠ আনতেন এবং স্কুলের কাজ শেষে মাঠে তাঁদের মহিষগুলো চরাতেন এবং তাদের যত্ন নিতেন। তিনি দাদাকে ছাদ থেকে তুষার সরানোর মতো ভারী কাজেও সাহায্য করতেন।

  বাবা যখন জেহানযেব কলেজ থেকে এ লেভেল (উচ্চ মাধ্যমিক) করার প্রস্তাব পেলেন (যেটা সোয়াতের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান), দাদা তাঁর থাকার খরচ দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। দিল্লিতে তাঁর নিজের পড়াশোনা ছিল খরচবিহীন, তিনি তালেব হিসেবে মসজিদে থেকেছেন এবং স্থানীয় লোকজনই ছাত্রদের খাবার আর কাপড় দিয়েছে। জেহানযেবে পড়ালেখা ছিল বিনামূল্যে কিন্তু বাবার তো থাকার খরচ লাগবে। পাকিস্তানে ‘স্টুডেন্ট লোন’-এর ব্যবস্থা নেই এবং বাবা কখনো ব্যাংকে পা রাখেননি। কলেজটি ছিল মিঙ্গোরার ‘যমজ শহর’ সাইদু শরিফে এবং সেখানে বাবার পরিচিত কেউ ছিল না। শাংলায় অন্য কোনো কলেজও ছিল না, এবং তিনি যদি কলেজে না পড়েন, তিনি কোনোদিন এই গ্রামের বাইরে যেতে পারবেন না এবং তাঁর স্বপ্নটাও বাস্তবায়ন করতে পারবেন না।

  বাবা হতবুদ্ধি ও হতাশ হয়ে পড়লেন। হতাশায় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়তেন। তাঁর প্রাণপ্রিয় মা তাঁর স্কুলজীবন শেষ করার ঠিক আগে দিয়ে মারা গেছেন। বাবা জানতেন তিনি বেঁচে থাকলে বাবার পক্ষেই থাকতেন। তিনি নিজের বাবাকে অনেক অনুরোধ জানালেন কিন্তু সবই বৃথা। তাঁর একমাত্র আশা-ভরসা ছিল করাচিতে, তাঁর শ্যালকের কাছে। আমার দাদা বাবাকে সেখানে কলেজে পড়ানোর জন্য নিয়ে যেতে চাইলেন। সেই শ্যালকের পরিবার শিগগিরই আমার দাদির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে গ্রামে আসছিলেন।

বাবা খুব চাইছিলেন তারা যেন রাজি হয়, কিন্তু তিনদিনের ক্লান্তিকর যাত্রা শেষে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই দাদা এই প্রস্তাব রাখলেন এবং বাবার শ্যালক রাজি হলেন না। দাদা এত রেগে গিয়েছিলেন যে তাঁরা যতদিন থেকেছেন তাঁদের সঙ্গে একটা কথাও বলেননি। বাবার মনে হলো তিনি একটি সুযোগ হারিয়েছেন এবং তাঁকেও তাঁর ভাইয়ের মতো স্কুলে পড়িয়েই জীবন কাটাতে হবে। চাচা যেখানে পড়াতেন সেটা ছিল সেউর পাহাড়ের গ্রামে, তাঁদের বাসা থেকে দেড় ঘণ্টার পাহাড়ে চড়া পথ। এর নিজের ভবনও ছিল না, মসজিদের বড় হলটিতে তারা পাঁচ থেকে ১৫ বছর বয়সী শতাধিক শিক্ষার্থীকে পড়াত।

সেউরে থাকত গুজার, কোহিস্তানি আর মিয়ানরা। আমরা মিয়ানদের জমিদার হিসেবেই জানি, কিন্তু গুজার আর কোহিস্তানিদের বলি পাহাড়ি মানুষ, তারা ছিল কৃষক এবং মহিষপালক। তাদের বাচ্চারা সাধারণত নোংরাই থাকত এবং পশতুনরা নিজেরা গরিব হলেও তাদের হেয় করত। মানুষ বলত, ‘তারা নোংরা, কালো এবং বোকা। তাদের অশিক্ষিতই থাকা উচিত।’ শোনা যেত যে শিক্ষকরা এত দুর্গম স্কুলে কর্তব্য পালন করতে পছন্দ করত না এবং সহকর্মীদের সঙ্গে এমনভাবে চুক্তি করত যাতে প্রতিদিন কেবল একজনকে উপস্থিত করতে হয়। স্কুলে দুজন শিক্ষক থাকলে একজন তিনদিন করে আসত এবং অপরজনকে উপস্থিত দেখিয়ে স্বাক্ষর করত। তিনজন শিক্ষক থাকলে প্রতিজনকে মাত্র দুজন করে আসতে হতো। তারা যা করত তা হলো কেবল একটা লম্বা লাঠি দিয়ে বাচ্চাদের চুপ রাখা, কারণ শিক্ষা যে এসব বাচ্চার কোনো উপকারে আসবে তা তারা কল্পনাই করতে পারত না।

আমার চাচা অনেক দায়িত্ববান ছিলেন। তিনি পাহাড়ি মানুষদের পছন্দ করতেন এবং তাদের কঠিন জীবনটাকে শ্রদ্ধা করতেন। তাই তিনি বেশির ভাগ দিনই স্কুলে যেতেন এবং সত্যিকার অর্থেই বাচ্চাদের শেখানোর চেষ্টা করতেন। স্কুল পাস করার পর বাবার করার কিছু না থাকায় তিনি চাচাকে তাঁর কাজে সাহায্য করতেন। আর সেখানেই তাঁর ভাগ্য খুলে গেল। আমার ফুপু ওই গ্রামের এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেছিলেন এবং নাসির পাচা নামের এক আত্মীয় তাঁদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন, বাবাকে তিনি কর্মক্ষেত্রে দেখেছেন। নাসির পাচা অনেক বছর সৌদি আরবে নির্মাণকাজ করেছিলেন এবং পরিবারকে টাকা পাঠাতেন। বাবা তাঁকে বললেন যে তিনি মাত্র স্কুল শেষ করে জেহানযেব কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। দাদা যে এর খরচ বহন করতে পারবেন না সেটা উল্লেখ করলেন না, কারণ তিনি নিজের বাবাকে বিব্রত করতে চাননি।

নাসির পাচা বললেন, ‘তুমি আমাদের সঙ্গে এসে থাকো না কেন?’

আমার বাবা এখন বলেন, ‘উফ, খোদার কসম, আমি এত খুশি হয়েছিলাম!’ পাচা এবং তাঁর স্ত্রী জাজাই বাবার দ্বিতীয় পরিবার হয়ে উঠল। তাঁদের বাড়ি ছিল ‘হোয়াইট প্যালেস’-এ যাওয়ার পথে একটি সুন্দর পাহাড়ি গ্রাম– স্পাল বান্দি। বাবার বর্ণনায় সেটা একটা রোমান্টিক ও উদ্দীপক স্থান। তিনি বাসে করে সেখানে গিয়েছিলেন এবং জায়গাটা তাঁর কাছে এতই বড় মনে হয়েছিল যে, নিজের বাড়ি, ওই স্থানের তুলনা তিনি গ্রাম ও শহরের তুলনার মতো ভেবেছিলেন। মেহমান হিসেবে বাবাকে আলাদা আপ্যায়ন দেওয়া হয়েছিল। জাজাই বাবার মৃত মায়ের শূন্যস্থান পূরণ করেছিলেন এবং বাবার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নারীরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। একজন গ্রামবাসী জাজাইয়ের কাছে অভিযোগ করল যে, বাবা অন্য এলাকার একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করার চেষ্টা করছে, জাজাই রুখে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, ‘জিয়াউদ্দিন হলো ডিমের মতো পরিচ্ছন্ন, তার মাথায় চুলই নেই, সে প্রেম করবে? তুমি তোমার মেয়েকে সামলাও!’

  স্পাল বান্দিতে বাবা এমন সব নারীর সংস্পর্শে এলেন, যাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং তাঁর গ্রামের নারীদের মতো নিজেদের আড়াল করে রাখতেন না। সেই মহিলাদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে কথা বলার জন্য মিলিত হওয়ার একটি সুন্দর জায়গা ছিল, পাহাড়ের ওপরে। বাড়ির বাইরে নারীদের দেখা করার আলাদা স্থান থাকাটা অস্বাভাবিকই বটে। স্পাল বান্দিতে বাবা তাঁর বিজ্ঞ পরামর্শদাতা আকবর খানের সঙ্গে পরিচিত হন, যিনি নিজে কলেজ পড়েননি কিন্তু বাবার পড়ার জন্য ঋণ দিয়েছেন। আমার মায়ের মতোই, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তাঁর একধরনের জ্ঞান ছিল। কাউকে বিপদে সাহায্য করলে পরবর্তী সময়ে নিজের বিপদে অপ্রত্যাশিত সাহায্য পাওয়া যায় – এটা বোঝাতে বাবা নাসির পাচা এবং আকবর খানের দয়ার কথা উল্লেখ করে থাকেন।

  পাকিস্তানের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সময়েই বাবা কলেজে পা রাখলেন। সময়টা তারুণ্যের, পাহাড়-পর্বত চষে বেড়ানোর। সেই গ্রীষ্মে আমাদের স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়া এল রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান; যেটা বেশির ভাগ মানুষের মতে একটি আমের ঝুড়িতে লুকানো বোমার আঘাতে ঘটেছিল। বাবার কলেজের প্রথম সাময়িকীতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, এবং সেটায় বেনজির ভুট্টো জয়লাভ করলেন। বাবা ছোট থাকতেই বেনজিরের বাবাকে হত্যা করা হয়েছিল। হঠাৎই ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু সুন্দর সম্ভাবনার সুবাতাসের দোলায় সবাই উদ্বেলিত হয়ে উঠল।

জিয়ার শাসনামলে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রসংঠনগুলো এবার বেশ সরব হয়ে উঠল। বাবা দ্রুত ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন এবং বিতার্কিক ও সুবক্তা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠলেন। তিনি পখতুন ছাত্রসংঘ (পিএসএফ)–এর সচিব নির্বাচিত হলেন। এ সংগঠনটি পশতুনদের সমান অধিকারের দাবি জানাচ্ছিল। সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র এবং সরকারের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ ছিল পাঞ্জাবিদের দখলে, কারণ তারাই ছিল সবচেয়ে বড় এবং ক্ষমতাবান প্রদেশ।

  আরেকটি প্রধান ছাত্রসংগঠন ছিল ইসলামী জামায়াত-ই-তালাবা, ধর্মসংগঠন জামায়াত-ই-ইসলামীর ছাত্রসংঘ এবং তাঁরা পাকিস্তানের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রভাব বিস্তার করত। তারা ছাত্রদের বিনামূল্যে বই এবং বৃত্তি প্রদান করত কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল চরমপন্থী এবং অবসরে তাদের প্রিয় কাজ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় টহল দেওয়া আর সংগীতানুষ্ঠান পণ্ড করে দেওয়া। এই সংগঠন জেনারেল জিয়ার সাথে অন্তরঙ্গ ছিল এবং নির্বাচনে খুব খারাপভাবে হারত। জেহানযেব কলেজে এই দলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইহসান-উল-হক হাক্কানী। যদিও তাঁর এবং আমার বাবার মাঝে দ্বন্দ্ব ছিল তথাপি তাঁরা একে অপরের প্রশংসা করতেন এবং পরবর্তীকালে বন্ধু হয়ে গেলেন। হাক্কানী বলেন, বাবা যদি কোনো ধনী পরিবারের সদস্য হতেন তাহলে তিনি নিশ্চিতভাবেই পিএসএফের প্রেসিডেন্ট হতেন এবং পরে একজন রাজনীতিবিদ হয়ে যেতেন। ছাত্ররাজনীতি ছিল কেবল বিতর্ক ও কৌশলের ব্যাপার, কিন্তু দলীয় রাজনীতির মূল উপাদান অর্থ।

তাদের অন্যতম বিতর্ক ছিল সেই প্রথম বছর একটা উপন্যাস নিয়ে। বইটার নাম ছিল ‘স্যাটানিক ভার্সেস’, এর লেখক সালমান রুশদী। নবীজির জীবন বোম্বেতে হলে কেমন হতো, তার একটি ব্যঙ্গাত্মক চিত্র এ বই। মুসলিমরা একে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী হিসেবে ধরে নিল এবং এটা এত বেশি সন্ত্রাসের কারণ হয়ে উঠল যে মনে হতে লাগল এটা ছাড়া মানুষের কথা বলার আর তেমন কিছুই নেই। বিশ্রী ব্যাপারটা ছিল যে কেউ খেয়ালই করেনি বইটা পাকিস্তানে বিক্রির জন্য নয় বলে প্রকাশকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, কিন্তু উর্দু পত্রিকাগুলোয় আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠ এক মোল্লার লেখা প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকল। সেখানে বলা হলো বইটি নবীজির পক্ষে অপমানজনক এবং ভালো মুসলিম হিসেবে এর প্রতিবাদ আমাদের করা উচিত। দ্রুতই পাকিস্তানের মোল্লারা বইটিকে অভিযুক্ত করে সেই বই নিষিদ্ধ করার দাবি জানাল এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে লাগল। সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনাটা ঘটল ইসলামাবাদে ১৯৮৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারিতে, যেখানে আমেরিকান সেন্টারের সামনে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা পোড়ানো হলো – যদিও রুশদী ও তাঁর প্রকাশক ব্রিটিশ। পুলিশ সেই সমাবেশে গুলিবর্ষণ করে পাঁচজনকে হত্যা করে। ক্ষোভটা শুধু পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। দুদিন পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াত উল্লাহ খোমেনি রুশদীর গুপ্তহত্যার জন্য ফতোয়া জারি করলেন।

বাবার কলেজে একটি লোকভর্তি কক্ষে এ বিষয়ে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হলো। অনেক ছাত্র বইটি নিষিদ্ধ করে পুড়িয়ে ফেলার ফতোয়াটি সমর্থন করল। বাবাও বইটিকে ইসলামের প্রতি আক্রমণ হিসেবেই দেখলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন বাকস্বাধীনতায় দৃঢ়বিশ্বাসী। ‘প্রথমে আমাদের উচিত বইটা পড়া এবং নিজেরা এর বিরুদ্ধে আরেকটি বই লিখে প্রতিবাদ করা,’ বাবা পরামর্শ দিলেন। বাবা আলোচনার ইতি টানলেন বজ্রকণ্ঠের এক প্রশ্নের মাধ্যমে – যে কণ্ঠ শুনলে দাদা গর্বিত হতেন – ‘ইসলাম কি এতই দুর্বল ধর্ম যে তার বিরুদ্ধে লেখা একটি বইও সে সহ্য করতে পারবে না? এটা তো আমার ইসলাম নয়!’

জেহানযেব থেকে পাস করার প্রথম কয়েক বছর বাবা একটি সুপরিচিত বেসরকারি কলেজে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু বেতন ছিল খুবই কম – মাসে মাত্র ১৬০০ রুপি, প্রায় ১২ পাউন্ডের কাছাকাছি, এবং দাদা বলতে লাগলেন যে বাবা সংসারের খরচ দিতে অবদান রাখছেন না। বাবার প্রেমাস্পদ তর পেকাইকে বিয়ে করতে যতটুকু অর্থ প্রয়োজন, এই বেতনে তাও জমানো সম্ভব ছিল না।

  স্কুলে বাবার একজন সহকর্মী ছিলেন তাঁর বন্ধু মোহাম্মদ নাঈম খান। তাঁরা একসঙ্গে ইংরেজিতে ব্যাচেলর ও মাস্টার্স পড়েছেন, দুজনই শিক্ষার ব্যাপারে বেশ আবেগপ্রবণ ছিলেন। স্কুলটি খুব কড়া এবং রসকষহীন বলে দুজনই হতাশ ছিলেন। শিক্ষক বা ছাত্র কারোই কোনোকিছু নিয়ে মতামত দেওয়ার অধিকার ছিল না, এবং মালিকের নিয়ন্ত্রণ এতই শক্ত ছিল যে শিক্ষকদের মাঝে বন্ধুত্বও তারা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইত। নিজের একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করার মতো স্বাধীনতার জন্য বাবার মন টানত। বাবা মুক্তচিন্তাকে উৎসাহিত করতে চাইতেন এবং স্কুলে যেভাবে মুক্তবুদ্ধি, সৃজনশীলতার চেয়ে আনুগত্যকে প্রশংসিত করা হয়, সেটাকে ঘৃণা করতেন। তাই প্রশাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে নাঈম যখন চাকরি হারালেন, তাঁরা নিজেরা একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

 মূল পরিকল্পনা ছিল আমার বাবার গ্রাম শাহপুরে স্কুলটি তৈরি করা, যেখানে স্কুলটি ‘কোনো দোকানবিহীন এলাকায় একটি দোকানের মতোই’ প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু যখন তাঁরা সেখানে স্কুলের জন্য ভবন খুঁজতে গেলেন, তখন চারদিকে একটি নতুন স্কুল খোলার বিজ্ঞাপনের ব্যানার দেখতে পেলেন – কেউ একজন তাঁদের আগেই স্কুল প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। ফলে তাঁরা মিঙ্গোরায় একটি ইংরেজি শেখার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নিলেন, কারণ তাঁরা ভেবেছিলেন যেহেতু সোয়াত পর্যটন স্থান সেহেতু ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপক চাহিদা থাকবে।

যেহেতু বাবা তখনো শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত, নাঈম একাই তখন আরেকটা ভবন খোঁজার জন্য রাস্তা চষে বেড়াচ্ছিলেন। একদিন তিনি উত্তেজিত হয়ে বাবাকে ডেকে বললেন যে তিনি আদর্শ স্থান খুঁজে পেয়েছেন। লান্দিকাস নামে এক সুপরিচিত এলাকায় তিনি দোতলা ভবনের নিচতলাটা ভাড়া পেয়েছেন, সেখানে ছাত্রদের একত্র হওয়ার মতো দেয়ালঘেরা উঠান আছে। পূর্ববর্তী ভাড়াটিয়ারাও ‘রামাদা স্কুল’ নামে একটি স্কুল চালাত। মালিক স্কুলের নাম রামাদা রেখেছিলেন কারণ তিনি তুরস্কে ‘রামাদা হোটেল’ দেখেছিলেন! কিন্তু স্কুলটি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল, যার জন্য তাঁদের স্কুল স্থাপনের আগে দুবার চিন্তা করা উচিত ছিল। তার ওপর স্কুলটির পাশে এক নদীর পাড়ে সবাই ময়লা ফেলত এবং গরম আবহাওয়ায় তা বেশ দুর্গন্ধ ছড়াত।

দিনের কাজ শেষ করে বাবা ভবনটি দেখতে গেলেন। সেটা ছিল তারাভরা আকাশ এবং গাছের মাথায় পূর্ণিমার চাঁদ ঝুলে থাকার এক অসাধারণ রাত। বাবা এটাকে একটা ইঙ্গিত বলে ধরে নিলেন। ‘আমার খুব খুশি লাগছিল,’ বাবা স্মৃতিচারণা করেন। ‘আমার স্বপ্ন সত্য হতে চলেছিল।’

নাঈম এবং বাবা তাঁদের সমস্ত সঞ্চয় ৬০ হাজার রুপিই বিনিয়োগ করলেন এবং ঘরগুলো রং করানোর জন্য আরো ৩০ হাজার রুপি ধার করলেন। তাঁরা রাস্তার অন্যপাশে নিজেদের থাকার জন্য একটি চালাঘর ভাড়া করলেন এবং দ্বারে দ্বারে ঘুরে ছাত্র সংগ্রহ করতে লাগলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইংরেজি শিক্ষার চাহিদা খুবই কম ছিল, এবং তাঁদের উপার্জনে অচিন্ত্যনীয় ধস নামল। কলেজের দৈনন্দিন কাজ সেরে বাবা রাজনৈতিক আলোচনায় যোগ দিতে থাকলেন। প্রতিদিনই তাঁর সহযোগীরা ঘরে অথবা স্কুলে দুপুরে খেতে আসত। নাঈম অভিযোগ করত, ‘এত মেহমানদারির খরচ আমরা বহন করতে পারব না!’ এটাও ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল যে খুব ভালো বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও ব্যবসায়ে অংশীদার হিসেবে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

তার ওপর শাংলা থেকে দলে দলে অতিথি আসতে শুরু করল এবং বাবা তাদেরও থাকার জায়গা দিতে লাগলেন। যত অসুবিধাই হোক আমরা পশতুনরা আত্মীয় বা বন্ধুদের ফিরিয়ে দিতে পারি না। আমরা গোপনীয়তাকে সম্মান করি না এবং কারো কাছে আসার আগে থেকে সময় ঠিক করে রাখার মতো কোনো প্রথা অনুসরণ করি না। অতিথি যেকোনো সময় আসতে পারে এবং যতদিন খুশি থাকতে পারে। মাত্র ব্যবসা শুরু করা মানুষের পক্ষে তখন সময়টা দুঃস্বপ্নের মতো এবং নাঈমের মনোযোগ নষ্ট হয়ে গেল। তিনি ঠাট্টা করে বাবাকে বললেন, কারো পরিবারের সদস্য থাকতে চাইলে তাকে অপরজনের কাছে জরিমানা দিতে হবে। বাবা তখন নাঈমের আত্মীয় এবং বন্ধুদেরকে থাকার জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করতে থাকলেন যেতে নাঈমকেও জরিমানা দিতে হয়!

তিন মাস পর নাঈমের মনে হলো, যথেষ্ট হয়েছে। ‘কথা ছিল আমরা ছাত্র পড়িয়ে অর্থ সংগ্রহ করব। কিন্তু এখন আমাদের দরজায় টোকা দিচ্ছে কেবল ভিক্ষুক! এটা অনেক কষ্টকর কাজ!’ তিনি বললেন। ‘আমি আর পারছি না।’

 অসময় দুই সাবেক বন্ধু একে অপরের সঙ্গে কথাই বলতেন না এবং শেষে মধ্যস্থতার জন্য এলাকার মুরব্বিদের ডাকতে হলো। বাবা স্কুলটি বন্ধ না করার জন্য মরিয়া ছিলেন, তাই তিনি নাঈমের বিনিয়োগের একটি অংশ তাঁকে ফিরিয়ে দিতে রাজি হলেন – যদিও কীভাবে দেবেন সে বিষয়ে তাঁর কোনো ধারণাই ছিল না। ভাগ্যক্রমে কলেজজীবনের পুরোনো বন্ধু হিদায়েতুল্লাহ এগিয়ে এসে নাঈমের স্থান পূরণ করতে রাজি হলেন। নতুন সহযোগীরা আবার দ্বারে দ্বারে ঘুরে বলতে লাগলেন তাঁরা একটি নতুন ধরনের স্কুল খুলেছেন। হিদায়েতুল্লাহর ভাষায়, বাবা এতই বন্ধুবৎসল ছিলেন যে কারো বাসায় দাওয়াত পেলে তিনি আপ্যায়নকারীর বন্ধুদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলবেন। কিন্তু মানুষ বাবার আগে কথা বলতে পছন্দ করলেও নিজেদের বাচ্চাদের প্রতিষ্ঠিত স্কুলেই পাঠাত।

আমার বাবার চোখে মহাপুরুষ, সোয়াতের দক্ষিণে আকোরা হতে আগত যোদ্ধা কবি খুশাল খান খাত্তাকের নামে স্কুলের নাম রাখা হলো খুশাল স্কুল। সেই কবি পশতুন গোত্রকে ১৭ শতকে মোগলদের বিরুদ্ধে এক করতে চেয়েছিলেন। প্রবেশপথে বাবারা একটি মূলমন্ত্র লাগিয়াছিলেন – “নতুন যুগ নির্মাণে আপনাদের কাছে আমরা বদ্ধপরিকর।” বাবা পশতু ভাষায় খাত্তাকের লেখা একটি বিখ্যাত বাণী দিয়ে একটি ঢাল প্রস্তুত করলেন, যাতে লেখা ছিল, ‘আফগান মর্যাদার শপথে আমি আমার তলোয়ার প্রস্তুত করছি।’ বাবা চাইতেন আমরা যেন এই বীরের আদর্শে অনুপ্রাণিত হই, কিন্তু আমাদের যুগের উপযোগী জিনিস দিয়ে – তলোয়ার নয়, কলম। বিদেশি শত্রুর বিপক্ষে খাত্তাক যেমন পশতুনদের এক করতে চেয়েছেন, তেমনি আমাদেরও অশিক্ষার বিরুদ্ধে এক হতে হবে।

  দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানুষ তেমন একটা বিশ্বাস করল না। স্কুলটি শুরু হলো মাত্র তিনজন শিক্ষার্থী নিয়ে। তবুও বাবা জাতীয় সংগীত গাওয়ার মাধ্যমে দিন শুরু করার ওপর জোর দিতেন। তখন বাবাকে সাহায্য করতে আসা ভাগ্নে আজিজ সেখানে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করল।

  এত অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী হওয়ায় তাঁদের হাতে স্কুলটি প্রস্তুত করার মতো অর্থই থাকল না এবং শিগগিরই ঋণ ফেরত দিতে পারার কোনো আশাই দেখলেন না। কেউই পরিবার থেকে অর্থ পাচ্ছিলেন না এবং বাবাও তখন কলেজের অনেক লোকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারেননি বিধায় অর্থ ফেরত দেওয়ার তাগাদা সংবলিত চিঠি আসছে দেখে হিদায়েতুল্লাহ অসন্তুষ্ট হলেন।

বাবা যখন স্কুলের নিবন্ধন করাতে গেলেন, তখন বোঝা গেল ভাগ্যে আরো কত খারাপ কিছু জমা আছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে বাবা স্কুলসমূহের তত্ত্বাবধায়কের অফিসে ঢোকার অনুমতি পেলেন। তত্ত্বাবধায়ক ফাইলের বিশাল স্তূপ সামনে রেখে, চা-পানরত খয়ের-খাঁ দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় বসে ছিলেন। ‘এটা কী ধরনের স্কুল?’ অফিসারটি বাবার আবেদন শুনে হাসতে হাসতে বললেন। ‘কয়জন শিক্ষক আছে? তিনজন! শিক্ষকরা প্রশিক্ষিত না। এ রকম স্কুল সবাই খুলতে পারে!’

  সবাই লোকটির সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে বিদ্রূপ করে হাসতে লাগল। বাবা রেগে গেলেন। স্পষ্ট হয়ে গেল, তত্ত্বাবধায়ক অর্থ চাইছিলেন। পশতুনদের কেউ ছোট করলে তারা সেটা মেনে নেয় না, এবং স্বাভাবিক অধিকার অর্জনে বাধা পেলে তা ঘুষের মাধ্যমে আদায় করে না। ঘুষ দূরের কথা, বাবা এবং হিদায়েতুল্লাহ খাবারের খরচ জোগাতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন। নিবন্ধনের সাধারণ খরচ ছিল ১৩ হাজার রুপি এবং অফিসের লোকজন নিবন্ধনকারীকে ধনী মনে করলে আরো বেশি আদায় করতে পারে। তা ছাড়া আমলারা আশা করে, স্কুলগুলো নিয়মিত মুরগির মাংস বা নদীর টাকি মাছ দিয়ে তাদের মধ্যাহ্নভোজের দাওয়াত খাওয়াবে। শিক্ষা অফিসারই খাবারের পরিপূর্ণ তালিকা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য পরিদর্শন করার নাম করে স্কুলে আসতেন। বাবা ক্ষুব্ধ হয়ে বলতেন, ‘এটা খামার নয়, এটা একটা স্কুল।’

তাই যখন অফিসারটি ঘুষের জন্য ইশারা করলেন, বাবা তাঁর এত বছরের বিতর্কের দক্ষতা পুঁজি করে মাঠে নামলেন। ‘এসব প্রশ্ন আপনি কেন জিজ্ঞেস করছেন?’ বাবা দাবি করলেন। ‘আমি কি অফিসে নাকি পুলিশ স্টেশনে নাকি আদালতে আছি? আমি কি আসামি?’ তিনি অন্য স্কুলমালিকদের হয়রানি ও দুর্নীতির হাত থেকে রক্ষা করতে এই আমলাদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি জানতেন এটা করতে তাঁর নিজস্ব কিছু ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন, তাই তিনি ‘সোয়াত অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট স্কুলস’-এ যোগ দিলেন। তখন এতে মাত্র ১৫ জন সদস্য ছিল এবং বাবা দ্রুতই সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন।

অন্য অধ্যক্ষরা ঘুষ নেওয়াটাকে অবধারিতই মনে করতেন, কিন্তু বাবা যুক্তিতর্কের মাধ্যমে উপস্থাপন করলেন যে স্কুলগুলো এক হলে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব ‘স্কুল চালানো তো অপরাধ নয়,’ বাবা বললেন, ‘কেন ঘুষ দিতে হবে? আপনারা তো পতিতালয় চালাচ্ছেন না, বাচ্চাদের শিক্ষাদান করছেন!’ তিনি মনে করিয়ে দিলেন, ‘সরকারি কর্মচারীরা আপনাদের মালিক নয়, সেবক। তারা আমাদের সেবা করার জন্য বেতন নিচ্ছে। আমরা তাদের সন্তানদেরই শিক্ষার আলোয় আলোকিত করছি।’

বাবা দ্রুতই সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন এবং এর প্রসারণ ঘটিয়ে মোট ৪০০জন সদস্যে রূপান্তর করলেন। হঠাৎই স্কুলমালিকদের হাতে ক্ষমতা এসে গেল। কিন্তু বাবা আসলে ব্যবসায়ী মনোভাবের চেয়ে বেশি ভাববিলাসী ছিলেন, এবং এমন নিদারুণ বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন যে তিনি এবং হিদায়েতুল্লাহ স্থানীয় দোকানির কাছ থেকেও বাকিতে কিছু কিনতে পারছিলেন না এবং চা-চিনি কেনার অর্থও ছিল না। আয় বাড়াতে তাঁরা স্কুলে একটি খাবারের দোকান চালানো শুরু করলেন। সকালে তাঁরা বেরিয়ে নাশতা কিনে আনতেন এবং বাচ্চাদের কাছে বিক্রি করতেন। বাবা ভুট্টা কিনে এনে রাত জেগে থলেতে খই ভরতেন।

  ‘আমি খুব বিমর্ষ হয়ে যেতাম এবং চারপাশের সমস্যাগুলো দেখে ভেঙে পড়তাম,’ হিদায়েতুল্লাহ বলেন। ‘কিন্তু জিয়াউদ্দিন কোনো সংকটে পড়লে শক্ত থাকত এবং প্রাণবন্ত থাকত।’

বাবা বড় কোনো লক্ষ্য নিয়ে চিন্তা করার প্রতি জোর দিতেন। একদিন হিদায়েতুল্লাহ ছাত্রদের থেকে বেতন নিয়ে ফিরে এসে দেখেন, বাবা অফিসে বসে পাকিস্তান টেলিভিশনের স্থানীয় প্রধানের সঙ্গে স্কুলের বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথা বলছেন। লোকটা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হিদায়েতুল্লাহ হাসিতে ফেটে পড়লেন। ‘জিয়াউদ্দিন, আমাদের কোনো টিভিও নেই। বিজ্ঞাপন দিলেও সেটা আমরা দেখতে পাব না।’ কিন্তু বাবা সব সময় আশাবাদী থাকতেন এবং প্রায়োগিক সমস্যা দ্বারা কখনোই নিরুৎসাহিত হতেন না।

 একদিন বাবা হিদায়েতুল্লাহকে বললেন যে তিনি কয়েকদিনের জন্য গ্রামে যাচ্ছেন। আসলে তিনি বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কাউকে আপ্যায়ন করার সামর্থ্য না থাকায় তিনি মিঙ্গোরার কোনো বন্ধুকে সত্যটা বলেননি। আমাদের বিয়েগুলোতে কয়েকদিনের ভোজপর্ব চলে। সত্যিকার অর্থে আমার মায়ের ভাষ্য অনুযায়ী, বাবা নিজে বিয়ের মূল অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি কেবল শেষ দিনে উপস্থিত হয়েছিলেন, যেদিন মুরব্বিরা তাঁদের দুজনের মাথার ওপর একটি চাদর আর কোরআন শরিফ ধরে রাখেন এবং একে অপরের দিকে তাকানোর জন্য একটি আয়না দেন। বেশির ভাগ পারিবারিক বিয়েতে বর-কনের দেখা হয় এভাবে। এরপর ছেলেসন্তানের জন্ম দেওয়াকে উৎসাহিত করতে তাদের কোলে একটি ছোট ছেলেকে বসানো হয়।

  আমাদের সংস্কৃতি অনুযায়ী, কনে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে আসবাবপত্র বা ফ্রিজ এবং বরপক্ষ থেকে কিছু স্বর্ণ পাবে। দাদার কাছে স্বর্ণ কেনার মতো যথেষ্ট অর্থ না থাকায় চুড়ি কেনার জন্য বাবাকে আরো ধার করতে হলো। বিয়ের পর মা আমার দাদা ও চাচার সঙ্গে থাকতে লাগলেন; বাবা দু-তিন সপ্তাহ পরপর মাকে দেখে যেতে লাগলেন। পরিকল্পনা ছিল, স্কুলটা দাঁড়িয়ে গেলে মাকে তিনি শহরে নিয়ে আসবেন। কিন্তু দাদা তাঁর আয় কমে যাওয়ার ব্যাপারে অভিযোগ করতে লাগলেন এবং আমার মায়ের জীবন অতিষ্ঠ করে তুললেন। মায়ের নিজের খুব কম টাকা ছিল এবং সেটা তাঁরা ভ্যান ভাড়া করতেই খরচ করে ফেললেন। মা মিঙ্গোরায় চলে এলেন। কীভাবে খরচ পোষাবে সে বিষয়ে কারোই ধারণা ছিল না। ‘আমরা শুধু জানতাম, বাবা চাইছেন না আমরা গ্রামে থাকি,’ বাবা বলেছিলেন, ‘সে সময় আমি আমার পরিবারকে নিয়ে অখুশি ছিলাম, কিন্তু পরে কৃতজ্ঞতা বোধ করেছি। কারণ এই সংগ্রামের জন্যই আমি স্বনির্ভর হতে পেরেছি।’

  তিনি তাঁর সহযোগীদের কিছুই জানাননি। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি মিঙ্গোরায় এলে হিদায়েতুল্লাহ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ‘আমাদের তো এখন একটা পরিবারের খরচ জোগানোর সামর্থ্য নেই,’ তিনি বাবাকে বললেন। ‘সে কোথায় থাকবে?’

 বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে, সমস্যা নেই। সে আমাদের জন্য রান্না আর ধোয়ামোছা করবে।’

 মা মিঙ্গোরায় থাকার ব্যাপারে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তাঁর জন্য এটি একটি আধুনিক শহর। তিনি তাঁর বান্ধবীদের সঙ্গে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলার সময় শুনতেন, বেশির ভাগই বিয়ে করে সন্তানের মা হতে চায়। মায়ের পালা এলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি শহরে থাকতে চাই এবং নিজে রান্না করার চেয়ে বরং নান-কাবাবের ফরমাশ দিতে চাই।’ তবু তাঁর প্রত্যাশা অনুযায়ী সব ঘটল না। কুঁড়েঘরটায় কেবল দুটো ঘর ছিল, এক রুমে বাবা এবং হিদায়েতুল্লাহ ঘুমাতেন আর অন্য ঘর ছিল ছোট একটা অফিস। কোনো রান্নাঘর বা পানির ট্যাপ ছিল না। মা আসার পর হিদায়েতুল্লাহ বাধ্য হয়ে অফিসে একটি শক্ত কাঠের চেয়ারে ঘুমাতে শুরু করলেন।

  বাবা সবকিছুতেই মায়ের পরামর্শ নিতেন। ‘আমাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য কর, পেকাই,’ বাবা বলতেন। মা এমনকি স্কুলের দেয়ালে চুনকাম করতেও সাহায্য করতেন। বিদ্যুৎ চলে গেলেও যাতে তাঁরা কাজ করতে পারেন, সেজন্য মা উঁচু করে কুপি ধরে রাখতেন।

  হিদায়েতুল্লাহ বলতেন, ‘জিয়াউদ্দিন ছিল সংসারাসক্ত মানুষ, এবং তারা অস্বাভাবিক রকমের ঘনিষ্ঠ ছিল। যেখানে আমরা আমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে থাকতেই পারতাম না, সেখানে সে তার স্ত্রীকে ছাড়া থাকতে পারত না।’

  কয়েক মাসের মধ্যেই মা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লেন। ১৯৯৫ সালে তাঁদের প্রথম সন্তান, একটি মেয়ে মৃত অবস্থায় জন্ম নিল। বাবা বলেন, ‘জায়গাটা কাদাযুক্ত ছিল আর সম্ভবত অস্বাস্থ্যকর ছিল। আমি ভেবেছিলাম মহিলারা হাসপাতালে না গিয়েই সন্তানের জন্ম দিতে পারে, যেমনটা আমার মা আর বোনরা করেছিলেন। আমার মা এভাবে দশজন সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।’

  স্কুলের লোকসান হতেই থাকল। মাসের পর মাস শিক্ষকদের বেতন এবং বাড়িভাড়া বকেয়া হতে থাকল। স্বর্ণকার এসে এসে মায়ের বিয়ের চুড়ির দাম চাইতে থাকল। বাবা তাকে খুশি করার জন্য ভালো চা বানিয়ে বিস্কুটের সঙ্গে পরিবেশন করতেন। হিদায়েতুল্লাহ হাসতেন। ‘তোমার কি মনে হয় সে চা খেয়েই সন্তুষ্ট হবে? সে তার টাকা চায়।’

  অবস্থা এতই মারাত্মক হয়ে পড়ল যে বাবা চুড়িগুলো বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলেন। আমাদের সংস্কৃতিতে বিয়ের অলংকার হলো দম্পতির মধ্যকার বন্ধন। প্রায়ই নারীরা স্বামীর ব্যবসায়ের জন্য বা বিদেশে যাওয়ার অর্থ জোগাড়ের জন্য গহনা বিক্রি করে থাকে। মা এরই মধ্যে বাবার ভাগ্নের কলেজে যাওয়ার খরচ জোগাড়ের জন্য চুড়িগুলো বিক্রি করতে চেয়েছিলেন, কারণ বাবা এটা করবেন বলে ভাগ্নের কাছে ওয়াদা করেছিলেন আগেপিছে না ভেবেই – সৌভাগ্যবশত, বাবার জ্ঞাতিভাই জেহান শের খান এগিয়ে এলেন – এবং তিনি বুঝতে পারেননি চুড়িগুলোর দাম আংশিক পরিশোধ করা হয়েছে। বাবা ওগুলো বিক্রি করে ভালো দাম পাননি জেনে তিনি খুব ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন।

 যখন মনে হতে লাগল এর চেয়ে খারাপ অবস্থা আর হতে পারে না, তখন এলাকায় বন্যা দেখা দিল। একদিন অবিরাম বৃষ্টি হতে লাগল এবং বিকেলে বন্যার সতর্কসংকেত এলো। সবাইকে জেলা ছেড়ে চলে যেতে হবে। মা বাইরে ছিলেন এবং দ্রুতবেগে বাড়তে থাকা পানি থেকে নিরাপদ করে সবকিছু দোতলায় ওঠাতে হিদায়েতুল্লাহর প্রয়োজন ছিল বাবার সাহায্য, কিন্তু তিনি বাবাকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ‘জিয়াউদ্দিন, জিয়াউদ্দিন!’ চিৎকার করতে করতে তিনি বাইরে গেলেন। সেই খোঁজার চরম মূল্যটা তিনি প্রায় দিতে বসেছিলেন। স্কুলের বাইরে সরু রাস্তাটা প্রায় ডুবে গিয়েছিল এবং দ্রুতই তাঁর ঘাড় পর্যন্ত পানি উঠে গেল। বৈদ্যুতিক ক্যাবল ঝুলে ঝুলে বাতাসে দোল খাচ্ছিল। ভয়ে কাঠ হয়ে তিনি দেখতে লাগলেন, তারগুলো প্রায় পানি ছুঁয়ে ফেলছে। যদি তাই হতো, তিনি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হতেন।

শেষমেশ তিনি যখন বাবাকে খুঁজে পেলেন, তিনি জানতে পারলেন যে এক মহিলার স্বামী বাড়ির ভেতর আটকা পড়ায় মহিলা কাঁদছিলেন, আর কান্না শুনে বাবা লোকটিকে বাঁচিয়েছেন। এরপর তিনি তাঁদের ফ্রিজটা রক্ষা করতে সাহায্য করেন। হিদায়েতুল্লাহ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘তুমি নিজের ঘরটাকে রক্ষা করতে পারোনি কিন্তু ওই মইলার স্বামীকে বাঁচিয়েছ! মেয়েমানুষের কান্না বলেই কি সাড়া দিয়েছিলে?’

পানি সরে যাওয়ার পর তাঁরা ধ্বংসস্তূপ থাকে তাঁদের স্কুল আর বাসা খুঁজে পেয়েছিলেন – আসবাবপত্র, মাদুর, বই, জামাকাপড়, অডিও সিস্টেম সব বিশ্রী গন্ধযুক্ত কাঁদায় পিণ্ডীভূত হয়েছে। পাল্টানোর মনো কোনো কাপড়, শোবার মতো কোনো জায়গা ছিল না। সৌভাগ্যবশত আমাম-উদ-দীন সাহেব নামের এক প্রতিবেশী তাঁদের রাতে থাকার জন্য আশ্রয় দিলেন। বর্জ্য পরিষ্কার করতে তাঁদের পুরো একটি সপ্তাহ সময় লাগল। দশদিন পর তাঁরা দুজনই বাইরে থাকা অবস্থায় দ্বিতীয়বার বন্যা হলো এবং ভবনটা আবারও কাদায় ভরে গেল। অল্প কদিন পরই তাঁরা পানি ও শক্তি কোম্পানি ‘ওয়াপদা’র এক কর্মকর্তার মুখোমুখি হলেন, যে দাবি করল যে মিটার নষ্ট হয়ে গেছে এবং বাবার কাছে ঘুষ চাইল। বাবা রাজি না হওয়ায় বিরাট অঙ্কের জরিমানাসহ বিল এসে গেল। এটা পরিশোধ করার কোনোই উপায় ছিল না বলে বাবা তাঁর এক রাজনৈতিক বন্ধুকে প্রভাব খাটাতে অনুরোধ করলেন।

  মনে হতে লাগল স্কুলটা প্রতিষ্ঠা করা কোনোদিনই সম্ভব না, কিন্তু বাবা এত সহজে স্বপ্ন বিসর্জন দিতে রাজি ছিলেন না। তা ছাড়া তাঁকে তাঁর পরিবারের খোরাকও জোগাতে হতো। ১৯৯৭ সালের ১২ জুলাই আমার জন্ম। দাইয়ের কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক প্রতিবেশী মাকে সাহায্য করেছিলেন। বাবা স্কুলে বসে সন্তানের জন্মের খবর শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন এবং খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গেলেন। কন্যাসন্তানের জন্মের খবর বাবাকে দিতে গিয়ে মা খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন, কিন্তু বাবা বলেন, আমার চোখের দিকে তাকিয়েই তিনি খুশি হয়ে গিয়েছিলেন।

 ‘মালালা ছিল ভাগ্যের বরপুত্র,’ হিদায়েতুল্লাহ বলেন। ‘ওর জন্মের পরই আমাদের ভাগ্য বদলে যায়।’

  তবে সঙ্গে সঙ্গেই নয়। ১৯৯৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সারা দেশে প্যারেড এবং স্মৃতিরক্ষা অনুষ্ঠান হয়। তথাপি আমার বাবা ও তাঁর বন্ধুরা বলেন যে পাকিস্তানের অংশ হওয়ার পর থেকেই সোয়াত ভোগান্তিতে আছে বলে আমাদের উদযাপন করার কিছু ছিল না। উদযাপন অর্থহীন বলে দাবি করে কালো বাহুবন্ধনী পরে প্রতিবাদ করায় তাঁদের গ্রেফতার করা হলো। সামর্থ্যের বাইরের অঙ্কের জরিমানা দিতে হলো তাঁদের।

 আমার জন্মের কয়েক মাস পরেই স্কুলের ওপরতলার তিনটা কক্ষ খালি হয়ে গেল এবং আমরা সেখানে উঠলাম। সেখানে কংক্রিটের দেয়াল এবং ট্যাপের পানি থাকায় আমাদের কর্দমাক্ত কুঁড়েঘরের তুলনায় কিছুতা উন্নতি হলো, কিন্তু তবুও জায়গাটা সংকীর্ণ মনে হতো– কারণ ঘরগুলো হিদায়েতুল্লাহর সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকতে হতো এবং প্রায় সব সময়ই মেহমানদের আসা-যাওয়া চলত। প্রথম স্কুলটা ছিল ছেলেমেয়ে একত্রে পড়ার ছোট প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমি যতদিনে জন্মেছি ততদিনে সেখানে পাঁচ-ছয়জন শিক্ষক এবং মাসে শত রুপি বেতন দেওয়া প্রায় একশজন শিক্ষার্থী। আমার বাবা ছিলেন শিক্ষক, হিসাবরক্ষক এবং অধ্যক্ষ। তিনি ঝাড়ু দিতেন, দেয়াল চুনকাম করতেন এবং শৌচাগারও পরিষ্কার করতেন। মইয়ের সর্বোচ্চ ধাপে উঠলে পা কাঁপার সমস্যা এবং উচ্চতাভীতি থাকা সত্ত্বেও তিনি স্কুলের বিজ্ঞাপনের ব্যানার টানাতে বৈদ্যুতিক খুঁটি বেয়ে উঠতেন। পানির পাম্প নষ্ট হয়ে গেলে তিনি নিজে সেটা ঠিক করতে কূপে নেমে পড়তেন। বাবাকে সেখানে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে আমি কান্না জুড়ে দিতাম, আমার মনে হতো তিনি আর উঠে আসবেন না। ভাড়া ও বেতন পরিশোধ করার পর খাবারের জন্য অল্প অর্থই বাকি থাকত। চায়ের জন্য দুধ কেনার সামর্থ্য না থাকায় আমরা গ্রিনটি পান করতাম। কিন্তু কিছুদিন পরই স্কুলটি লাভ-ক্ষতি কোনোকিছু না করে ব্রেক-ইভেন পয়েন্টে ব্যবসা করতে লাগল, এবং বাবা আরেকটি স্কুল দেওয়ার পরিকল্পনা করতে লাগলেন, যার নাম তিনি দিতে চাইলেন ‘মালালা এডুকেশন একাডেমি।’

 পুরো স্কুলটাকেই আমি আমার খেলার মাঠ মনে করে দৌড়ে বেড়াতাম। বাবা বলেন, কথা বলতে শেখার আগেই আমি গুটি গুটি পায়ে ক্লাসে ক্লাসে ঢুকে শিক্ষক শিক্ষক ভাব নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করতাম। মিস উলফাতের মতো নারী শিক্ষকরা আমাকে পোষা প্রাণীর মতো কোলে তুলে নিতেন এবং কিছুক্ষণের জন্য নিজের বাসায়ও নিয়ে যেতেন। তিন-চার বছর বয়সে আমি অনেক বড় ক্লাসে গিয়ে বসতাম। আমি অবাক হয়ে বসে থাকতাম, যা পড়ানো হচ্ছে সব শুনতাম। মাঝেমধ্যে শিক্ষকদের নকল করতাম। বলা যায়, আমি স্কুলেই বেড়ে উঠেছি।

  নাঈমের ঘটনা থেকে বাবা বুঝতে পেরেছিলেন, বন্ধুত্বের সঙ্গে ব্যবসার মেলবন্ধন ঘটানো সহজ নয়। ক্রমেই হিদায়েতুল্লাহ নিজের আলাদা একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করার জন্য সরে গেলেন এবং চারটি ক্লাসের শিক্ষার্থীদের বাবা এবং হিদায়েতুল্লাহ দুটি দুটি করে ক্লাসে ভাগ করে নিলেন। বাচ্চাদের তাঁরা সেটা বলেননি, কারণ তাঁরা চাইছিলেন মানুষ ভাবুক স্কুলটি প্রসারিত হচ্ছে এবং দুটো ভবন হচ্ছে। যদিও বাবা হিদায়েতুল্লাহর সঙ্গে তখন কথা বলতেন না, আমার জন্য হিদায়েতুল্লাহর খারাপ লাগত এবং আমাকে তিনি দেখতে আসতেন। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের এক বিকেলে তিনি বেড়াচ্ছেন সময়ে প্রচুর হৈ চৈ শোনা গেল এবং লোকজন আসতে শুরু করল। তারা বলল, নিউইয়র্কে একটি ভবনে বিশাল আক্রমণ হয়েছে এবং দুটো বিমান সেখানে গেছে। আমার বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর, এসব বোঝার পক্ষে খুবই ছোট ছিলাম। বড়দের জন্যও এটা চিন্তা করা দুঃসাধ্য ছিল – সোয়াতের সবচেয়ে উঁচু ভবনগুলো ছিল হাসপাতাল এবং হোটেল, যেগুলো সাধারণত দুই বা তিনতলা হয়ে থাকে। সবকিছুকেই অনেক দূরে মনে হতে লাগল। নিউইয়র্ক এবং আমেরিকা কোথায় – সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। স্কুলটাই ছিল আমার পৃথিবী এবং আমার পৃথিবীটাই ছিল স্কুল। তখনো বুঝিনি ৯/১১ আমাদের পৃথিবী পাল্টে দেবে, আমাদের উপত্যকায় ডেকে আনবে যুদ্ধ।

(চলবে)

মালালা ইউসুফজাই

পাঠকের পছন্দ

গরমে ঘামাচিতে জেরবার?

ভ্রমণের সময় যা মনে রাখবেন

কীভাবে হবেন ভালো সহকর্মী?

সর্বাধিক পঠিত
  1. বিমান দুর্ঘটনায় প্রিয়জন হারিয়েছেন ‘টুয়েলভথ ফেল’ অভিনেতা
  2. বিবাহিত জীবনে সফল না-ই হতে পারি, বিচ্ছেদে কিন্তু সফল : আমির খান
  3. বক্স অফিস : ৪ দিনে ১৬০ কোটির ঘরে ‘হাউসফুল ৫’
  4. মুখের বিমা করলেন করণ জোহর?
  5. আদিত্যের সঙ্গে প্রেমে শিক্ষা হয়েছে, কোন ভুলটা আর করতে চান না অনন্যা?
  6. ‘ধুম ৪’ সিনেমায় খলনায়ক রণবীর, পরিচালক আয়ন মুখার্জি
সর্বাধিক পঠিত

বিমান দুর্ঘটনায় প্রিয়জন হারিয়েছেন ‘টুয়েলভথ ফেল’ অভিনেতা

বিবাহিত জীবনে সফল না-ই হতে পারি, বিচ্ছেদে কিন্তু সফল : আমির খান

বক্স অফিস : ৪ দিনে ১৬০ কোটির ঘরে ‘হাউসফুল ৫’

মুখের বিমা করলেন করণ জোহর?

আদিত্যের সঙ্গে প্রেমে শিক্ষা হয়েছে, কোন ভুলটা আর করতে চান না অনন্যা?

ভিডিও
রাতের আড্ডা : পর্ব ০৭
ফাউল জামাই : পর্ব ৯৯
ফাউল জামাই : পর্ব ৯৯
আপনার জিজ্ঞাসা : বিশেষ পর্ব ৩৩৭৯
আপনার জিজ্ঞাসা : বিশেষ পর্ব ৩৩৭৯
স্বাস্থ্য প্রতিদিন : পর্ব ৫৫৩৮
পবিত্র হজ্ব ২০২৫ (সরাসরি)
পবিত্র হজ্ব ২০২৫ (সরাসরি)
গানের বাজার, পর্ব ২৩৫
গানের বাজার, পর্ব ২৩৫
এক্সপার্ট টুডেস কিচেন : পর্ব ৩০১
এক্সপার্ট টুডেস কিচেন : পর্ব ৩০১
আলোকপাত : পর্ব ৭৭৬
মহিলাঙ্গন : পর্ব ৩৬১
মহিলাঙ্গন : পর্ব ৩৬১
একক নাটক : চীফ গেষ্ট
নাটক : চীফ গেষ্ট

Alhaj Mohammad Mosaddak Ali

Chairman

NTV Online, BSEC Building (Level-8), 102 Kazi Nazrul Islam Avenue, Karwan Bazar, Dhaka-1215 Telephone: +880255012281 up to 5, Fax: +880255012286 up to 7

Alhaj Mohammad Mosaddak Ali

Chairman

NTV Online, BSEC Building (Level-8), 102 Kazi Nazrul Islam Avenue, Karwan Bazar, Dhaka-1215 Telephone: +880255012281 up to 5, Fax: +880255012286 up to 7

Browse by Category

  • About NTV
  • Career
  • NTV Programmes
  • Advertisement
  • Web Mail
  • NTV FTP
  • Satellite Downlink
  • Europe Subscription
  • USA Subscription
  • Privacy Policy
  • Terms & Conditions
  • Contact
  • Archive

NTV Prime Android App

Find out more about our NTV: Latest Bangla News, Infotainment, Online & Live TV

Qries

Reproduction of any content, news or article published on this website is strictly prohibited. All rights reserved

x